বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট কীভাবে তৈরি হয়
— প্রিপারেশন
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট বা চারিত্রিক ও পূর্বতন কর্মস্থল যাচাই প্রতিবেদন। অনেকে একে সংক্ষেপে “পুলিশ ক্লিয়ারেন্স” বা “ভেরিফিকেশন রিপোর্ট” বলে থাকেন। এই প্রতিবেদনটি কেবল একটি কাগজের টুকরো নয়, বরং রাষ্ট্রের কাছে এটি একজন ব্যক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মূল্যায়নের চূড়ান্ত দলিল।
অনেক চাকরিপ্রার্থী এই প্রক্রিয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। কারণ তারা জানেন না আসলে কী হয়, কতদিন লাগে, কী কী বিষয় খতিয়ে দেখা হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, রিপোর্ট কীভাবে তৈরি হয়। এই লেখায় আমি ২০২৫ সালের হালনাগাদ প্রক্রিয়া, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি, গোপনীয়তার স্তর, ফিল্ড লেভেলের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং যেসব বিষয় সাধারণত কেউ লেখে না, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভেরিফিকেশন রিপোর্ট আসলে কী?
এটি মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
১. পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট (স্পেশাল ব্রাঞ্চ কর্তৃক)২. গোয়েন্দা ভেরিফিকেশন রিপোর্ট (এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবি’র যৌথ বা পৃথক প্রতিবেদন)
প্রথম শ্রেণির চাকরি (বিসিএস ক্যাডার, ব্যাংক অফিসার, পুলিশ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি) থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত সবার ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো ধরনের ভেরিফিকেশন হয়। তবে গভীরতা এবং সংস্থা ভিন্ন হয়।
প্রক্রিয়ার শুরু: ফর্ম জমা থেকে রেজিস্ট্রেশন
চাকরিপ্রার্থী যখন নির্বাচিত হন, তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকে একটি ভেরিফিকেশন ফর্ম দেওয়া হয়। এই ফর্মে থাকে:
- বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা
- শিক্ষাগত যোগ্যতা
- পূর্বতন চাকরির বিবরণ (যদি থাকে)
- তিনজন রেফারির নাম (কখনো কখনো)
- নিজের হাতে লেখা ১২-১৬ পৃষ্ঠার জীবনবৃত্তান্ত (বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারদের ক্ষেত্রে)
এই ফর্মের সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, শিক্ষাগত সার্টিফিকেটের কপি জমা দিতে হয়। ২০২৪ সাল থেকে অনেক মন্ত্রণালয় অনলাইনে এই ফর্ম পূরণের ব্যবস্থা চালু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে pv.ms.gov.bd পোর্টালে সরাসরি আপলোড করা যায়।
স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাজ শুরু
ফর্ম জমা পড়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে তা স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) পাঠানো হয়। এসবির প্রধান কার্যালয় মালিবাগে। এখানে একটি ডেডিকেটেড “ভেরিফিকেশন সেল” আছে।
প্রথম ধাপ: ডাটাবেজ চেকএসবির কাছে দেশের সব থানায় যত মামলা হয়েছে তার ডিজিটাল ডাটাবেজ আছে। এছাড়া জিডি, এফআইআর, চার্জশিট, রাজনৈতিক মামলা, মাদক মামলা, জঙ্গি তৎপরতা সংক্রান্ত সব তথ্য আপডেট থাকে। আপনার নাম, পিতার নাম, ঠিকানা দিয়ে প্রথমে এই ডাটাবেজে সার্চ করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: থানা লেভেলে তদন্তযেসব থানায় আপনি কোনোদিন বসবাস করেছেন বলে ফর্মে উল্লেখ করেছেন, সেসব থানায় চিঠি পাঠানো হয়। থানার একজন এসআই বা এএসআই আপনার বাড়িতে যান। এই সময় যা যাচাই করা হয়:
- আপনি সত্যিই সেই বাড়িতে থাকতেন কি না
- আপনার চরিত্র কেমন (প্রতিবেশীদের মতামত নেওয়া হয়)
- কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন কি না
- রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় কি না (বিশেষ করে যদি ছাত্র রাজনীতি করে থাকেন)
- মাদকাসক্ত বা জুয়াড় কি না
অনেকে মনে করেন থানার পুলিশ শুধু বাড়িতে গিয়ে সই নিয়ে আসে। আসলে তারা গোপনে প্রতিবেশী, দোকানদার, স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারের সঙ্গে কথা বলেন।
গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা
যেসব পদে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেশি (প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, পুলিশ, ব্যাংকের নির্বাহী পদ), সেখানে এসবি’র রিপোর্টের পাশাপাশি এনএসআই ও ডিজিএফআই থেকেও রিপোর্ট নেওয়া হয়।
এনএসআই যা খতিয়ে দেখে:
- বিদেশে যাতায়াতের ইতিহাস
- বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক
- সামাজিক মাধ্যমে কট্টর মতাদর্শ প্রচার
- পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিচয়
ডিজিএফআই মূলত সামরিক বাহিনীর চাকরিতে বেশি সক্রিয়। তারা প্রার্থীর পুরো বংশ পরিচয় পর্যন্ত খতিয়ে দেখে।
পূর্বতন কর্মস্থল যাচাই
যদি আপনার আগে কোনো চাকরি থাকে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠানো হয়। জানতে চাওয়া হয়:
- আপনি কবে যোগদান করেছিলেন, কবে ছেড়েছেন
- শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো অভিযোগ ছিল কি না
- বেতন কেমন ছিল
- চাকরি ছাড়ার কারণ কী ছিল
অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি ছেড়ে আসেন। এখানে ধরা পড়ে যায়।
সবচেয়ে গোপন অংশ: লাইফস্টাইল চেক
বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে যারা যোগ দিচ্ছেন, তাদের লাইফস্টাইল চেক করা হয়। অর্থাৎ:
- আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি কি না
- বিলাসবহুল গাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে কি না
- কোনো বিতর্কিত ব্যবসায় জড়িত কি না
- নারীঘটিত কেলেঙ্কারি আছে কি না
এই তথ্য সংগ্রহ করতে অনেক সময় গোয়েন্দা সংস্থা সাদা পোশাকে তদন্ত করে।
রিপোর্ট তৈরির ধাপসমূহ (বাস্তব চিত্র)
১. এসবি’র প্রধান কার্যালয়ে ফাইল ওপেন হয়২. ডাটাবেজ চেকিং (১-৩ দিন)৩. সংশ্লিষ্ট থানায় চিঠি পাঠানো৪. থানা থেকে প্রতিবেদন আসতে ১৫-৪৫ দিন লাগে৫. গোয়েন্দা রিপোর্ট (যদি লাগে) আসতে ৩০-৯০ দিন৬. সব রিপোর্ট একত্রিত করে এসবি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে৭. প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়
কেন দেরি হয়?
- একসঙ্গে হাজার হাজার ফর্ম আসে
- অনেকের ঠিকানা ভুল থাকে
- গ্রামে গিয়ে মানুষ পাওয়া যায় না
- থানার পুলিশের লোকবল কম
- গোয়েন্দা রিপোর্টে সময় লাগে
কখন রিপোর্ট নেগেটিভ হয়?
- ফৌজদারি মামলায় জড়িত থাকলে
- মিথ্যা তথ্য দিলে
- রাজনৈতিক সহিংসতায় সক্রিয় ভূমিকা থাকলে
- জঙ্গি বা উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে সংযোগ থাকলে
- পূর্বতন চাকরি থেকে বরখাস্ত হলে
- নৈতিক স্খলনের প্রমাণ পাওয়া গেলে
বাস্তব উদাহরণ (নাম গোপন রেখে)
২০২৪ সালে একজন বিসিএস ক্যাডার প্রার্থীর রিপোর্ট নেগেটিভ আসে কারণ তার বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে একটি মারামারির মামলা ছিল। মামলাটি খারিজ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু রেকর্ডে ছিল। তিনি হাইকোর্টে গিয়ে রিপোর্ট সংশোধন করিয়ে নেন।
আরেকজন ব্যাংক অফিসারের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে তিনি পূর্বতন বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করাকালীন একটি লোন কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন। এনএসআই তথ্য দিয়েছে। তার চাকরি বাতিল হয়।
কীভাবে দ্রুত রিপোর্ট পাওয়া যায়?
- সঠিক ঠিকানা দিন
- প্রতিবেশীদের আগে থেকে বলে রাখুন
- থানায় গিয়ে তদারকি করুন (সরাসরি ঘুষ না দিয়ে শুধু অনুরোধ করুন)
- অনলাইন পোর্টালে আবেদন করুন
- এমপি বা মন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করাবেন না (এতে উল্টো সন্দেহ হয়)
২০২৫ সালের নতুন পরিবর্তনসমূহ
- এখন থেকে ভেরিফিকেশন ফি ৫০০ টাকা (আগে ছিল ২০০)
- অনলাইন ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু হয়েছে
- এনআইডি ডাটাবেজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে
- থানায় বায়োমেট্রিক যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে
শেষ কথা
ভেরিফিকেশন রিপোর্ট কোনো শাস্তির হাতিয়ার নয়। এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার একটি প্রক্রিয়া। যার জীবন পরিচ্ছন্ন, সে কোনো চিন্তা করবে না। আর যে মিথ্যা বলে জীবন গড়তে চায়, তার জন্য এই প্রক্রিয়া একটি আয়না।
আপনার যদি এই বিষয়ে আরও প্রশ্ন থাকে, নির্দ্বিধায় জানাবেন। সরকারি চাকরি একটি দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব পালনের যোগ্য হওয়াটাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা।