এমসিকিউ পরীক্ষায় নেগেটিভ মার্কিং থাকলে নিরাপদ স্কোরিং কৌশল

প্রিপারেশন

৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

এমসিকিউ বা মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন ভিত্তিক পরীক্ষা এখন প্রায় সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রধান অংশ। মেডিকেল ভর্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি, বিসিএস, ব্যাংক, প্রাইমারি শিক্ষক নিবন্ধন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় নেগেটিভ মার্কিং থাকার কারণে লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থী প্রতি বছর আতঙ্কে ভোগেন। অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীও শুধুমাত্র ভুল কৌশলের জন্য নিজের প্রাপ্য সিট হারান। এই লেখায় আমি এমন কিছু বাস্তবসম্মত, পরীক্ষিত এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব কৌশল শেয়ার করব যেগুলো আমি নিজে এবং আমার ছাত্ররা গত দশ বছরে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছি। এই কৌশলগুলো আপনি কোথাও অন্য ব্লগে একসাথে পাবেন না।

নেগেটিভ মার্কিংয়ের মানসিক খেলা বোঝা

নেগেটিভ মার্কিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে মনের ওপর। যখন আপনি জানেন একটা ভুলের জন্য নম্বর কাটবে, তখন মস্তিষ্কে দুটো বিপরীত চিন্তা চলতে থাকে। একদিকে লোভ, আরেকদিকে ভয়। লোভ বলে, “যদি ঠিক হয় তাহলে তো লাভ!” ভয় বলে, “যদি ভুল হয় তাহলে তো পিছিয়ে পড়ব।” এই দুই শক্তির মধ্যে যে ছাত্র নিজেকে স্থির রাখতে পারে, সেই জিতে।

প্রথম কৌশল: পরীক্ষা শুরুর আগের রাতে একটা কাগজে লিখে নিন, “আমি যতগুলো প্রশ্ন ১০০% নিশ্চিত, শুধু সেগুলোই দেব। বাকিগুলো আমার ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেব।” এই লাইনটা ১০ বার লিখুন। এটা অদ্ভুত শোনালেও এটা আপনার মস্তিষ্ককে প্রোগ্রাম করবে যে আপনি লটারি খেলতে আসেননি, স্কিল দেখাতে এসেছেন।

পরীক্ষার হলে প্রথম ৭ মিনিটের গোল্ডেন রুল

পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর প্রথম যে ভুলটা সবাই করে তা হলো তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন দেখতে শুরু করা। আমার ছাত্রদের আমি বলি, প্রথম ৭ মিনিট কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। কেবল প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে পুরোটা একবার চোখ বুলিয়ে নিন এবং মনে মনে তিন ধরনের ট্যাগ লাগান।

১. নিশ্চিত ট্যাগ (যেগুলো দেখামাত্র উত্তর মনে পড়ে গেছে)২. সম্ভাব্য ট্যাগ (২ মিনিট চিন্তা করলে উত্তর বের করা যাবে)৩. অন্ধকার ট্যাগ (একদম আইডিয়া নেই)

এই ট্যাগিং মাথার ভেতর করবেন, কাগজে লিখবেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা এই প্রথম স্ক্যানিং করে তারা গড়ে ১২-১৮টা বেশি নিশ্চিত প্রশ্ন পায়। কারণ মস্তিষ্কটা প্রশ্নগুলোর প্যাটার্ন বুঝে ফেলে এবং পরে যখন আবার সেই প্রশ্নে আসেন তখন উত্তর মনে পড়ে যায়।

তিন সার্কেল মেথড: আমার সবচেয়ে সফল কৌশল

আমি আমার ছাত্রদের তিন সার্কেল মেথড শিখাই। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের তৈরি করা। ওএমআর শিটের এক কোনায় তিনটা ছোট সার্কেল আঁকুন।

প্রথম সার্কেল: ১০০% নিশ্চিত প্রশ্নের সংখ্যাদ্বিতীয় সার্কেল: ৭০-৯০% নিশ্চিত প্রশ্নের সংখ্যাতৃতীয় সার্কেল: ৫০% বা তার কম নিশ্চিত প্রশ্নের সংখ্যা

প্রতিটি প্রশ্ন করার পর ওএমআর শিটের পাশে ছোট একটা চিহ্ন দিয়ে এই তিন সার্কেলের মধ্যে কোনটায় পড়ছে তা ট্র্যাক করুন। যখন পরীক্ষার শেষ ৩০ মিনিট বাকি থাকবে, তখন দেখবেন প্রথম সার্কেলে কতগুলো হয়েছে। সেটাই আপনার নিরাপদ স্কোর। এই পদ্ধতিতে আপনি রিয়েল টাইমে বুঝতে পারবেন কতটা রিস্ক নেওয়া যাবে।

উদাহরণ: ধরুন পরীক্ষায় মোট ১০০টা প্রশ্ন, প্রতি সঠিক উত্তর ১, ভুলের জন্য ০.২৫ কাটবে। আপনার প্রথম সার্কেলে ৫৫টা হয়েছে। তাহলে আপনার নিরাপদ স্কোর ৫৫। এখন দ্বিতীয় সার্কেলের প্রশ্নগুলো করতে পারেন। কারণ ধরে নিলেও যদি ৭০% ঠিক হয়, তাহলেও আপনার স্কোর হবে ৫৫ + ১৪ = ৬৯। এটা অনেক বেশি নিরাপদ।

এলিমিনেশন টেকনিকের গোপন স্তর

সবাই জানে এলিমিনেশন করতে হয়। কিন্তু আমি আমার ছাত্রদের পাঁচ স্তরের এলিমিনেশন শিখাই।

স্তর ১: যে অপশনগুলো একদম অসম্ভব, সেগুলো কাটুন।স্তর ২: যে অপশনগুলো প্রশ্নের সাথে সম্পর্কহীন, কাটুন।স্তর ৩: যে অপশনগুলো অতিরিক্ত জটিল বা অতিরিক্ত সরল, সেগুলো সন্দেহ করুন।স্তর ৪: বাকি দুটি অপশনের মধ্যে যেটা বেশি বার পড়েছেন বা শুনেছেন, সেটা বেছে নিন।স্তর ৫: তবুও যদি দ্বিধা থাকে, প্রশ্নের মূল শব্দটা দেখুন। সাধারণত সঠিক উত্তরে সেই শব্দটা থাকে।

আমার এক ছাত্র ২০২৩ সালের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় এই পদ্ধতিতে ৪২টা প্রশ্ন করেছিল যেগুলোতে সে ৫০-৬০% নিশ্চিত ছিল। তার মধ্যে ৩৮টা ঠিক হয়েছিল। সে সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।

সময়ের ভাগাভাগি: ৪০-৪০-২০ রুল

পরীক্ষার মোট সময়কে তিন ভাগে ভাগ করুন।

প্রথম ৪০%: শুধু নিশ্চিত প্রশ্নগুলো করুন এবং ওএমআর ফিল করুন।দ্বিতীয় ৪০%: সম্ভাব্য প্রশ্নগুলো করুন। এলিমিনেশন করুন।শেষ ২০%: যেগুলো একদম অন্ধকার ছিল, সেগুলোর মধ্যে যেগুলোর দুটো অপশন কাটতে পেরেছেন, সেগুলো দিন।

এই রুলে কখনো শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো হয় না। আমি নিজে ২০১৫ সালের বিসিএস পরীক্ষায় এই রুল ফলো করে ১৫ মিনিট আগে শেষ করেছিলাম এবং ৮৭% সঠিক উত্তর দিয়েছিলাম।

বিষয়ভিত্তিক রিস্ক ম্যানেজমেন্ট

সব বিষয়ে একই রিস্ক নেওয়া উচিত নয়। যে বিষয়ে আপনার দখল বেশি, সেখানে ৬০% নিশ্চয়তাতেও উত্তর দিতে পারেন। যে বিষয়ে দখল কম, সেখানে ৯০% না হলে ছোঁবেন না।

উদাহরণ: ধরুন আপনার ফিজিক্স খুব ভালো, বাংলা মোটামুটি, আর জীববিজ্ঞান দুর্বল। তাহলে ফিজিক্সে ৫৫-৬০% নিশ্চিত হলেও দিন, কিন্তু জীববিজ্ঞানে ৯০% না হলে দেবেন না। আমার এক ছাত্রী এই নিয়ম ফলো করে ২০২৪ সালের ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় ১৬৮ পেয়ে বুয়েটে চান্স পেয়েছে, অথচ তার জীববিজ্ঞানে মাত্র ১২টা প্রশ্ন করেছিল।

মানসিক প্রস্তুতির গোপন অস্ত্র

পরীক্ষার আগের দিন ৩০টা এমসিকিউ প্রশ্ন নিয়ে বসুন। নেগেটিভ মার্কিং ধরে হিসাব করুন। ইচ্ছাকৃতভাবে ১০টা প্রশ্ন ভুল করুন এবং দেখুন কত নম্বর কাটে। তারপর আবার সেগুলো ঠিক করে দেখুন কত বাড়ে। এই ব্যায়াম আপনাকে মানসিকভাবে এতটাই শক্ত করবে যে পরীক্ষার হলে আর ভয় লাগবে না।

আরেকটা কৌশল: পরীক্ষার আগের রাতে একটা কাগজে লিখুন, “আমি যত নম্বর পাব, তা আমার প্রাপ্য। বেশি পাওয়ার জন্য আমি নিজের সাথে প্রতারণা করব না।” এটা পড়ে ঘুমান। পরদিন মাথা একদম ঠান্ডা থাকবে।

শেষ ১৫ মিনিটের জাদু

অধিকাংশ ছাত্র শেষ ১৫ মিনিটে প্যানিক করে যা ইচ্ছা তাই দেয়। আমি বলি, শেষ ১৫ মিনিটে কেবল তিন ধরনের প্রশ্ন করবেন:

১. যেখানে দুটো অপশন কাটতে পেরেছেন (৫০% চান্স)২. যে প্রশ্নগুলো আগে করা হয়নি কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে উত্তর জানা আছে৩. যে প্রশ্নে একটা অপশন বারবার চোখে পড়ছে (মস্তিষ্কের অবচেতন সিগন্যাল)

এই তিন ক্যাটাগরির বাইরে কিছু করবেন না। আমার ছাত্ররা এই নিয়মে শেষ ১৫ মিনিটে গড়ে ৮-১২ নম্বর বাড়িয়েছে।

পরীক্ষার পর কী করবেন

পরীক্ষা শেষে কারো সাথে উত্তর মিলাবেন না। এটা আপনার মানসিক শান্তি নষ্ট করবে। বাড়ি গিয়ে একটা ডায়েরিতে লিখুন কতগুলো নিশ্চিত ছিল, কতগুলো রিস্ক নিয়েছেন। পরবর্তী পরীক্ষায় সেই ডেটা কাজে লাগবে।

এই কৌশলগুলো যদি আপনি আন্তরিকভাবে প্রয়োগ করেন, তাহলে নেগেটিভ মার্কিং আপনার জন্য আর ভয়ের কারণ থাকবে না। বরং এটা হবে আপনার প্রতিযোগীদের থেকে এগিয়ে যাওয়ার অস্ত্র। আমি গত দশ বছরে হাজারো ছাত্রকে এই পদ্ধতি শিখিয়েছি। যারা মানছে, তারা সাফল্য পাচ্ছে।

শুভকামনা রইল। আপনার পরবর্তী পরীক্ষায় নিরাপদ এবং সর্বোচ্চ স্কোর হোক।

বিষয় : পড়াশোনার টিপস