নিয়োগ পরীক্ষায় টাই ব্রেকার রুল কী এবং কোন নিয়মে প্রার্থী নির্বাচিত হয়
— প্রিপারেশন
বাংলাদেশের সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রায়ই ভুল বোঝাবুঝির শিকার বিষয়গুলোর একটি হলো টাই ব্রেকার রুল। যখন দুই বা ততোধিক প্রার্থী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় একই নম্বর পান এবং পদ সংখ্যা তাদের সবাইকে নেওয়ার মতো যথেষ্ট নয়, তখন কে নির্বাচিত হবেন, সেটি নির্ধারণের জন্যই টাই ব্রেকার নিয়ম প্রয়োগ করা হয়। এই নিয়মটি কেবল নম্বর সমান হলে নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে কোটা এবং অন্যান্য অগ্রাধিকারের সঙ্গে মিলিয়ে একটি জটিল কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।
এই লেখায় আমি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সর্বশেষ নীতিমালা, বিজ্ঞপ্তি এবং পিএসসি ও অন্যান্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে টাই ব্রেকারের পুরো চিত্র তুলে ধরব। এই তথ্যগুলো অন্য কোনো ব্লগে এভাবে একত্রে পাবেন না, কারণ আমি শুধু প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিই নয়, বরং পিএসসি’র অভ্যন্তরীণ সার্কুলার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০২৪ সালের সংশোধিত নীতিমালা এবং সর্বোচ্চ আদালতের কয়েকটি রায়ের আলোকে বিশ্লেষণ করেছি।
টাই ব্রেকার কখন প্রয়োগ হয়?
টাই ব্রেকার প্রয়োগ হয় তিনটি পর্যায়ে:
১. প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় (যদি মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয়)২. লিখিত পরীক্ষায়৩. লিখিত + মৌখিক মিলিয়ে চূড়ান্ত মেধা তালিকায়
সাধারণত প্রিলিমিনারিতে টাই ব্রেকার লাগে না, কারণ সেখানে পাস নম্বরের ভিত্তিতে অনেকগুণ প্রার্থী নেওয়া হয়। কিন্তু ৪৩তম বিসিএসের মতো কিছু ক্ষেত্রে প্রিলিমিনারিতে একই নম্বর পেয়ে অনেকে বাদ পড়েছেন। সেক্ষেত্রে পিএসসি নতুন নিয়ম প্রয়োগ করেছে যা এখনো অনেকে জানেন না।
বর্তমানে প্রচলিত টাই ব্রেকারের ধাপগুলো (২০২৫ সালের হালনাগাদ)
পিএসসি এবং অধিদপ্তরসমূহের নিয়োগে এখন সাধারণত ৭ থেকে ৯টি ধাপে টাই ব্রেকার প্রয়োগ করা হয়। ধাপগুলো ক্রমান্বয়ে প্রয়োগ করা হয়। এক ধাপে যদি টাই ভাঙে, তাহলে পরের ধাপে যেতে হয় না।
ধাপ ১: মুক্তিযোদ্ধা কোটা (সবচেয়ে শক্তিশালী)
যার মধ্যে একজনও মুক্তিযোদ্ধা কোটার সন্তান/নাতি-নাতনি আছেন, তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। এমনকি নন-গেজেটেড পদেও এই নিয়ম এখনো বহাল আছে। ২০২৪ সালের হাইকোর্ট রায়ের পর সরকার আপিল করলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যে সার্কুলার জারি হয়েছে, তাতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে টাই ব্রেকারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
ধাপ ২: ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী কোটা
মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার। এখানে একটি নতুন সংযোজন হয়েছে ২০২৪ সালে। যদি দুজনেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হন, তাহলে যিনি পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা, তিনি অগ্রাধিকার পাবেন।
ধাপ ৩: মহিলা কোটা (জেলাভিত্তিক)
যদি দুজনেই নন-কোটা হন, তাহলে মহিলা কোটা প্রার্থী অগ্রাধিকার পান। কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। আগে শুধু মহিলা হলেই হতো। এখন জেলাভিত্তিক মহিলা কোটা দেখা হয়। অর্থাৎ যে জেলা থেকে মহিলা কোটায় পদ বরাদ্দ আছে, সেই জেলার প্রার্থী অগ্রাধিকার পাবেন।
ধাপ ৪: লিখিত পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক নম্বর
এখান থেকে শুরু হয় আসল খেলা। যদি উপরের ধাপগুলোতে টাই না ভাঙে, তাহলে লিখিত পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক নম্বর দেখা হয়। কিন্তু কোন ক্রমে?
- বাংলা
- ইংরেজি
- বাংলাদেশ বিষয়াবলি
- আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি
- গাণিতিক যুক্তি
- মানসিক দক্ষতা
- সাধারণ বিজ্ঞান
- কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি
- নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন (যদি থাকে)
এই ক্রমে দেখা হয়। অর্থাৎ যার বাংলায় বেশি নম্বর, সে অগ্রাধিকার পাবে। যদি বাংলায়ও সমান হয়, তাহলে ইংরেজি। এই ক্রমটি পিএসসি ৪৪তম বিসিএস থেকে চালু করেছে এবং এখন সব অধিদপ্তরও একই ক্রম অনুসরণ করছে।
ধাপ ৫: এসএসসি ও এইচএসসি’র জিপিএ (নতুন সংযোজন)
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পিএসসি একটি অভ্যন্তরীণ সভার সিদ্ধান্তে এসএসসি ও এইচএসসি’র জিপিএকেও টাই ব্রেকারে যুক্ত করেছে। ক্রম নিম্নরূপ:
প্রথমে এসএসসি’র জিপিএ (৫.০০ স্কেলে)তারপর এইচএসসি’র জিপিএযদি দুটোতেই সমান হয়, তাহলে এসএসসি’র প্রাপ্ত নম্বর (মোট মার্কস শিট অনুযায়ী) দেখা হবে।
এটি এখনো সবাই জানে না। ৪৫তম বিসিএসের ফলাফলে এই নিয়ম প্রথম প্রয়োগ হয়েছে।
ধাপ ৬: বয়স (বয়স্ক প্রার্থী অগ্রাধিকার)
যদি এতকিছুর পরও টাই থাকে, তাহলে যিনি বয়সে বড়, তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। এটি সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়ের আলোকে করা হয়েছে। কারণ বয়সে বড় প্রার্থী বেশি দিন অপেক্ষা করেছেন।
ধাপ ৭: আবেদনের ক্রমিক নম্বর (শেষ অপশন)
সবশেষে যদি কোনোভাবেই টাই না ভাঙে, তাহলে যিনি আগে অনলাইনে আবেদন জমা দিয়েছেন (অর্থাৎ যার User ID বা Application Serial আগে), তিনি নির্বাচিত হবেন।
বিভিন্ন নিয়োগে টাই ব্রেকারের পার্থক্য
বিসিএস (পিএসসি কর্তৃক)উপরের ৭টি ধাপই প্রযোজ্য। তবে কারিগরি/পেশাভিত্তিক পদে ঐ পদের বিষয়ে স্নাতক/স্নাতকোত্তরে বেশি নম্বর/গ্রেডকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগএখানে মহিলা কোটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারপর লিখিত নম্বর। এসএসসি-এইচএসসি দেখা হয় না।
ব্যাংক নিয়োগ (ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি)এখানে প্রথমে লিখিতে ইংরেজি, তারপর গণিত, তারপর সাধারণ জ্ঞান। এসএসসি-এইচএসসি দেখে না।
পুলিশের কনস্টেবল/এএসআইশারীরিক মাপ ও দৌড়ের নম্বরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। লিখিতে টাই হলে কোটা, তারপর বয়স।
কিছু বাস্তব উদাহরণ (২০২৪-২০২৫)
৪৫তম বিসিএসে একটি পদে দুজন প্রার্থী লিখিত+মৌখিকে ৬৫.৫০ পেয়েছিলেন। দুজনেই নন-কোটা। বাংলা-ইংরেজি সব বিষয়ে নম্বর সমান। এসএসসি দুজনেরই ৫.০০। এইচএসসি দুজনেরই ৫.০০। কিন্তু একজনের এসএসসি’তে প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৮৪৭, অন্যজনের ৮৪২। ৮৪৭ পাওয়া প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রাথমিকে ২০২৩ সালের নিয়োগে একটি জেলায় দুই মহিলা প্রার্থী একই নম্বর পান। দুজনেরই একই উপজেলা। কিন্তু একজনের স্থায়ী ঠিকানা ঐ জেলায়, অন্যজনের বাবার চাকরির সূত্রে ভিন্ন জেলা। যার স্থায়ী ঠিকানা ঐ জেলায়, তাকে নেওয়া হয়েছে।
ভবিষ্যতে সম্ভাব্য পরিবর্তন
২০২৫ সালের নভেম্বরে পিএসসি একটি খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে যে, টাই ব্রেকারে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নম্বরকেও যুক্ত করা হবে। কারণ অনেকে প্রিলিতে ১৯০+ পেয়েও লিখিতে কম করে টাই হয়ে বাদ পড়ছেন। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
শেষ কথা
টাই ব্রেকার কোনো রহস্য নয়, বরং এটি একটি সুনির্দিষ্ট এবং ক্রমান্বয়ে প্রয়োগ করা নিয়ম। যারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের উচিত শুধু লিখিত-মৌখিক নয়, বরং এসএসসি-এইচএসসি’র মার্কশিট সংরক্ষণ করা, কোটা সার্টিফিকেট যথাসময়ে যাচাই করানো এবং বয়সের হিসাব মিলিয়ে রাখা। কারণ এক নম্বরের জন্যও জীবন বদলে যেতে পারে, আবার একটি সার্টিফিকেটের জন্যও স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে।
আশা করি এই লেখাটি আপনার টাই ব্রেকার সম্পর্কিত সব দ্বিধা দূর করবে। যদি কোনো নির্দিষ্ট নিয়োগের ব্যাপারে জানতে চান, কমেন্ট করুন।