বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সিলেকশন গ্রেড কীভাবে নির্ধারণ করা হয়
— প্রিপারেশন
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে “সিলেকশন গ্রেড” একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি কেবল বেতনই নির্ধারণ করে না, বরং পদোন্নতি, পেনশন, ভাতা, আবাসন সুবিধা, গাড়ি সুবিধা, এমনকি অবসরের পরেও যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায় তার সবকিছুই এর ওপর নির্ভর করে। অনেকে মনে করেন সিলেকশন গ্রেড মানে শুধু ১ম শ্রেণি বা ২য় শ্রেণি। আসলে বিষয়টা এত সরল নয়। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সরকার যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তার ভিত্তিতে আজকের এই লেখায় আমি পুরো প্রক্রিয়াটি খোলাসা করব। তথ্যগুলো সরকারি গেজেট, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন এবং সুপ্রিম কোর্টের কয়েকটি রায়ের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে, যা অন্য কোনো ব্লগে এভাবে একত্রে পাওয়া যায় না।
সিলেকশন গ্রেড কী এবং কেন এত জটিল?
সিলেকশন গ্রেড মানে কোনো পদের “মর্যাদা নির্ধারণ”। ১৯৭৭ সালে প্রথম পে কমিশনের পর থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন স্কেলে গ্রেড দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে এসে “সিলেকশন গ্রেড” নামে একটি বিশেষ সুবিধা চালু হয়। তখন বলা হয়, যেসব পদে “নির্বাচনী প্রক্রিয়ার” মাধ্যমে নিয়োগ হয় এবং যাদের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তারা দুই ধাপ উপরের গ্রেড পাবেন। এই নীতি ১৯৯৪ সালে আরও পরিশীলিত হয়।
১৯৯৪ সালের নীতিমালা: মূল ভিত্তি
১৯৯৪ সালের ২৪ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি পরিপত্রে (নং অর্থ/বিধি-৩/৯৩-১৬৭) প্রথমবারের মতো সিলেকশন গ্রেডের সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, চারটি শর্ত পূরণ হলে কোনো পদ সিলেকশন গ্রেড পাবে:
১. পদটি অবশ্যই প্রথম শ্রেণির গেজেটেড হতে হবে।২. নিয়োগের জন্য পিএসসি বা সমমানের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে।৩. পদটির দায়িত্ব “নীতি নির্ধারণী” বা “তত্ত্বাবধায়ক” হতে হবে।৪. পদটি যেন অন্য কোনো সাধারণ ক্যাডারের সঙ্গে তুলনীয় না হয়।
এই চার শর্তের কারণে শুধুমাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, পিএসসি, এটর্নি জেনারেল অফিস) সিলেকশন গ্রেড পায়।
২০০৯ সালের বেতন স্কেল: নতুন মোড়
২০০৯ সালে নতুন বেতন স্কেল চালু হলে সিলেকশন গ্রেডের ধারণা বদলে যায়। এবার আর “দুই ধাপ উপরে” দেওয়া হয় না। বরং গ্রেড ১ থেকে ৫ পর্যন্ত সরাসরি সিলেকশন গ্রেড ঘোষণা করা হয়। তবে পুরোনো যারা ১৯৯৪ সালের নীতিতে সিলেকশন গ্রেড পেয়েছিলেন, তাদের “টাইম স্কেল” হিসেবে দুটি ইনক্রিমেন্ট ধরে রাখা হয়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপকরা এখনো গ্রেড ৪ পান, যদিও নতুন নিয়োগে গ্রেড ৬।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম
স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সিলেকশন গ্রেড নির্ধারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের একটি পরিপত্র (নং ০৫.১৬৭.০১৮.০০.০০.০০১.২০১৭-১৮৭) খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতে বলা হয়:
ক) প্রতিষ্ঠানটির আইন বা প্রবিধানমালায় যদি স্পষ্টভাবে “সিলেকশন গ্রেড” বা “বিশেষ গ্রেড” উল্লেখ থাকে, তবেই তা প্রযোজ্য হবে।খ) শুধুমাত্র বোর্ডের সিদ্ধান্তে বা চেয়ারম্যানের আদেশে সিলেকশন গ্রেড দেওয়া যাবে না।গ) যদি আইনে না থাকে, তাহলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যৌথ অনুমোদন লাগবে।
এই নিয়মের কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পেট্রোবাংলা, বিটিসিএল, বিমানের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তারা সিলেকশন গ্রেড পান না। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে (সোনালী, জনতা, অগ্রণী) ২০১৫ সালের পর থেকে আবার সিলেকশন গ্রেড ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের উদাহরণসহ বিশ্লেষণ
১. বাংলাদেশ ব্যাংক
১৯৯৪ সালের নীতি অনুযায়ী এখনো সিলেকশন গ্রেড চালু। উপব্যবস্থাপক (গ্রেড ৪), যুগ্ম পরিচালক (গ্রেড ৩), উপমহাব্যবস্থাপক (গ্রেড ২)। নতুন যারা যোগ দিচ্ছেন, তাদের গ্রেড ৬ থেকে শুরু, কিন্তু পুরোনোরা টাইম স্কেলে দুই ধাপ উপরে থাকছেন।
২. বিচার বিভাগ
বিচারকদের ক্ষেত্রে ২০১১ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় (৬৪ ডিএলআর) অনুযায়ী জুডিশিয়াল সার্ভিসকে সিলেকশন গ্রেড দেওয়া হয়। সহকারী জজ গ্রেড ৫, সিনিয়র সহকারী জজ গ্রেড ৪, যুগ্ম জেলা জজ গ্রেড ৩।
৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল ২০১৫ সালে আলাদা করা হয়েছে। প্রভাষক গ্রেড ৬, সহকারী অধ্যাপক গ্রেড ৫, সহযোগী অধ্যাপক গ্রেড ৪, অধ্যাপক গ্রেড ৩। এটাও সিলেকশন গ্রেডের সমতুল্য বলে গণ্য হয়।
৪. পিএসসি
পিএসসি’র সদস্যরা গ্রেড ১ পান, পরিচালক গ্রেড ২, উপপরিচালক গ্রেড ৩। এটি সরাসরি সিলেকশন গ্রেড।
৫. এটর্নি জেনারেল অফিস
অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল গ্রেড ২, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল গ্রেড ৩। এটিও ১৯৯৪ সালের নীতির আওতায়।
৬. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকের জিএম গ্রেড ৩, ডিজিএম গ্রেড ৪ পান। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা পান না।
২০২৫ সালের নতুন বেতন স্কেলের সম্ভাব্য চিত্র
২০২৫ সালের মার্চ মাসে নতুন বেতন কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়ার কথা। ইতোমধ্যে যে লিক হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সিলেকশন গ্রেড পুরোপুরি বাতিল করার প্রস্তাব আছে। তার বদলে “স্পেশাল অ্যালাউন্স” বা “প্রফেশনাল অ্যালাউন্স” দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মূল বেতনের ৪০%, বিচারকরা ৫০%, শিক্ষকরা ৩০% অ্যালাউন্স পেতে পারেন। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
কেন অনেক প্রতিষ্ঠান সিলেকশন গ্রেড হারিয়েছে?
২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে সরকার স্পষ্ট করেছে, “সিলেকশন গ্রেড কেবল তখনই প্রযোজ্য হবে যখন প্রতিষ্ঠানের গঠনকালীন আইনে বা প্রবিধানমালায় এটি উল্লেখ থাকবে”। ফলে নতুন যেসব প্রতিষ্ঠান হয়েছে (যেমন এনবিআরের ট্যাক্স ক্যাডার, কাস্টমস ক্যাডার, পুলিশের এসআই থেকে এএসপি) তারা আর সিলেকশন গ্রেড পাচ্ছে না।
সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ রায়সমূহ
১. ২০১১ সালে মাসুদুর রহমান বনাম সরকার মামলায় (৬৪ ডিএলআর) বলা হয়, একই ধরনের দায়িত্ব পালন করলে সমান গ্রেড পাওয়ার অধিকার আছে।২. ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের পক্ষে রায় হয় যে, ১৯৯৪ সালের নীতি এখনো বহাল আছে।৩. ২০২৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মামলায় হাইকোর্ট বলেছে, “অর্থ মন্ত্রণালয় একতরফাভাবে সিলেকশন গ্রেড বাতিল করতে পারবে না”।
উপসংহার
সিলেকশন গ্রেড কোনো সাধারণ বেতন সুবিধা নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও ঐতিহ্যের প্রতীক। যে কয়টি প্রতিষ্ঠান এখনো এই সুবিধা ধরে রেখেছে, তারা আইনি লড়াই, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এবং নীতি নির্ধারণী দায়িত্বের কারণে এটি পেয়েছে। ভবিষ্যতে এই সুবিধা পুরোপুরি বাতিল হলে সরকারি চাকরির আকর্ষণ কিছুটা কমবে, এটা অনেকেই মনে করছেন। তবে সরকারের যুক্তি হলো, সবাইকে একই স্কেলে আনলে বৈষম্য কমবে। এই দ্বন্দ্ব আগামী কয়েক বছরেও থাকবে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সিলেকশন গ্রেডের বিস্তারিত হিস্ট্রি জানতে চান, কমেন্টে লিখুন।
