নোবেল পুরস্কার ২০২৫: বিজ্ঞান থেকে শান্তির দিকে একটি যাত্রা
— প্রিপারেশন
নোবেল পুরস্কার ২০২৫
প্রতি বছর অক্টোবর মাস এলেই পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ একটি বিশেষ উত্তেজনায় ভরে ওঠে। স্টকহোম ও অসলো থেকে যখন নোবেল কমিটি একে একে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে, তখন বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শান্তিকর্মী ও অর্থনীতিবিদদের কাজ বিশ্বের কাছে নতুন করে আলোকিত হয়। ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ বছরের পুরস্কারগুলো একই সঙ্গে মানব সভ্যতার গভীরতম সংকট (রোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, গণতন্ত্রের সংকট) এবং সবচেয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনা (কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, নতুন উপাদান, সৃজনশীল ধ্বংসের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি) নিয়ে কথা বলছে।
২০২৫ সালের নোবেল সপ্তাহ শুরু হয়েছিল ৬ অক্টোবর, সোমবার, ঐতিহ্যমতো ফিজিওলজি বা মেডিসিন দিয়ে। এরপর ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, সাহিত্য, শান্তি এবং অর্থনীতি এই ছয়টি বিভাগে পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এ বছরের বিজয়ীদের কাজের প্রায় প্রতিটিই কোনো না কোনোভাবে “মানুষের নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে বাঁচানোর” গল্প বলছে। শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে নিজের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখা, কোয়ান্টাম জগতের রহস্যকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের কম্পিউটার তৈরি করা, বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ক্যাপচার করার নতুন উপাদান আবিষ্কার করা, কিংবা একনায়কতন্ত্রের মুখে গণতন্ত্রের আগুন জ্বালিয়ে রাখা সবই যেন একটি বৃহত্তর ক্যানভাসে আঁকা।
এ বছরের আরেকটি বিশেষত্ব হলো বিজয়ীদের বৈচিত্র্য। হাঙ্গেরি থেকে ভেনেজুয়েলা, জাপান থেকে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এবং বিভিন্ন প্রজন্মের বিজ্ঞানী একই মঞ্চে এসেছেন। এই বৈচিত্র্যই নোবেল পুরস্কারকে শুধু একটি পুরস্কার নয়, বরং মানবতার সম্মিলিত আশার প্রতীক করে তোলে।
ফিজিওলজি অর মেডিসিন বিভাগ
৬ অক্টোবর ২০২৫, সকাল ১১:৩০ মিনিটে ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের সভাকক্ষে নোবেল অ্যাসেম্বলির সেক্রেটারি থমাস পার্লম্যান ঘোষণা করলেন:“২০২৫ সালের চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে প্রদান করা হচ্ছে মারি ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল এবং শিমন সাকাগুচির প্রতি তাঁদের পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্সের মেকানিজম আবিষ্কারের জন্য, যা শরীরের নিজস্ব টিস্যুর প্রতি ইমিউন সিস্টেমের আক্রমণ প্রতিরোধ করে।”
এই একটি বাক্যের পেছনে লুকিয়ে আছে গত তিন দশকেরও বেশি সময়ের গবেষণা এবং এক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক যাত্রা।
সহজ ভাষায় বললে, আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম এক অদ্ভুত দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী। একদিকে এটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ক্যান্সার কোষের মতো শত্রুদের চিনে নিশ্চিহ্ন করে, অন্যদিকে নিজের শরীরের সুস্থ কোষগুলোকে কখনো আক্রমণ করে না। কিন্তু কীভাবে এই “নিজেকে চেনা এবং নিজেকে ছাড় দেওয়া” ঘটে? এতদিন আমরা জানতাম থাইমাস গ্রন্থিতে টি-সেলগুলোর “সেন্ট্রাল টলারেন্স” হয় যেখানে নিজের প্রতি আক্রমণাত্মক টি-সেলগুলো ধ্বংস করা হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি নয়। তিন বিজ্ঞানী দেখালেন, শরীরের বিভিন্ন টিস্যু ও লিম্ফ নোডে আরেকটি স্তরের নিয়ন্ত্রণ আছে যাকে বলা হয় পেরিফেরাল টলারেন্স।
এই আবিষ্কারের কেন্দ্রে আছে তিনটি মূল উপাদান:
- রেগুলেটরি টি-সেল (Treg)
- CTLA-4 এবং PD-1/PD-L1 পাথওয়ে
- টিস্যু-নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন প্রেজেন্টেশন
১৯৯৫ সালে জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিমন সাকাগুচি প্রথম দেখান যে, Foxp3 জিনের মিউটেশন থাকলে রেগুলেটরি টি-সেল তৈরি হয় না, ফলে ইঁদুরের শরীর নিজের বিভিন্ন অঙ্গের উপর আক্রমণ করে (অটোইমিউনিটি)। এই কাজই পরে মানুষের IPEX সিনড্রোমের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
একই সময়ে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলের ফ্রেড রামসডেল এবং মারি ব্রাঙ্কো (তখনও তাঁরা আলাদা ল্যাবে কাজ করছেন) দেখান যে, CTLA-4 নামের একটি মলিকিউল টি-সেলের সক্রিয়করণে ব্রেক হিসেবে কাজ করে। CTLA-4 ব্লক করলে টি-সেল অতি-সক্রিয় হয়ে নিজের শরীরের উপর আক্রমণ চালায়। এই আবিষ্কারই পরবর্তীতে ইমিউন চেকপয়েন্ট ইনহিবিটরের জন্ম দেয় যা আজ ক্যান্সার চিকিৎসার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
তিন বিজ্ঞানীর কাজ একত্রিত হলে যে ছবি দাঁড়ায় তা অসাধারণ: শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে একটা গাড়ির সঙ্গে তুলনা করলে, অ্যাক্সিলেটর হলো সাধারণ টি-সেল, আর ব্রেক হলো রেগুলেটরি টি-সেল এবং CTLA-4/PD-1। এই ব্রেক না থাকলে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে (অটোইমিউন রোগ), আর ব্রেক বেশি চেপে ধরলে গাড়ি চলে না (ইমিউন সাপ্রেশন, ক্যান্সার বাড়ে)।
এই কাজের ফলাফল আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি:
- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের মতো অটোইমিউন রোগের নতুন চিকিৎসা
- মেলানোমা, ফুসফুসের ক্যান্সার, কিডনি ক্যান্সারে ইমিউনোথেরাপির বিপ্লব
- অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর রিজেকশন কমানোর নতুন পথ
২০২৫-এর এই পুরস্কার শুধু তিন বিজ্ঞানীর কাজের স্বীকৃতি নয়, এটি একটি বার্তাও বহন করে: মানুষের শরীরের সবচেয়ে জটিল রহস্যগুলোর একটি আমরা এখন বুঝতে পেরেছি। এবং সেই বোঝাপাড়া দিয়ে আমরা এখন শরীরকে বলতে পারি “নিজেকে আক্রমণ করো না, বরং শত্রুকে আক্রমণ করো।”
নোবেল সপ্তাহের প্রথম দিনেই যে বার্তা দেওয়া হলো, তা পরের দিনগুলোর পুরস্কারের সঙ্গে মিলে একটি বড় কথা বলছে: মানুষ তার নিজের সংকটগুলোর সমাধান নিজেই খুঁজে নিতে পারে বিজ্ঞানের আলোয়, ধৈর্যে, আর সাহসে।
ফিজিক্স বিভাগ
কোয়ান্টাম মেকানিক্স, যা অণু-পরমাণুর অদ্ভুত জগতকে বর্ণনা করে, সাধারণত অত্যন্ত ক্ষুদ্র স্কেলে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ২০২৫-এর নোবেল ফিজিক্স পুরস্কারের বিজয়ীরা জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ. ডেভোরেট এবং জন এম. মার্টিনিস প্রমাণ করেছেন যে এই কোয়ান্টাম প্রভাবগুলোকে ম্যাক্রোস্কোপিক স্তরে, অর্থাৎ হাতে ধরা যায় এমন আকারে, পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। তাদের কাজ ১৯৮০-এর দশকের পরীক্ষামূলক গবেষণার ফল, যেখানে তারা সুপারকন্ডাকটিং সার্কিট ব্যবহার করে কোয়ান্টাম টানেলিং এবং এনার্জির কোয়ান্টাইজেশন দেখিয়েছেন।
জন ক্লার্ক, ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বার্কলে) অধ্যাপক, এই কাজের পথিকৃৎ। তিনি ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে সুপারকন্ডাকটিং জোসেফসন জংশন নিয়ে কাজ করেন, যা কোয়ান্টাম ইফেক্টগুলোকে বড় স্কেলে নিয়ে আসে। মিশেল ডেভোরেট, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এবং বর্তমানে গুগল কোয়ান্টাম এআই টিমের চিফ সায়েন্টিস্ট, এই পরীক্ষাগুলোকে আরও উন্নত করেন। তাঁর নেতৃত্বে কোয়ান্টাম সার্কিটগুলোতে এনার্জির কোয়ান্টাইজড লেভেলগুলো পরিমাপ করা হয়, যা ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের সীমানা অতিক্রম করে। জন মার্টিনিস, যিনি গুগলের সাথে যুক্ত ছিলেন, এই কাজকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্রতি পরিচালিত করেন। তাঁদের যৌথ পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ইলেকট্রিক সার্কিটে ইলেকট্রনগুলো ক্লাসিক্যাল বাধা অতিক্রম করে 'টানেল' করে যায়, এবং এনার্জি লেভেলগুলো বিচ্ছিন্ন কোয়ান্টায় বিদ্যমান থাকে।
এই আবিষ্কারের তাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি মৌলিক প্রশ্ন হলো: কোন সিস্টেমের সাইজ সীমা যতদূর পর্যন্ত কোয়ান্টাম ইফেক্ট দেখাতে পারে? বিজয়ীরা প্রমাণ করেছেন যে এটি হাতের মুঠোর মতো বড় স্কেলেও সম্ভব। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অল্লে এরিকসন বলেছেন, "কোয়ান্টাম মেকানিক্স ডিজিটাল টেকনোলজির ভিত্তি, এবং এই পুরস্কার পরবর্তী প্রজন্মের কোয়ান্টাম প্রযুক্তির পথ প্রশস্ত করেছে।" বাস্তবে, এই কাজ ছাড়া আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো অসম্ভব হতো। গুগলের স্যুপারকন্ডাকটিং কিউবিটগুলো এই আবিষ্কারের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া, কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং সেন্সর টেকনোলজিতে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কোয়ান্টাম সেন্সরগুলো চিকিত্সায় ক্যান্সার সেলগুলোকে আরও নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পারে।
তবে এই কাজের পথ ছিল কাঁটায় ভরা। ১৯৮০-এর দশকে সুপারকন্ডাকটরগুলোকে অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় (প্রায় অ্যাবসোলিউট জিরো) রাখতে হয়, যা পরীক্ষাগুলোকে জটিল করে তুলেছিল। ক্লার্ক নিজে বলেছেন, "এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ।" তাঁদের কাজ আজ গুগল, আইবিএম এবং অন্যান্য কোম্পানির কোয়ান্টাম রিসার্চকে অনুপ্রাণিত করছে। ফলে, ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের চেয়ে লক্ষ গুণ দ্রুত গণনা সম্ভব হয়েছে, যা জলবায়ু মডেলিং থেকে ওষুধ আবিষ্কার পর্যন্ত পরিবর্তন আনবে। এই পুরস্কার আমেরিকান সায়েন্স সিস্টেমের শক্তির প্রমাণ, যেখানে বেসিক রিসার্চ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে।
কেমিস্ট্রি বিভাগ
যদি ফিজিক্সের পুরস্কার কোয়ান্টামের অদৃশ্য জগতকে দৃশ্যমান করে, তাহলে কেমিস্ট্রির পুরস্কার মলিকুলার স্তরে 'স্থাপত্য' তৈরির কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। ওমর এম. ইয়াগি, রিচার্ড রবসন এবং সুসুমু কিতাগাওয়া মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (MOFs) এর উন্নয়নের জন্য সম্মানিত। এই ফ্রেমওয়ার্কগুলো ধাতব আয়নগুলোকে কোণের স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করে দীর্ঘ অর্গানিক মলিকুল দিয়ে সংযুক্ত করে, যার ফলে বিশাল ফাঁকা স্পেস তৈরি হয় যেখানে গ্যাস এবং রাসায়নিক পদার্থ প্রবাহিত হতে পারে।
ওমর ইয়াগি, ইউসি বার্কলের অধ্যাপক, এই ক্ষেত্রের জনক। তিনি ১৯৯০-এর দশকে 'রেটিকুলার কেমিস্ট্রি' নামক একটি নতুন শাখা প্রবর্তন করেন, যা মলিকুলার বিল্ডিং ব্লকগুলোকে সেলাই করে ছিদ্রযুক্ত কাঠামো তৈরি করে। ইয়াগির ল্যাবে হাজার হাজার MOFs সংশ্লেষিত হয়েছে, যা সাধারণ স্পঞ্জের চেয়ে ৯০% ফাঁকা। রিচার্ড রবসন, অস্ট্রেলিয়ার মেলবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ১৯৯০-এ প্রথম MOF-এর কাঠামো প্রস্তাব করেন, যা ধাতব ক্লাস্টার এবং অর্গানিক লিঙ্কারের সমন্বয়ে তৈরি। সুসুমু কিতাগাওয়া, জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী, এই কাঠামোগুলোকে 'ফ্লেক্সিবল' করে তুলেছেন, যাতে তারা পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাঁদের যৌথ কাজের ফলে MOFs-এর আকার এবং কার্যকারিতা অসীমভাবে প্রসারিত হয়েছে।
এই আবিষ্কারের প্রভাব পরিবেশ এবং শিল্পে বিপ্লবী। MOFs গ্যাস শোষণে অসাধারণ: এরা মরুভূমির বাতাস থেকে পানি বের করে আনতে পারে, যা জলসংকটপূর্ণ অঞ্চলে জীবনরক্ষক। উদাহরণস্বরূপ, ইয়াগির ডিজাইন করা MOF-505 বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকরি 'এয়ার ক্যাপচার' ডিভাইস, যা এক কেজি MOF থেকে দৈনিক ১ লিটার পানি উৎপাদন করে। কার্বন ডাইঅক্সাইড ক্যাপচারে MOFs-এর ভূমিকা অপরিসীম এরা শিল্প নির্গমনকে ৯০% পর্যন্ত কমাতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মাইলফলক। এছাড়া, বিষাক্ত গ্যাস যেমন হাইড্রোজেন সালফাইড স্টোরেজ বা রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় ক্যাটালিস্ট হিসেবে ব্যবহার হয়। ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে MOFs ওষুধের টার্গেটেড ডেলিভারি করে, যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমায়।
নোবেল কমিটি বলেছে, "এই মলিকুলার নির্মাণগুলো রসায়নের জন্য নতুন ঘর তৈরি করেছে।" কিন্তু চ্যালেঞ্জও রয়েছে: MOFs-এর স্থায়িত্ব বাড়ানো এবং বড় স্কেলে উৎপাদন। ইয়াগি বলেছেন, "এটি কেমিস্ট্রির লেগো ব্লক যেকোনো আকারে তৈরি করা যায়।" তাঁদের কাজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্লাইমেট অ্যাকশন প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা একটি পরিষ্কার গ্রহের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইয়াগির মতো বিজয়ীদের ব্যাকগ্রাউন্ডও অনুপ্রেরণাদায়ক তিনি ইউএলব্যানির অ্যালামনাই, যা প্রমাণ করে যে সাধারণ শিক্ষা থেকে বিশ্ব পরিবর্তন সম্ভব।
লিটারেচার বিভাগ
২০২৫ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গেল হাঙ্গেরির লেখক লাসজ্লো ক্রাসনাহোরকাই-এর হাতে। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে এই কথা বলে:“for his visionary prose that rekindles the power of art amid apocalyptic terror” অর্থাৎ “অ্যাপোক্যালিপটিক আতঙ্কের মধ্যেও শিল্পের শক্তিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার দূরদর্শী গদ্যের জন্য”।
ক্রাসনাহোরকাই-এর নাম আগে থেকেই ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্ধকার কোণে জ্বলজ্বল করত। বেলা তার, থমাস বার্নহার্ড, স্যামুয়েল বেকেটের সঙ্গে তাঁর তুলনা হয়। কিন্তু তিনি কখনো সহজপাঠ্য ছিলেন না। তাঁর বাক্য অসম্ভব লম্বা কখনো কখনো একটি অধ্যায়ে মাত্র তিন-চারটি বাক্য যেন পাঠককে শ্বাসরোধ করে টেনে নিয়ে যায় এক অন্ধকার গহ্বরে। সেই গহ্বরে আছে যুদ্ধ-পরবর্তী হাঙ্গেরির ধ্বংসস্তূপ, কমিউনিজমের পতনের পরের শূন্যতা, আর মানুষের অস্তিত্বের নিরন্তর পতন।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস The Melancholy of Resistance (১৯৮৯) থেকে বেলা তার বানিয়েছিলেন ছবি Werckmeister Harmonies যেখানে একটা মৃত তিমির দেহ নিয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়ে অরাজকতা। Satantango (১৯৮৫)-তে একটা বৃষ্টিভেজা গ্রামে ফিরে আসে এক ভুয়া মসিহা; মানুষ তাকে অনুসরণ করে ধ্বংসের দিকে। এই সব গল্পে কোনো নায়ক নেই, কোনো আশার আলো নেই। আছে শুধু একটা অবিরাম পতনের শব্দ।
তবু সুইডিশ একাডেমি বলছে, এই পতনের মধ্যেই তিনি “শিল্পের শক্তি” জাগিয়ে তুলছেন। কীভাবে? ক্রাসনাহোরকাইয়ের গদ্যে ভাষা নিজেই একটা স্বাধীন চরিত্র হয়ে ওঠে। তাঁর বাক্য যখন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গড়িয়ে যায়, পাঠকের মনে হয় যেন সে একটা অন্ধকার নদীর স্রোতে ভেসে চলেছে আর সেই স্রোতের মধ্যেই কোথাও একটা অলৌকিক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তিনি দেখান, ধ্বংসের মধ্যেও মানুষ যখন ভাষা ধরে থাকে, তখনো সে মানুষ থাকে। এই হল তাঁর “rekindling the power of art”।
২০২৫ এর এই পুরস্কারের আরেকটা তাৎপর্য আছে। গত কয়েক বছরে নোবেল সাহিত্যে এসেছে আফ্রিকান, কোরিয়ান, চীনা, পোলিশ লেখক। এবার মধ্য-ইউরোপের একজন লেখক যিনি কখনো ইংরেজিতে লেখেননি, যাঁর বই প্রায় সবই জার্মান ও ফরাসি থেকে অনূদিত। এ যেন একটা স্মারক পশ্চিমের বাইরের ইউরোপ এখনো বেঁচে আছে, তার অন্ধকার গল্প এখনো বলার আছে।
পিস বিভাগ
একই বছরে যখন সাহিত্য পুরস্কার গেল অন্ধকারের গায়কের হাতে, শান্তি পুরস্কার গেল একজন নারীর হাতে যিনি অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রতিদিন লড়াই করছেন। ভেনেজুয়েলার মারিয়া করিনা মাচাদো ২০২৫-এর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি বলেছে:
“for her courageous efforts to keep the flame of democracy burning in Venezuela and for being a champion of peaceful struggle in one of the world’s most difficult political contexts”।
ভেনেজুয়েলা আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের একটা। ২০১৩ সাল থেকে নিকোলাস মাদুরোর শাসনের অধীনে দেশটা ধ্বংস হয়ে গেছে। হাইপারইনফ্লেশন, খাদ্য-ওষুধের অভাব, বিদ্যুৎ-জলের সংকট। ৮০ লক্ষের বেশি মানুষ দেশ ছেড়েছে। বিরোধী দলের প্রায় সব নেতাকে হয় জেলে পাঠানো হয়েছে, নয় দেশঅন্তর করা হয়েছে, নয় তাঁদের রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এই অবস্থায় মারিয়া করিনা একাই দাঁড়িয়ে আছেন। ২০২৩-২৪ সালে তিনি প্রাইমারি জিতেছিলেন ভূমিধস বিজয়ে। জনমত জরিপে দেখা গিয়েছিল তিনি মাদুরোকে ৫০ পয়েন্টের বেশি ব্যবধানে হারাবেন। তারপর যা হওয়ার তাই হল তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়াতে দেওয়া হল না। কিন্তু তিনি হার মানেননি। তিনি এদুয়ার্দো গনজালেজকে সমর্থন দিলেন, আর নির্বাচনের দিন লাখ লাখ ভেনেজুয়েলান রাস্তায় নেমে এলেন। সরকারি ফলাফল যাই হোক, বিরোধীদের হাতে থাকা ভোটের কপি অনুযায়ী মাচাদো-সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। তারপর শুরু হল দমন। কিন্তু মারিয়া করিনা এখনো দেশের ভিতরে আছেন, প্রকাশ্যে হাঁটেন, বক্তৃতা দেন, আর বলেন, “এই লড়াই শেষ হয়নি”।
নোবেল কমিটি এই পুরস্কার দিয়ে শুধু মাচাদোকে সম্মান করেনি, ভেনেজুয়েলার লাখ লাখ মানুষকে সম্মান জানিয়েছে যারা এখনো গণতন্ত্রের জন্য লড়ছে। এটা আলেক্সেই নাভালনির মৃত্যুর পরের বছরের পুরস্কারের মতোই একটা রাজনৈতিক বার্তা। লাতিন আমেরিকায় এই প্রথম কোনো ভেনেজুয়েলান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন।
ইকোনমিক সায়েন্সেস বিভাগ
উদ্ভাবন-চালিত বৃদ্ধি এবং সৃজনশীল ধ্বংসের তত্ত্ব
২০২৫ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার (সুইডিশ ব্যাংক প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্সেস ইন মেমোরি অফ আলফ্রেড নোবেল) যৌথভাবে পেয়েছেন তিনজন অর্থনীতিবিদ: ফিলিপ আগিয়ন (Philippe Aghion), পিটার হাউইট (Peter Howitt) এবং জোয়েল মোকির (Joel Mokyr)। নোবেল কমিটি তাঁদের এই পুরস্কার দিয়েছে “উদ্ভাবন কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নির্ধারণ করে এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ কীভাবে উদ্ভাবনকে প্রভাবিত করে এই বিষয়ে মৌলিক অবদানের” জন্য।
এই তিন বিজয়ীর কাজ একসঙ্গে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিয়েছে, যাকে বলা হয় “শুম্পেটেরিয়ান গ্রোথ থিওরি” বা “সৃজনশীল ধ্বংসের (Creative Destruction) তত্ত্ব”। জোসেফ শুম্পেটার ১৯৪২ সালে প্রথম এই ধারণা দিয়েছিলেন যে, অর্থনীতির প্রকৃত চালিকাশক্তি হলো নতুন উদ্ভাবন, যা পুরোনো প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক মডেলকে ধ্বংস করে নতুনের জায়গা করে দেয়। কিন্তু শুম্পেটারের ধারণা তখন গাণিতিক মডেলে রূপান্তরিত হয়নি। আগিয়ন ও হাউইট ১৯৯২ সালে তাঁদের বিখ্যাত পেপার “A Model of Growth Through Creative Destruction” প্রকাশ করেন, যেখানে প্রথমবারের মতো শুম্পেটারের ধারণাকে একটি সম্পূর্ণ গাণিতিক এন্ডোজেনাস গ্রোথ মডেলে পরিণত করা হয়। এই মডেল দেখায় যে, বৃদ্ধির হার নির্ভর করে উদ্ভাবনের হারের ওপর, আর উদ্ভাবনের হার নির্ভর করে বাজারের গঠন, প্রতিযোগিতার মাত্রা এবং একচেটিয়া লাভের সম্ভাবনার ওপর।
জোয়েল মোকির অবদান এসেছে ইতিহাসের দিক থেকে। তিনি দেখিয়েছেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের মূলে ছিল না শুধু বাষ্পীয় ইঞ্জিন বা কারখানা, বরং একটি “জ্ঞানের সংস্কৃতি” যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছিল। তাঁর বই A Culture of Growth (২০১৬) ব্যাখ্যা করে যে, ইউরোপ কেন এশিয়ার চেয়ে এগিয়ে গেল কারণ ইউরোপে বাজার-চালিত উদ্ভাবনের জন্য সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
এই তিনজনের সম্মিলিত কাজ আমাদের বোঝায় যে, দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির জন্য শুধু মূলধন বা শ্রম বাড়ালেই হবে না; দরকার উদ্ভাবনের জন্য সঠিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মেধাস্বত্ব আইন, প্রতিযোগিতা নীতি, শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ এবং বাজারে নতুন প্রবেশকারীদের সুযোগ। আজকের AI, সবুজ প্রযুক্তি ও বায়োটেকনোলজির যুগে এই তত্ত্ব আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
২০২৫-এর এই পুরস্কার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে: যে দেশ উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে, সৃজনশীল ধ্বংসকে ভয় পাবে না, সেই দেশই ভবিষ্যতের অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তাও শুধু কারখানা বাড়ালে হবে না, দরকার স্টার্টআপ, গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় ও উদ্ভাবন-বান্ধব নীতি। নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করছে যে, অর্থনীতি শুধু সংখ্যা নয়, এর মূলে রয়েছে মানুষের সৃজনশীলতা এবং সাহস।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং বিতর্ক
২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা যখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়ল, তখন শুধুমাত্র বিজয়ীদের অবদান নয়, বরং কয়েকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা এবং বিতর্কও এই উৎসবকে ছায়াময় করে তুলল। এই বছরের ঘোষণা প্রক্রিয়ায় যে লিক এবং বাজির ঘটনাগুলো সামনে এল, তা নোবেলের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী গোপনীয়তাকে চ্যালেঞ্জ করল। একই সঙ্গে, ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব সাফল্য এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া এই ঘটনাকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। এই লেখায় আমরা এই উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করব, যা নোবেলের মর্যাদাকে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
প্রথমত, নোবেল পুরস্কারের ঘোষণার সময় ঘটে যাওয়া লিকের ঘটনা সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শান্তি বিভাগের বিজয়ী মারিয়া করিনা ম্যাকাডোর নাম প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা আগে, পলিমার্কেট নামক অনলাইন বেটিং সাইটে তার জয়ের সম্ভাবনা হঠাৎ করে ৩.৭৫% থেকে ৭৩% এ উন্নীত হয়। এই অস্বাভাবিক স্পাইকের ফলে তিনটি অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে প্রায় ৯০,০০০ ডলারের লাভ হয়েছে, যার মধ্যে একটি নতুন অ্যাকাউন্ট 'ডার্টিকাপ' মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ৭০,০০০ ডলার বাজি ধরে ৩০,০০০ ডলার লাভ করে। নরওয়ের নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ক্রিস্টিয়ান বার্গ হার্পভিকেন এটাকে 'অপরাধী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে অভিহিত করেছেন এবং তদন্ত শুরু হয়েছে। নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান জর্গেন ওয়াটনে ফ্রাইডনেস বলেছেন, "আমরা গোপনীয়তা রক্ষায় অত্যন্ত সতর্ক, কিন্তু এই ঘটনা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।" এই লিকের সন্দেহে সাইবার অ্যাটাক বা স্পাইরেজের সম্ভাবনাও উঠে এসেছে, যা নোবেলের ১২৪ বছরের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কেবল আর্থিক লাভের চেষ্টা নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গোপনীয়তার উপর আঘাত।
এই বিতর্কের মধ্যে একটি ইতিবাচক ঘটনা হলো ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া (UC) সিস্টেমের রেকর্ড-ব্রেকিং অবদান। এই বছর মাত্র তিন দিনে UC-অনুসংযুক্ত পাঁচজন বিজ্ঞানী নোবেল জিতেছেন, যা বিশ্বের কোনো একক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সর্বকালের সর্বোচ্চ। ফিজিওলজি অর মেডিসিনে UC স্যান ডিয়েগো এবং UCLA-এর অ্যালামনাস ফ্রেড রামসডেল, ফিজিক্সে UC বার্কলে-র জন ক্লার্ক, UC সান্তা বার্বারা-র জন এম. মার্টিনিস এবং মিশেল এইচ. ডেভোরেট, এবং কেমিস্ট্রিতে UC বার্কলে-র ওমর এম. ইয়াগি। UC প্রেসিডেন্ট জেমস বি. মিলিকেন বলেছেন, "এই অর্জনগুলো আমেরিকান উদ্ভাবনের প্রমাণ, যা ফেডারেল ফান্ডিং-এর উপর নির্ভরশীল।" এটি UC-এর মোট নোবেল সংখ্যাকে ৭৫-এ নিয়ে যায় এবং বিজ্ঞানীদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার ঘটিয়েছে।
এই ঘটনাগুলোর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ছিলো মিশ্রিত কিন্তু তীব্র। মিডিয়ায় নোবেলের ঘোষণা বিস্তারিত কভারেজ পেয়েছে – CNN-এ ম্যাকাডোর জয়কে 'ডেমোক্রেসির জয়' বলা হয়েছে, যখন গার্ডিয়ান লিকের তদন্তকে 'গোপনীয়তার সংকট' হিসেবে তুলে ধরেছে। ট্রাম্পের সমর্থকরা শান্তি পুরস্কারের জন্য তার বাদ পড়াকে 'পলিটিক্যাল বায়াস' বলে সমালোচনা করেছে, যখন ম্যাকাডো ট্রাম্পকে ২০২৬-এর জন্য প্রস্তাবিত করেছেন। ভেনেজুয়েলায় সরকারী মিডিয়া এটাকে উপেক্ষা করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এটাকে 'অনুপ্রেরণামূলক' বলেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এই পুরস্কারগুলোকে 'মানবতার চ্যালেঞ্জের সমাধান' হিসেবে দেখেছে।
সারাংশে, ২০২৫-এর নোবেল বিতর্ক এবং ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বিজ্ঞান এবং শান্তির এই উন্নয়নের পাশাপাশি, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই বছরের ঘটনা নোবেলকে শুধু পুরস্কার নয়, বরং বিশ্বের মিরর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উপসংহার
২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কারগুলো যখন একসঙ্গে দেখি, তখন মনে হয় পৃথিবী যেন একটা ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আর এই ক্রান্তিকালের জন্যই বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তির ক্ষেত্রে যে সব মানুষকে সম্মান জানানো হলো, তাঁরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ভবিষ্যতের বীজ বপন করছেন। এ বছরের নোবেলগুলো শুধু অতীতের সাফল্যের স্বীকৃতি নয়, বরং আগামী দশকগুলোর রোডম্যাপ।
বিজ্ঞানের তিনটি পুরস্কার মেডিসিন, ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি যেন একটা ত্রিভুজ তৈরি করেছে। মেডিসিনের পুরস্কার পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্সের মেকানিজম দেখাল যে, আমাদের শরীর নিজেকে আক্রমণ করতে পারে, আবার নিজেকে রক্ষা করার অসাধারণ ক্ষমতাও রাখে। এই জ্ঞান অটোইমিউন রোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপি পর্যন্ত একটা বিপ্লব ডেকে আনবে। একই সঙ্গে ফিজিক্সের পুরস্কার কোয়ান্টাম সার্কিটের ম্যাক্রোস্কোপিক টানেলিং দেখাল যে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার এখন আর সায়েন্স ফিকশন নয় এটা আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসছে। আর কেমিস্ট্রির MOFs (মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস) কার্বন ক্যাপচার, হাইড্রোজেন স্টোরেজ ও বিষাক্ত গ্যাস শোষণে এমন সমাধান দিচ্ছে যা জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গেম-চেঞ্জার হতে পারে। তিনটি পুরস্কার যেন একই কথা বলছে: মানব সভ্যতা বেঁচে থাকার জন্য যে তিনটি জিনিস সবচেয়ে বেশি দরকার স্বাস্থ্য, শক্তি ও পরিবেশ তার সবকটির চাবিকাঠি এখন আমাদের হাতে এসে গেছে।
লিটারেচারের পুরস্কার যখন লাসজ্লো ক্রাসনাহোরকাইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হলো, তখন অনেকে অবাক হয়েছিলেন। কারণ তিনি কোনো বেস্ট-সেলার লেখক নন, তাঁর বাক্য এত লম্বা যে এক পৃষ্ঠায় শেষ হয় না। কিন্তু সুইডিশ একাডেমি যখন বলল, “অ্যাপোক্যালিপটিক টেররের মাঝে আর্টের শক্তিকে পুনর্বলয়নকারী”, তখন বোঝা গেল আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে ধ্বংসের ভয় প্রতি মুহূর্তে ঘিরে আছে, আর সেই অন্ধকারের মধ্যেও যিনি সৌন্দর্য ও অর্থ খুঁজে পান, তিনিই আজকের দিনের সবচেয়ে বড় শিল্পী। ক্রাসনাহোরকাইয়ের পুরস্কার যেন বলছে বিজ্ঞান যতই সমাধান দিক, মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নগুলো শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের কাছেই ফিরে আসে।
পিস প্রাইজ যখন মারিয়া করিনা ম্যাকাডোর হাতে তুলে দেওয়া হলো, তখন গোটা লাতিন আমেরিকা কেঁদে উঠল। ভেনেজুয়েলায় যেখানে লাখ লাখ মানুষ খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়ায়, যেখানে বিরোধীদলের নেতাদের জেলে পুরে রাখা হয়, সেখানে একজন নারী বছরের পর বছর রাস্তায় নেমে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছেন কোনো অস্ত্র ছাড়া, শুধু ভোট আর কথার অস্ত্র নিয়ে। নোবেল কমিটি বলেছে, “গণতন্ত্রের জ্বালানি জ্বালিয়ে রাখার জন্য”। এই কথাটি শুধু ভেনেজুয়েলার জন্য নয়, গোটা পৃথিবীর জন্য। কারণ ২০২৫ সালে আমরা দেখছি হাঙ্গেরি, তুরস্ক, ব্রাজিল, ফিলিপাইন গণতন্ত্রের আলো ক্রমশ ম্লান হচ্ছে। ম্যাকাডোর পুরস্কার যেন একটা সতর্কবার্তা আর একটা আশার আলো একসঙ্গে।
অর্থনীতির পুরস্কারে ফিলিপ আগিয়ন, পিটার হাউইট ও জোয়েল মোকিরের কাজকে সম্মান জানানো হলো “ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন” ও উদ্ভাবন-চালিত বৃদ্ধির জন্য। এটা যেন বিজ্ঞানের তিনটি পুরস্কারের সঙ্গে মিলে একটা পূর্ণবৃত্ত তৈরি করল। কারণ MOFs, কোয়ান্টাম কম্পিউটার আর ইমিউনোথেরাপি এগুলো সবই একদিন শুধু ল্যাবরেটরিতে থাকবে না, এগুলো অর্থনীতিকে বদলে দেবে, লাখ লাখ নতুন চাকরি তৈরি করবে, পুরনো শিল্পকে ধ্বংস করবে এবং নতুন শিল্প গড়ে তুলবে। আগিয়নরা দেখালেন এই ধ্বংসই সৃষ্টির পথ।
সবশেষে, ২০২৫-এর নোবেল পুরস্কারগুলো আমাদের একটা বার্তা দিচ্ছে: আমরা যতই সংকটে থাকি, মানুষের মেধা, সাহস আর সৌন্দর্যবোধ ততই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একদিকে যেখানে জলবায়ু সংকট, যুদ্ধ আর গণতন্ত্রের পতন আমাদের ঘিরে ধরেছে, ঠিক সেখানেই বিজ্ঞানীরা এমন প্রযুক্তি দিচ্ছেন যা পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে, লেখকরা এমন কথা লিখছেন যা আমাদের মানুষ থাকতে শেখায়, আর সাধারণ মানুষেরা রাস্তায় নেমে দেখিয়ে দিচ্ছেন স্বৈরাচারের সামনে মাথা নোয়ানো যায় না।
এই বছরের নোবেলগুলো শুধু কয়েকজন ব্যক্তির জয় নয়, এটা মানবজাতির জয়। এটা প্রমাণ করে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রশ্ন করতে থাকব, গবেষণা করতে থাকব, লিখতে থাকব আর লড়াই করতে থাকব ততক্ষণ পর্যন্ত আশা আছে। ২০২৫-এর নোবেল পুরস্কারগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অন্ধকার যতই ঘন হয়ে আসুক, মানুষের ভেতরের আলোটা কখনো নিভে যায় না।
রেফারেন্স
- The Nobel Prize in Physiology or Medicine 2025 – NobelPrize.org
- The Nobel Prize in Physics 2025 – NobelPrize.org
- The Nobel Prize in Chemistry 2025 – NobelPrize.org
- The Nobel Prize in Literature 2025 – NobelPrize.org
- The Nobel Peace Prize 2025 – NobelPrize.org
- The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences 2025 – NobelPrize.org
- “Nobel Prize 2025 Announcements” – Associated Press, Reuters, BBC
- “Why 2025 Nobel Prizes Matter” – Nature, Science, The Atlantic
- Nobel Committee Press Releases & Laureate Lectures (নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০২৫)