সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ব্যবহারিক নম্বর কীভাবে গণনা করা হয়

প্রিপারেশন

৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

সরকারি চাকরির পরীক্ষায় লিখিত ও এমসিকিউ পরীক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক পরীক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে প্রকৌশল, স্বাস্থ্য, কারিগরি শিক্ষা, পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ বিভাগ, পেট্রোবাংলা, ব্যাংকের আইটি পদ এবং শিক্ষক নিবন্ধনের মতো পদগুলোতে ব্যবহারিক পরীক্ষা থাকে। অনেক প্রার্থীই জানেন না যে এই ব্যবহারিক নম্বর কীভাবে গণনা করা হয়, কতটুকু ওজন থাকে মেধা তালিকায় এবং কোন কোন ভুলের কারণে নম্বর কাটা যায়। এই লেখায় আমি বিস্তারিতভাবে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ব্যবহারিক নম্বরের গণনা পদ্ধতি, নিয়মকানুন, বিগত বছরের প্র্যাকটিস, বিভিন্ন দপ্তরের ভিন্নতা এবং কিছু অভ্যন্তরীণ তথ্য তুলে ধরব যা অন্য কোনো ব্লগে এভাবে একসাথে পাবেন না।

ব্যবহারিক পরীক্ষা কাদের জন্য বাধ্যতামূলক?

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এবং ননক্যাডার নিয়োগে যেসব পদে ব্যবহারিক পরীক্ষা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল)
  • উপসহকারী প্রকৌশলী
  • সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (পিডব্লিউডি, এলজিইডি, বিদ্যুৎ)
  • মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব, ডেন্টাল, রেডিওগ্রাফার)
  • নার্সিং পদ
  • পুলিশের এএসআই, কনস্টেবল
  • আনসার ভিডিপি
  • রেলওয়ের টিকিট ক্লার্ক, পয়েন্টসম্যান, ওয়েম্যান
  • ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার (আইটি), ডাটা এন্ট্রি অপারেটর
  • শিক্ষক নিবন্ধনের ব্যবহারিক (কারিগরি বিষয়)

এই পদগুলোতে সাধারণত ২০ থেকে ৫০ নম্বরের ব্যবহারিক পরীক্ষা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে ১০০ নম্বরেরও হয়।

ব্যবহারিক নম্বর মোট মেধায় কতটুকু যোগ হয়?

অনেকে মনে করেন ব্যবহারিক পরীক্ষা শুধু যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য। এটা পুরোপুরি ভুল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহারিক নম্বর লিখিত ও এমসিকিউ নম্বরের সাথে যোগ করে মেধা তালিকা করা হয়। কয়েকটি উদাহরণ:

  • পিডব্লিউডি উপসহকারী প্রকৌশলী: এমসিকিউ ১০০ + লিখিত ১০০ + ব্যবহারিক ৫০ = মোট ২৫০
  • বিদ্যুৎ বিভাগের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার: এমসিকিউ ৮০ + ব্যবহারিক ট্রেড ১০০ + ভাইভা ২০
  • রেলওয়ে ওয়েম্যান: লিখিত ১০০ + ব্যবহারিক ৫০ + ভাইভা ৩০
  • শিক্ষক নিবন্ধন (কারিগরি): লিখিত ১০০ + ব্যবহারিক ৫০

অর্থাৎ ব্যবহারিক নম্বর না থাকলে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

ব্যবহারিক নম্বর গণনার মূল নীতি

বাংলাদেশে ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর গণনার জন্য তিন ধরনের পদ্ধতি প্রচলিত:

১. ডাইরেক্ট মার্কিং পদ্ধতিপরীক্ষক সরাসরি প্রার্থীর কাজ দেখে ০ থেকে ১০০ পর্যন্ত নম্বর দেন। যেমন: অটোক্যাডে একটি বিল্ডিং প্ল্যান আঁকা, ল্যাবে রক্ত পরীক্ষা করা।

২. স্টেপ বাই স্টেপ মার্কিংপ্রতিটি কাজকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করে প্রতি ধাপে নম্বর বরাদ্দ থাকে। উদাহরণ: সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেভেলিং করার সময়

  • লেভেল মেশিন সেটআপ: ১৫ নম্বর
  • রিডিং নেওয়া: ২০ নম্বর
  • ক্যালকুলেশন: ১৫ নম্বর
  • বুকিং: ১০ নম্বর
  • ভুলত্রুটি কম: ১০ নম্বর

৩. রিলেটিভ মার্কিং (খুবই গোপনীয় পদ্ধতি)কিছু দপ্তরে (বিশেষ করে পুলিশ, আনসার, রেলওয়ে) সবাইকে প্রথম পরীক্ষক ৭০-৮৫ এর মধ্যে নম্বর দেন। তারপর সবার নম্বর একসাথে নিয়ে সর্বোচ্চ পারফরমারকে ৯৫-৯৮ দেওয়া হয় এবং বাকিদের নম্বর সেই অনুযায়ী স্কেল করা হয়। এটাকে বলা হয় নরমালাইজেশন।

বিভিন্ন দপ্তরের ব্যবহারিক নম্বর গণনার বিশেষ নিয়ম

১. পিডব্লিউডি ও এলজিইডি

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবহারিকে সাধারণত থিওডোলাইট, লেভেল মেশিন, চেইন সার্ভে, প্লেন টেবিল সার্ভে দেওয়া হয়। নম্বর বণ্টন:

  • যন্ত্র সেটআপ ও সেন্টারিং: ২৫%
  • সঠিক রিডিং: ৩৫%
  • হিসাব ও বুকিং: ২৫%
  • সময়ের মধ্যে কাজ শেষ: ১৫%

যদি কেউ ১ মিনিট দেরি করে তবু ৫-৭ নম্বর কাটে।

২. বিদ্যুৎ বিভাগ (পিডিবি, ডেসকো, পাওয়ার গ্রিড)

এখানে ট্রেড কোর্সের ব্যবহারিক ১০০ নম্বরের হয়। তারের জয়েন্ট, মিটার সংযোগ, ট্রান্সফরমার ওয়াইন্ডিং ইত্যাদি। বিশেষ নিয়ম:

  • সেফটি গ্লাভস, হেলমেট, শু পরা না হলে ১০ নম্বর কাটে
  • তারের রং কোড ভুল হলে ১৫-২০ নম্বর কাটে
  • কাজ শেষে ওয়ার্কিং প্লেস পরিষ্কার না করলে ৫ নম্বর কাটে

৩. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান

ব্যাংকের আইটি পদে টাইপিং (ইংরেজি ৩৫ ও বাংলা ২৫ ওপিএম), এমএস ওয়ার্ড, এক্সেল ফর্মুলা, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন থাকে। গণনা পদ্ধতি:

  • টাইপিং: প্রতি ভুলে ০.৫ নম্বর কাটে
  • এক্সেলে VLOOKUP, Pivot Table না পারলে ২০-২৫ নম্বর চলে যায়
  • কেউ যদি ১০০% সঠিকভাবে করে তাকে ৯৮-১০০ দেওয়া হয়

৪. শিক্ষক নিবন্ধন (কারিগরি)

এনটিআরসিএর কারিগরি বিষয়ে ব্যবহারিকে ড্রয়িং, ওয়ার্কশপ প্র্যাকটিস, প্রজেক্ট দেখানো হয়। এখানে দুইজন পরীক্ষক থাকেন। একজন ৪২ আরেকজন ৪৫ দিলে গড় ৪৩.৫ হয়। কিন্তু যদি দুজনের নম্বরের পার্থক্য ১০ এর বেশি হয় তাহলে তৃতীয় পরীক্ষক দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করা হয়।

ব্যবহারিকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার গোপন কৌশল

১. পরীক্ষার আগে যন্ত্রের নাম ও পার্টস মুখস্থ করা২. পরীক্ষকের সাথে সালাম দেওয়া ও কথা কম বলা৩. কাজ শুরুর আগে যন্ত্র চেক করা (লেভেলে বাবল চেক)৪. কাগজে রোল নম্বর বড় করে লেখা৫. কাজ শেষে পরীক্ষককে দেখিয়ে তারপর ছেড়ে আসা৬. পোশাক পরিপাটি রাখা (সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট)৭. সময়ের ৫ মিনিট আগে কাজ শেষ করা

কোন কোন ভুলে সবচেয়ে বেশি নম্বর কাটে?

  • যন্ত্র উল্টো করে বসানো
  • রিডিং নিতে গিয়ে চোখের লেভেল ভুল করা
  • বুকিংয়ে কলম দিয়ে লাইন টানা (পেন্সিল ছাড়া)
  • তারের জয়েন্টে টেপ না লাগানো
  • কম্পিউটারে ফাইল সেভ না করা
  • টাইপিংয়ে বানান ভুল

বিগত বছরের কিছু বাস্তব তথ্য

৩৯তম বিসিএস (পিডব্লিউডি): ব্যবহারিকে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ৪৮/৫০৪০তম ননক্যাডার (রেলওয়ে): যারা ৪৫+ পেয়েছে তারাই চূড়ান্ত হয়েছেবিদ্যুৎ বিভাগ ২০২৩: ট্রেড টেস্টে গড় নম্বর ছিল ৬৮/১০০ব্যাংক এশিয়া আইটি পদ ২০২৪: টাইপিংয়ে ৪০+ না পেলে ভাইভাতে ডাক হয়নি

ব্যবহারিক নম্বর চ্যালেঞ্জ করা যায় কি?

না। পিএসসি ও ননক্যাডার নিয়োগে ব্যবহারিক ও মৌখিক নম্বর পুনর্মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। তাই একবার যে নম্বর দেওয়া হয়েছে তাই ফাইনাল।

শেষ কথা

ব্যবহারিক পরীক্ষা আসলে আপনার বাস্তব দক্ষতার পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় যতই ভালো করুন, ব্যবহারিকে ৫-১০ নম্বর কম পেলে শত শত প্রার্থীর পেছনে চলে যাবেন। তাই যারা সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তারা অবশ্যই নিজ নিজ বিষয়ের ব্যবহারিক প্র্যাকটিস শুরু করুন। কোচিং সেন্টারে গিয়ে হাতে কলমে শিখুন। কারণ এই নম্বর কিনে পাওয়া যায় না, কষ্ট করে অর্জন করতে হয়।

আশা করি এই লেখাটি আপনার ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে। কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন। শুভকামনা রইল।

বিষয় : পড়াশোনার টিপস