বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প সম্ভাবনা ও উত্তরণ

প্রিপারেশন

২৭ নভেম্বর, ২০২৫

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে নিয়ে যায় হিমালয় থেকে সুন্দরবন, পিরামিডের চূড়া থেকে টেমস নদীর তীরে। বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ পর্যটন সম্ভাবনাময় দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন একটি বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সাহায্য করবে।

পর্যটন শিল্প

পর্যটন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে মানুষ তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল থেকে অন্য কোথাও ভ্রমণ করে, যা বিনোদন, ব্যবসা বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে হতে পারে। কোনো ভৌগোলিক স্থানকে কেন্দ্র করে যে শিল্প গড়ে ওঠে, যেখানে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা তৈরি করা হয় তাকে পর্যটন শিল্প বলে। পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রম ঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎ বাণিজ্যিক কাজকর্ম হিসেবে এই শিল্প নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। মানুষের এই ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষা থেকেই পর্যটন শিল্পের উৎপত্তি। পৃথিবীর অনেক দেশে এ পর্যটন শিল্প আজ এক নতুন রূপ লাভ করেছে।

পর্যটন শিল্পের ইতিহাস

১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন এক দেশের জন্ম হয়, যার নাম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ২৭ নভেম্বর ১৯৭২ মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১৪৩ নং আদেশ The Bangladesh parjaton corporation order, 1972 জারির মাধ্যমে পর্যটন শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে দুটি প্রধান প্রতিষ্ঠান কাজ করে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (BPC) এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (BIB)। ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ থেকে কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (BPC)। সংস্থা দুটি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এর আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। পর্যটন আইন-২০১০-এর মাধ্যমে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় পর্যটন সংস্থা (BTB) হিসেবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (BTB) গঠন করা হয়।

জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UN Tourism): জাতিসংঘের 'বিশ্ব পর্যটন সংস্থা' (World Tourism Organization পূর্বের নাম UNWIO) কার্যক্রম শুরু করে ১৯২৫ সালে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ বাংলাদেশ এই সংস্থার সদস্য হয়। ১৯৮০ সালের বার্ষিক সম্মেলনে সংস্থার বিধিমালা গঠনের তারিখ ২৭ সেপ্টেম্বরকে বিশ্বব্যাপী পর্যটন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সংস্থাটির সদস্য রাষ্ট্র ১৬০টি।

বাংলায় বিশ্বের বিখ্যাত পর্যটকবৃন্দ বাংলা সুদূর অতীত থেকেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। বিশ্বের নানা অংশ থেকে পর্যটকরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বাংলা ভ্রমণ করেছে। অতীতে বাংলায় আসা কয়েকজন পর্যটক হচ্ছেন- গ্রিসের প্লিনি দ্য এন্ডার ১ম শতকে, মিসরের ক্লডিয়াস টলেমায়েস টলেমি ২য় শতকে, চীনের ফা-হিয়েন-৫ম শতকে ও হিউয়েন-সাং ৭ম শতকে, মরক্কোর ইবনে বতুতা ১৪শ শতকে, চীনের মা হুয়ান ১৫শ শতকে, পর্তুগালের দুয়ার্তে বারবোসা ১৬শ শতকে, ইতালির সিজার ফ্রেডেরিক ১৭শ শতকে, ইংল্যান্ডের র‍্যল্ফ ফিচ ১৬শ শতকে, এবং ফ্রান্সের জে.বি টেভার্নিয়ার ১৭শ শতকে বাংলায় আগমন করেন।

উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পট

ট্যুর অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে ৫০-৬০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ। আর পরোক্ষভাবে আরও ২৩ লাখ মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০-৪৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। আর্থিক মূল্যে দেশিয় পর্যটন খাতের আয়তন বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকা। নিম্নে বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ উল্লেখ করা হলো-

কক্সবাজার: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি পর্যটন শহর। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত। এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত যা ১২০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিন নারিকেল জিঞ্জিরা নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।

সুন্দরবন: খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা জুড়ে বিস্তৃত। বর্তমানে বাংলাদেশের অংশে সুন্দরবনের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবন ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ইউনেস্কো ঘোষিত ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃ তি দেয় এবং এর পূর্বে ১ মে ১৯৯২ সুন্দরবনকে রামসার কনভেনশনের আওতায় ৫৬০তম রামসার স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার: ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। খ্রিষ্টিয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে।

ষাট গম্বুজ মসজিদ: ষাট গম্বুজ মসজিদ সুলতানি আমলে নির্মিত হয়। মসজিদটির নির্মাণ ১৪৪২ সালে শুরু হয় এবং এটি ১৪৫৯ সালে সম্পূর্ণ হয়। মসজিদটি সাধারণত নামাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো বাগেরহাটকে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ৩২১তম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। এতে বাগেরহাটের ১৭টি স্থাপনা স্থান পায়। যার মধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ অন্যতম। এছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য নৈসর্গিক স্থান যেমন-শ্রীমঙ্গল, বান্দরবান, সাজেক উপত্যকা, রাঙ্গামাটি ইত্যাদি।

সমস্যাসমূহ

পর্যটন শিল্প বিকাশে বাংলাদেশের সামনে যেসব প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোকে হলো-

  • কাগুজে নীতিমালা: ১৯৯২ সালে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা তৈরি করা হয় এবং ২০১০ সালে সেটি হালনাগাদও করা হয়। এখানে কক্সবাজার, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান ঢেলে সাজানোর কথা বলা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে চোখে পড়ার মতো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
  • দুর্বল অবকাঠামো: পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসম্মত হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট এবং ইকো-লজের অভাব রয়েছে। এছাড়াও, সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও আধুনিকায়ন হয়নি, যা পর্যটকদের যাতায়াতকে কঠিন করে তোলে।
  • রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে বড় সমস্যা। বিভিন্ন সময়ে হরতাল, মিছিল মিটিং এর জন্য অনেক রাস্তা বন্ধ থাকে, যোগাযোগ ব্যহত হয়। তাছাড়া এই ধরনের অস্থিরতার সময় পর্যটন কেন্দ্রগুলো ও বন্ধ করে দেওয়া হয় যা পর্যটন খাতের উন্নয়নের পথে একটি বড় বাঁধা।
  • দক্ষ মানবসম্পদের অভাব পর্যটন শিল্পে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। মানসম্মত গাইড, হোটেল ব্যবস্থাপক, রন্ধনশিল্পী এবং নিরাপত্তা কর্মীদের অভাব পর্যটকদের সেবার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বহুভাষিক গাইডের অভাব বিদেশি পর্যটকদের জন্য একটি বড় সমস্যা।
  • অপর্যাপ্ত প্রচার ও ব্র্যান্ডিং: আধুনিক ডিজিটাল বিপণন কৌশল এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলায় পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা সম্পর্কে সঠিক বার্তা পৌছাচ্ছে না।
  • ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতা বিদেশি পর্যটকদের জন্য ভিসা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া এখনও অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ এবং আবেদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা অনেক সম্ভাব্য পর্যটককে বাংলাদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত রাখে।

পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের উদীয়মান শিল্পের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে পর্যটন শিল্প। দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৪.৪% আসে এই শিল্প থেকে। পর্যটন শিল্পকে উন্নত করে দেশের বেকারত্ব দূর করার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা যায়। পৃথিবীতে এখন প্রায় ৮০৯ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। ২০৫০ সালে এই পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে ৪৫০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছবে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে রয়েছে সুবিশাল সমদ্রসৈকত, পাহাড়, অরণ্যঘেরা জলপ্রপাত, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।

উত্তরণের উপায়

  • অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যাতায়াত ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করা।
  • সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে তদারকির ব্যবস্থা করে, পর্যটন এলাকায় পুলিশ কেন্দ্র স্থাপন, ও পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শতভাগ নিশ্চিত করা।
  • বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক গাইডের ব্যবস্থা করা, গাইডদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা ও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া।
  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রণয়ন করে অর্থনৈতিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করা।
  • ভিসা প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল সেবার আওতায় আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজীকরণ করা।
  • পর্যটন বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করা।
  • পর্যটন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থা, পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন অফার প্যাকেজ চালু রাখা প্রভৃতি।

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। তবে, এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান করে একটি সুচিন্তিত, সুসংহত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। 'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে র'য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে'; -জীবনানন্দ দাশ

বিষয় : সাধারণ জ্ঞান