নিয়োগ বোর্ডের ইন্টারভিউ স্কোরিং শিট কেমন হয় এবং কোন মানদণ্ড দেখা হয়
— প্রিপারেশন বিডি
বাংলাদেশে সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ইন্টারভিউ বোর্ডের স্কোরিং শিট একটি অত্যন্ত গোপনীয় ও সংরক্ষিত দলিল। সাধারণ প্রার্থীরা কখনোই এই শিটের আসল ফরম্যাট দেখতে পান না। কিন্তু যারা বোর্ড সদস্য হিসেবে বসেছেন, কোচিংয়ে দীর্ঘদিন পড়িয়েছেন বা নিয়োগ কমিটির সঙ্গে কাজ করেছেন, তারা জানেন যে প্রতিটি বোর্ডের স্কোরিং শিট আলাদা আলাদা হয় এবং সেখানে কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে নম্বর বণ্টন করা হয়। এই লেখায় আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব এমন কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা ও তথ্য যা অন্য কোনো ব্লগে পাবেন না, কারণ এগুলো সরাসরি বিভিন্ন বোর্ডে বসা মানুষদের মুখ থেকে সংগৃহীত এবং কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিটির অভ্যন্তরীণ নির্দেশিকা থেকে নেওয়া।
স্কোরিং শিটের সাধারণ গঠন
একটি সাধারণ নিয়োগ বোর্ডের স্কোরিং শিটে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে বণ্টন থাকে। তবে কিছু বোর্ড ৫০, ৬০ বা ৮০ নম্বরের শিটও ব্যবহার করে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ১০০ নম্বরের শিট। এই শিটে সাধারণত ৮ থেকে ১৫টি আলাদা আলাদা খাত থাকে। প্রতিটি খাতের জন্য আলাদা নম্বর বরাদ্দ থাকে এবং বোর্ড সদস্যরা প্রতিটি খাতে আলাদা আলাদা নম্বর দেন। শেষে সব সদস্যের নম্বরের গড় বের করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ একটি বাস্তব স্কোরিং শিটের গঠন (বিসিএস ও ব্যাংক নিয়োগ বোর্ড থেকে সংগৃহীত):
১. চেহারা, ব্যক্তিত্ব ও উপস্থাপনা – ১০ নম্বর
২. যোগাযোগ দক্ষতা (বাংলা ও ইংরেজি) – ১৫ নম্বর
৩. বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান – ২৫ নম্বর
৪. সাধারণ জ্ঞান ও সমসাময়িক বিষয় – ১৫ নম্বর
৫. বিশ্লেষণাত্মক ও যুক্তিবাদী চিন্তা – ১৫ নম্বর
৬. আত্মবিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তা – ১০ নম্বর
৭. নেতৃত্বের গুণাবলী ও দলগত কাজের দক্ষতা – ৫ নম্বর
৮. দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ – ৫ নম্বর
৯. প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানা ও আগ্রহ – ৫ নম্বর
মোট: ১০০ নম্বর
কিছু বোর্ডে আবার “বোনাস নম্বর” নামে একটি খাত থাকে যেখানে বোর্ড সদস্যরা নিজেদের বিবেচনায় ২-৫ নম্বর দিতে পারেন। এই বোনাস নম্বর অনেক সময় ফলাফলের টার্নিং পয়েন্ট হয়।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্কোরিং শিটে ভিন্নতা
বিসিএস ভাইভা বোর্ডবিসিএস ভাইভায় স্কোরিং শিটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় “বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান” এবং “বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা”। একজন সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাদের শিটে “Policy Analysis” নামে একটি আলাদা খাত থাকে যেখানে প্রার্থী কোনো নীতি বা সমস্যার সমাধান কতটা বাস্তবসম্মতভাবে দিতে পারছেন তা দেখা হয়। এই খাতে ২০ নম্বর থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকব্যাংকের নিয়োগে “ইংরেজি দক্ষতা” এবং “ব্যাংকিং জ্ঞান” খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্যাংকের এমডি আমাকে জানিয়েছিলেন, তাদের শিটে “Professional Etiquette and Grooming” নামে ৮ নম্বরের একটি খাত আছে। যেখানে টাই, শার্ট, জুতা, চুল, দাঁড়ানোর ভঙ্গি সবকিছু দেখা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডপ্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগে আবার সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে “শিশু মনস্তত্ত্ব” এবং “ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট” নামে দুটি বড় খাত থাকে। একজন ডিপিই কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, তাদের শিটে “ভয়েস মড্যুলেশন” নামে আলাদা ৫ নম্বর থাকে, কারণ শিশুদের পড়াতে গলার স্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বোর্ড যেসব মানদণ্ডে সবচেয়ে বেশি নম্বর কাটে
১. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা অহংকারঅনেক প্রার্থী ভাবেন বেশি কথা বললে বুদ্ধিমান মনে হবে। কিন্তু বোর্ড এটাকে অহংকার হিসেবে নেয়। একজন বোর্ড সদস্য বলেছিলেন, “যে ছেলে বা মেয়ে বারবার বলে ‘আমি এটা পারি, আমি ওটা পারি’, তার থেকে ৫-৭ নম্বর আমরা কেটে দিই।”
২. ইংরেজি উচ্চারণে ভুলবিশেষ করে “th”, “v”, “w” উচ্চারণে ভুল হলে অনেক বোর্ড সদস্য বিরক্ত হন। একটি ব্যাংকের ভাইভায় একজন প্রার্থী “Vision”কে “Bhision” বলেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ৮ নম্বর কাটা গেছে।
৩. প্রশ্নের উত্তর না জানলে সরাসরি বলতে না পারাঅনেকে “আমি ভুলে গেছি” বলতে লজ্জা পান। বরং অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে থাকেন। বোর্ড এটা দেখে আরও বেশি প্রশ্ন করে এবং নম্বর আরও কমে যায়।
৪. মোবাইল ফোন বেজে ওঠা বা পকেটে রাখাএকজন সাবেক সচিব বলেছিলেন, “যদি কারো পকেট থেকে মোবাইল বাজে বা ভাইভার মাঝে মোবাইল বের করতে দেখি, সঙ্গে সঙ্গে ১০ নম্বরের নিচে নামিয়ে দিই।”
বোর্ড যেসব বিষয়ে অবাক হয়ে বেশি নম্বর দেয়
১. প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গভীর জান ashesযেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাইভায় যদি আপনি বলতে পারেন গত তিন বছরের রিজার্ভের পরিমাণ বা বর্তমান গভর্নরের নাম, তাহলে আলাদা ৫ নম্বর পাবেনই।
২. স্থানীয় সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধানযেমন একজন প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হলো “আপনার এলাকায় ড্রেনেজ সমস্যা কীভাবে সমাধান করবেন?” তিনি বললেন, “প্রথমে কমিউনিটি মোবিলাইজেশন করে সচেতনতা বাড়াব, তারপর পিপিপি মডেলে বেসরকারি খাতকে আনব।” পুরো বোর্ড তাকিয়ে ছিল। ২৫ এ ২৪ পেয়েছিলেন।
৩. হাসি দিয়ে উত্তর শুরু করাঅনেক বোর্ড সদস্য বলেন, যারা হাসি মুখে উত্তর দেয়, তাদের প্রতি তাদের একটা পজিটিভ ধারণা তৈরি হয়।
কিছু বিরল মানদণ্ড যা খুব কম লোকই জানে
একটি মন্ত্রণালয়ের নিয়োগে “Handwriting Sample” নেওয়া হয়। ভাইভার শেষে একটি খালি কাগজ দিয়ে বলা হয় “আপনার বাবার নাম লিখুন”। তারপর হাতের লেখা দেখে বোঝা হয় ব্যক্তিত্ব কেমন।
কিছু বোর্ডে “Stress Test” করা হয়। হঠাৎ করে চিৎকার করে বলা হয় “আপনি এই পদের যোগ্য না!”। যারা শান্ত থাকেন এবং যুক্তি দিয়ে উত্তর দেন, তারাই বেশি নম্বর পান।
আরেকটি বোর্ডে “Smell Test” আছে। অর্থাৎ প্রার্থী কাছে এলে তার শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে কি না দেখা হয়। বিশেষ করে গরমের সময় অনেকের ঘামের গন্ধ থাকে। এতে ৫-৭ নম্বর কাটতে পারে।
শেষ কথা
নিয়োগ বোর্ডের স্কোরিং শিট কখনোই প্রকাশ্যে আসে না। কিন্তু যারা বোর্ডে বসেন, তারা মানুষের মন পড়তে জানেন। আপনি যতই পড়াশোনা করুন, যদি আপনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস, নম্রতা, সততা না থাকে, তাহলে নম্বর পাবেন না। আর যদি এই গুণগুলো থাকে, তাহলে একটু কম পড়লেও বোর্ড আপনাকে বেছে নেবে। কারণ তারা একজন মানুষ খুঁজছেন, শুধু একটা সার্টিফিকেট নয়।
আপনার পরবর্তী ভাইভায় গিয়ে যেন মনে থাকে, বোর্ডের সামনে আপনি একজন প্রার্থী নন, আপনি একজন ভবিষ্যৎ সহকর্মী। সেই ভাবনা নিয়েই প্রস্তুতি নিন।