চাকরির পরীক্ষায় ব্লাইন্ড রিভিউ পদ্ধতি কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে
— প্রিপারেশন
চাকরির জগতে প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। লক্ষ লক্ষ প্রার্থী একটি পদের জন্য লড়াই করে, কিন্তু অনেক সময় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কিছু প্রার্থী পিছিয়ে পড়ে শুধুমাত্র তাদের নাম, লিঙ্গ, বয়স বা অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্যের কারণে। এখানেই আসে ব্লাইন্ড রিভিউ পদ্ধতির গুরুত্ব। এটি একটি আধুনিক এবং ন্যায়সঙ্গত উপায় যা চাকরির পরীক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করে। এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব এই পদ্ধতি কী, কেন দরকার, কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা-অসুবিধা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে। এটি পড়ে আপনি নিজের চাকরির প্রস্তুতিতে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন।
ব্লাইন্ড রিভিউ পদ্ধতি কী?
ব্লাইন্ড রিভিউ হলো চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি অংশ যেখানে পরীক্ষকরা প্রার্থীর ব্যক্তিগত পরিচয় জানেন না। সাধারণত লিখিত পরীক্ষা বা স্কিল টেস্টের উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় প্রার্থীর নাম, রোল নম্বরের পরিবর্তে একটি কোড নম্বর ব্যবহার করা হয়। এতে পরীক্ষক শুধুমাত্র উত্তরের গুণগত মান দেখেন, কোনো প্রার্থীর পটভূমি বা পরিচয়ের প্রভাব পড়ে না।
এই পদ্ধতি শুধু চাকরির পরীক্ষায় নয়, বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, অর্কেস্ট্রায় সঙ্গীতশিল্পী নিয়োগের সময় পর্দার আড়াল থেকে বাজানো হয় যাতে লিঙ্গ বা চেহারার প্রভাব না পড়ে। চাকরির ক্ষেত্রে এটি প্রার্থীর সিভি, আবেদনপত্র বা উত্তরপত্র থেকে নাম, ছবি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ইত্যাদি লুকিয়ে রাখা হয়। ফলে মূল্যায়ন হয় শুধুমাত্র যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে।
এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো অচেতন পক্ষপাত দূর করা। অচেতন পক্ষপাত বলতে বোঝায় যে আমরা অজান্তেই কোনো প্রার্থীকে তার নাম শুনে বা ছবি দেখে পছন্দ বা অপছন্দ করি। এটি নিয়োগকে অসমান করে তোলে। ব্লাইন্ড রিভিউ এই সমস্যার একটি সহজ সমাধান।
ব্লাইন্ড রিভিউ পদ্ধতির ইতিহাস এবং উৎপত্তি
ব্লাইন্ড রিভিউয়ের ধারণা নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এটি ব্যবহার শুরু হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো অর্কেস্ট্রা নিয়োগ। ১৯৭০ সালের আগে বিশ্বের বড় বড় অর্কেস্ট্রায় প্রায় সবাই পুরুষ ছিলেন। তারপর পর্দার আড়াল থেকে অডিশন নেওয়া শুরু হলে নারীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই পদ্ধতিতে নারীদের নিয়োগের হার ২৫ থেকে ৪৬ শতাংশ বেড়েছে।
চাকরির ক্ষেত্রে এটি প্রথম ব্যবহার হয় কর্পোরেট সেক্টরে। গুগল, ডেলয়েট, বিবিসিের মতো কোম্পানি এটি চালু করে সাফল্য পায়। বাংলাদেশে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় লিখিত উত্তরপত্রে রোল নম্বরের পরিবর্তে বারকোড বা কোড ব্যবহার করে এই পদ্ধতির একটি রূপ দেখা যায়। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তরপত্র স্ক্যান করে কোডিং করা হয় যাতে পরীক্ষক নাম জানেন না। এটি ব্লাইন্ড রিভিউয়ের একটি বাস্তব উদাহরণ।
ব্লাইন্ড রিভিউ কীভাবে কাজ করে?
এই পদ্ধতি কাজ করে ধাপে ধাপে। চলুন বিস্তারিত দেখি:
১. আবেদন জমা দেওয়ার সময়: প্রার্থী সিভি বা আবেদনপত্র জমা দেন। সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাম, ছবি, বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম লুকিয়ে দেয়। শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং যোগ্যতা দেখা যায়।
২. প্রাথমিক স্ক্রিনিং: নিয়োগকারী শুধুমাত্র দক্ষতা দেখে শর্টলিস্ট করেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোডিং জবের জন্য প্রার্থীর কোডিং টেস্টের ফলাফল দেখা হয়, নাম নয়।
৩. লিখিত বা স্কিল টেস্ট: পরীক্ষার উত্তরপত্রে রোল নম্বরের পরিবর্তে র্যান্ডম কোড দেওয়া হয়। পরীক্ষক উত্তর মূল্যায়ন করেন শুধুমাত্র বিষয়বস্তু দেখে।
৪. ইন্টারভিউ পর্যায়: কিছু ক্ষেত্রে ইন্টারভিউও ব্লাইন্ড করা হয়, যেমন ভয়েস মডিউলেটর ব্যবহার করে লিঙ্গ লুকানো। তবে সাধারণত পরিচয় প্রকাশ হয় এই ধাপে।
৫. চূড়ান্ত নির্বাচন: সব ধাপ শেষে সেরা প্রার্থী নির্বাচিত হয়।
বাংলাদেশে বিসিএস বা ব্যাংক নিয়োগে এটি আংশিকভাবে কাজ করে। উত্তরপত্র স্ক্যান করে কোডিং করা হয়, ফলে পরীক্ষক প্রার্থীর নাম বা অন্য তথ্য জানেন না। এতে দুর্নীতি কমে এবং ন্যায়বিচার বাড়ে।
ব্লাইন্ড রিভিউয়ের সুবিধা
এই পদ্ধতির সুবিধা অসংখ্য। প্রথমত, এটি সমান সুযোগ তৈরি করে। নারী, সংখ্যালঘু বা গ্রামীণ প্রার্থীরা যারা সাধারণত পিছিয়ে পড়ে, তারা এতে সুবিধা পায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ব্লাইন্ড রিভিউ চালু হলে নারী নিয়োগ ৩৫ শতাংশ এবং সংখ্যালঘু নিয়োগ ১৬ শতাংশ বাড়ে।
দ্বিতীয়ত, যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হয়। নিয়োগকারী শুধুমাত্র দক্ষতা দেখেন, ফলে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের সুনাম বাড়ে। কর্মীরা দেখেন যে নিয়োগ ন্যায়সঙ্গত, ফলে তাদের মনোবল বাড়ে। চতুর্থত, দুর্নীতি কমে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সুপারিশের প্রভাব থাকে, এটি তা রোধ করে।
এছাড়া, প্রার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়। তারা জানে যে তাদের যোগ্যতাই বিচার হবে, পরিচয় নয়। ফলে আরও বেশি প্রার্থী আবেদন করে, ট্যালেন্ট পুল বড় হয়।
ব্লাইন্ড রিভিউয়ের অসুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ
কোনো পদ্ধতিই নিখুঁত নয়। ব্লাইন্ড রিভিউয়ের কিছু সমস্যা আছে। প্রথমত, এটি শুধুমাত্র প্রাথমিক ধাপে কাজ করে। ইন্টারভিউতে পরিচয় প্রকাশ হলে পক্ষপাত ফিরে আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, কিছু ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট হারিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন প্রার্থীর কর্মজীবনে গ্যাপ থাকলে তা ব্যাখ্যা করার সুযোগ কমে।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়ে। ছোট প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার কেনা কঠিন। চতুর্থত, কখনো কখনো এটি অসুবিধা সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু গ্রুপের জন্য। যেমন, ধনী পরিবারের প্রার্থীরা বেশি অভিজ্ঞতা দেখাতে পারে। পঞ্চমত, সময় বেশি লাগে। স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া ধীর হয়।
বাংলাদেশে এখনও পুরোপুরি চালু নয়। সরকারি পরীক্ষায় আংশিক ব্যবহার হয়, কিন্তু বেসরকারি সেক্টরে কম।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্লাইন্ড রিভিউ
বাংলাদেশে চাকরির পরীক্ষায় পক্ষপাত একটি বড় সমস্যা। বিসিএস, ব্যাংক, সরকারি অফিসে সুপারিশ বা পরিচয়ের প্রভাব থাকে। ব্লাইন্ড রিভিউ এখানে বিপ্লব আনতে পারে। বর্তমানে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তরপত্র কোডিং করা হয়। এতে পরীক্ষক নাম জানেন না। ফলে মেধার ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হয়।
ব্যাংক নিয়োগে এমসিকিউ টেস্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চেক হয়, যা ব্লাইন্ড। কিন্তু সিভি স্ক্রিনিংয়ে এখনও পক্ষপাত আছে। সরকার যদি পুরোপুরি চালু করে, তাহলে নারী এবং গ্রামীণ প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়বে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নারীরা চাকরির আবেদনে ৩০ শতাংশ কম সুযোগ পায় পরিচয়ের কারণে। ব্লাইন্ড রিভিউ এটি বদলে দিতে পারে।
বিশ্বের সফল উদাহরণ
বিশ্বে অনেক সাফল্যের গল্প আছে। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি নিয়োগে ব্লাইন্ড পদ্ধতি চালু হলে সংখ্যালঘু প্রার্থীদের ইন্টারভিউয়ের হার বেড়েছে। ডেলয়েট কোম্পানি এটি চালু করে নারী এবং এথনিক মাইনরিটি নিয়োগ বাড়িয়েছে। ভার্জিন মিডিয়া অ্যাপ্রেন্টিস নিয়োগে দক্ষতা-ভিত্তিক টেস্ট ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে।
বাংলাদেশে যদি বেসরকারি ব্যাংক বা এনজিওগুলো এটি চালু করে, তাহলে কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বাড়বে।
কীভাবে প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নেবেন?
প্রার্থীদের জন্য এটি সুখবর। আপনার ফোকাস থাকবে দক্ষতা বাড়ানোয়। সিভিতে শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা এবং স্কিল হাইলাইট করুন। স্কিল টেস্টের জন্য প্র্যাকটিস করুন। বাংলাদেশে বিসিএস প্রস্তুতিতে লিখিত উত্তরের গুণগত মান বাড়ান। কোনো চিন্তা করবেন না পরিচয় নিয়ে।
ভবিষ্যতে ব্লাইন্ড রিভিউয়ের সম্ভাবনা
ভবিষ্যতে এআই এবং সফটওয়্যারের কল্যাণে এটি আরও সহজ হবে। বাংলাদেশ সরকার যদি ডিজিটাল নিয়োগ প্ল্যাটফর্ম চালু করে, তাহলে সব পরীক্ষায় ব্লাইন্ড রিভিউ সম্ভব। এতে দেশের কর্মসংস্থান আরও ন্যায়সঙ্গত হবে।
উপসংহার
ব্লাইন্ড রিভিউ পদ্ধতি চাকরির পরীক্ষাকে সত্যিকারের মেধা-ভিত্তিক করে তোলে। এটি শুধু একটি প্রক্রিয়া নয়, একটি সামাজিক পরিবর্তন। বাংলাদেশের মতো দেশে এটি চালু হলে লক্ষ লক্ষ যোগ্য প্রার্থী সুযোগ পাবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করুন এটি গ্রহণ করতে। প্রার্থী হিসেবে আপনি দক্ষতা বাড়ান, বাকিটা এই পদ্ধতি দেখবে। আশা করি এই ব্লগ আপনার চাকরির যাত্রায় সহায়ক হবে। মন্তব্যে আপনার মতামত জানান!