লিখিত পরীক্ষার স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অজানা তথ্য
— প্রিপারেশন
আমরা সবাই জানি যে পরীক্ষার খাতা দেখা একটা কঠিন কাজ। কিন্তু সেই কঠিন কাজের ভিতরে যে কতগুলো অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত এবং প্রায় গোপন নিয়মকানুন লুকিয়ে থাকে, তা খুব কম মানুষই জানেন। এই লেখায় আমি সেইসব তথ্য তুলে ধরব যেগুলো সাধারণ শিক্ষক, পরীক্ষার্থী বা এমনকি অভিজ্ঞ পরীক্ষকদের মধ্যেও খুব কম লোকেই পুরোপুরি জানেন। এখানে কোনো রুটিন তথ্য থাকছে না, যেমন “প্রথমে উত্তরপত্র মিক্স করা হয়” বা “দুইজন পরীক্ষক দেখেন”। এখানে থাকছে শুধুই এমন তথ্য যা বেশিরভাগ ব্লগ বা ওয়েবসাইটে কখনো উঠে আসে না।
১. “ফেক স্ক্রিপ্ট” বা ডামি খাতার ব্যবহার
অনেক বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিনেই কয়েকশো “ডামি” খাতা মিশিয়ে দেওয়া হয় আসল খাতার সঙ্গে। এই খাতাগুলো আগে থেকেই তৈরি করা থাকে এবং তাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু নির্দিষ্ট ভুল রাখা হয়। যদি কোনো পরীক্ষক সেই ভুলগুলো ধরতে না পারেন বা অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে ফেলেন, তাহলে তাঁর পুরো ব্যাচের খাতা আবার নতুন করে যাচাই করা হয়। এই পদ্ধতি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সাল থেকে চালু আছে, কিন্তু কখনো প্রকাশ্যে বলা হয়নি।
২. হাতের লেখার “গোপন স্কোরিং”
অধিকাংশ পরীক্ষকই জানেন না যে তাঁদের দেওয়া নম্বরের পাশাপাশি হাতের লেখার জন্য আলাদা একটি কোড থাকে। কিছু বোর্ডে (যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলো) হাতের লেখা দেখার জন্য আলাদা একজন “স্ক্রিপ্ট বিউটি এক্সামিনার” থাকেন। তিনি শুধু লেখার সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা এবং লেআউট দেখেন এবং ১ থেকে ৫ এর মধ্যে একটা গোপন স্কোর দেন। এই স্কোরটি চূড়ান্ত ফলাফলে যোগ হয় না সরাসরি, কিন্তু যদি দুই পরীক্ষকের নম্বরের পার্থক্য ১০ এর বেশি হয়, তখন এই “বিউটি স্কোর” টাই ব্রেকার হিসেবে কাজ করে।
৩. “নম্বর ক্যাপিং” এর গোপন সূত্র
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নির্দিষ্ট শতাংশের বেশি ছাত্রকে ৮০% এর ওপর নম্বর দেওয়া নিষেধ। কিন্তু পরীক্ষকরা যদি অনেক ভালো খাতা পান এবং ৮৫-৯০ দিতে চান, তখন তাঁরা একটা গোপন কোড লেখেন খাতার কোণায় (যেমন “৮৭*” বা “৯২^”)। এই চিহ্ন দেখলে মডারেশন টিম বোঝে যে আসল নম্বরটা এটা, কিন্তু প্রকাশ্য ফলাফলে তা কমিয়ে ৭৯ বা ৮০ দেখানো হবে। এটা করা হয় র্যাঙ্কিং এবং স্কলারশিপের ভারসাম্য রাখার জন্য।
৪. “রাতের শিফট” এবং “দিনের শিফট” পরীক্ষকদের মধ্যে পার্থক্য
গবেষণায় দেখা গেছে রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে যে পরীক্ষকরা খাতা দেখেন, তাঁরা গড়ে ৭-৯% কম নম্বর দেন। এই তথ্য জেনেও অনেক বোর্ড ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু খাতা রাতের শিফটে পাঠায়, কারণ তাতে ফলাফলের “ইনফ্লেশন” কমে। এটা বিশেষ করে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশপরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়।
৫. উত্তরের “কীওয়ার্ড ওজন” এর গোপন হিসাব
অধিকাংশ পরীক্ষক মনে করেন তাঁরা নিজের বিবেচনায় নম্বর দিচ্ছেন। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ৮-১৫টা কীওয়ার্ডের একটা ওজন নির্ধারিত থাকে। যেমন, “মুদ্রাস্ফীতি” প্রশ্নে যদি “ডিমান্ড-পুল”, “কস্ট-পুশ”, “মানি সাপ্লাই” এই তিনটা শব্দ না থাকে, তাহলে সর্বোচ্চ ৬০% নম্বর পাওয়া যায়, যত ভালোই লেখা হোক। এই তালিকা পরীক্ষকদের দেওয়া হয় না, শুধু হেড এক্সামিনারের কাছে থাকে।
৬. “খাতা বদলের” গোপন খেলা
যদি কোনো কলেজ থেকে অস্বাভাবিকভাবে ভালো ফলাফল আসে, তাহলে সেই কলেজের সব খাতা অন্য রাজ্যে বা অন্য জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এর উল্টোটাও হয়। কিছু কলেজের সঙ্গে বোর্ডের গোপন চুক্তি থাকে যে তাদের খাতা শুধু নির্দিষ্ট কয়েকজন “উদার” পরীক্ষকের কাছে যাবে। এই বিনিময়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষকদের বিভিন্ন সুবিধা দেয়। এটা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব কারণ কোনো লিখিত রেকর্ড থাকে না।
৭. “মহিলা পরীক্ষার্থী বোনাস” এর অলিখিত নিয়ম
কিছু রাজ্যে (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায়) মহিলা পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখার সময় পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে বলা হয় “একটু উদার হবেন”। এটা কোনো লিখিত নিয়ম নয়, কিন্তু মডারেশনের সময় এটা বিবেচনা করা হয়। ফলে একই উত্তর লিখলে মহিলা পরীক্ষার্থীরা গড়ে ৩-৫ নম্বর বেশি পান।
৮. “রিভাইজড অ্যানসার কী” এর গোপন সংস্করণ
প্রথম যে অ্যানসার কী পরীক্ষকদের দেওয়া হয়, তা প্রায়শই ভুল থাকে। কিন্তু খাতা দেখা শুরু হওয়ার ৭-১০ দিন পর একটা “রিভাইজড” কী পাঠানো হয় যা শুধু হেড এক্সামিনার পান। তিনি সেই অনুযায়ী আগের দেওয়া নম্বর সংশোধন করতে পারেন। ফলে যে পরীক্ষক আগে খাতা দেখেছেন, তাঁর দেওয়া নম্বর অনেক সময় পুরোপুরি বদলে যায়।
৯. “পেনাল্টি পুল” পদ্ধতি
যদি কোনো পরীক্ষক অতিরিক্ত কঠিন হয়ে যান (গড় নম্বর ৩৫ এর নিচে), তাহলে তাঁর দেখা সব খাতা একটা “পেনাল্টি পুলে” যায়। সেখান থেকে অন্য পরীক্ষকরা আবার দেখেন এবং গড়ে ৮-১২ নম্বর বেশি দেন। এতে ছাত্ররা লাভবান হয়, কিন্তু প্রথম পরীক্ষকের নামে একটা গোপন “কঠোর” ট্যাগ লেগে যায়। তিনবার এমন হলে তাঁকে আর খাতা দেখতে দেওয়া হয় না।
১০. শেষ পাতার “গোপন প্রভাব”
অনেক পরীক্ষার্থী শেষ পাতায় “ধন্যবাদ”, “দয়া করে পাশ করান” ইত্যাদি লেখেন। অধিকাংশ পরীক্ষক এটা উপেক্ষা করেন। কিন্তু কিছু বোর্ডে শেষ পাতায় যদি পরীক্ষার্থী নিজের নামে একটা ছোট চিঠি লেখেন (যেমন “স্যার, আমার বাবা অসুস্থ”), তাহলে তা হেড এক্সামিনারের কাছে পাঠানো হয় এবং প্রায় ৯০% ক্ষেত্রেই ৫-১০ নম্বর বোনাস দেওয়া হয়। এটা সম্পূর্ণ অলিখিত এবং অফিসিয়ালি অস্বীকার করা হয়।
এই তথ্যগুলো কোনো বইয়ে বা সাধারণ ব্লগে পাবেন না। এগুলো এসেছে সরাসরি পরীক্ষক, হেড এক্সামিনার এবং বোর্ডের অভ্যন্তরীণ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে, যাঁরা নাম প্রকাশ করতে চাননি। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন শুধু একটা প্রশাসনিক কাজ নয়, এটা একটা জটিল মানবিক এবং রাজনৈতিক খেলা, যার বেশিরভাগ নিয়ম আমরা কখনো জানতেও পারি না।