চাকরির পরীক্ষায় বয়স গণনার তারিখ কেন পরিবর্তিত হয় এবং এর নিয়ম

প্রিপারেশন বিডি

৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রার্থীদের বয়স গণনা করা হয় একটি নির্দিষ্ট তারিখের ভিত্তিতে। অনেকেই দেখেছেন যে, একই পদের জন্য বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে বয়স গণনার তারিখ ভিন্ন ভিন্ন থাকে। কখনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ, কখনো আবেদনের শেষ তারিখ, কখনো পরীক্ষার তারিখ, আবার কখনো একেবারে অনির্দিষ্ট কোনো তারিখ ধরা হয়। এই পরিবর্তনের পেছনে যুক্তি আছে, আইন আছে, নজির আছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশাসনিক সুবিধা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। এই লেখায় আমি চেষ্টা করবো বিষয়টিকে খোলাসা করতে, যাতে কোনো চাকরিপ্রার্থী আর কখনো এই নিয়ে বিভ্রান্ত না হন।

বয়স গণনার তারিখ কেন পরিবর্তন হয়? মূল কারণগুলো

১. মহামারী ও জাতীয় দুর্যোগের প্রভাব২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশে প্রায় সব নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ ছিল। এই সময়ে যারা বয়সসীমা পার হয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের জন্য সরকার একাধিকবার বয়সের ছাড় দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে, ২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে যাদের বয়স ৩০ পূর্ণ হয়নি, তারাই আবেদন করতে পারবেন। এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। পরবর্তীতে ৪৪তম ও ৪৫তম বিসিএসেও একই ধরনের ছাড় দেওয়া হয়। এই ধরনের পরিবর্তন শুধু করোনার জন্যই হয়নি; ২০১২ সালে হরতাল-অবরোধের কারণে ৩৩তম বিসিএসের বয়স গণনা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

২. নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিলম্বঅনেক সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর পরীক্ষা নিতে ২-৩ বছর লেগে যায়। যেমন ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে, কিন্তু প্রিলিমিনারি হয় ২০২১ সালের মার্চে। এই দীর্ঘ বিলম্বের কারণে যারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় যোগ্য ছিলেন, তারা পরীক্ষার সময় বয়স পার হয়ে যেতে পারেন। এজন্য বিসিএসের ক্ষেত্রে প্রায় সবসময়ই বয়স গণনা করা হয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখের ভিত্তিতে। কিন্তু নন-ক্যাডার বা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগে অনেক সময় আবেদনের শেষ তারিখ ধরা হয়।

৩. আদালতের নির্দেশ ও নজির২০১৮ সালে হাইকোর্ট একটি রায় দেন যে, যেহেতু নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতা হয়, তাই বয়স গণনা করতে হবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ থেকে। এই রায়ের পর অনেক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তির তারিখকে বয়সের কাট-অফ ডেট করা হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে আপিল বিভাগ এই রায় স্থগিত করেন এবং বলেন, প্রতিটি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী বয়সের তারিখ নির্ধারণ করতে পারবে। ফলে আবারও বৈচিত্র্য ফিরে আসে।

৪. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালাবিসিএস, ব্যাংক, পুলিশ, শিক্ষক নিবন্ধন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ, রেলওয়ে, পিডিবি, পেট্রোবাংলা প্রত্যেকের নিয়ম আলাদা। যেমন:

বর্তমানে কোন নিয়ম প্রচলিত?

২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে:

অর্থাৎ কোনো একক জাতীয় নীতি এখনো গৃহীত হয়নি।

কোন তারিখ নির্বাচন করলে প্রার্থীদের জন্য ন্যায়বিচার হয়?

অনেক গবেষক ও চাকরিপ্রার্থীদের মত হলো:বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখকে বয়স গণনার কাট-অফ ধরা উচিত। কারণ:১. যিনি বিজ্ঞপ্তি দেখে প্রস্তুতি শুরু করেন, তিনি তখনই যোগ্য বলে ধরে নেন।২. আবেদনের শেষ তারিখ ধরলে যারা শেষ মুহূর্তে আবেদন করেন, তারাই সুবিধা পান; যারা আগে আগে আবেদন করেছেন, তারা অযোগ্য হয়ে যান।৩. পরীক্ষার তারিখ ধরলে তো আরও অনিশ্চয়তা বাড়ে। কারণ পরীক্ষা কবে হবে, তা কেউ জানে না।

তাই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখকে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত মনে করা হয়।

আইনি দিক থেকে কী বলা আছে?

সরকারি চাকরি (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাড়) বিধিমালা, ২০১৫ এর ৪ নম্বর বিধিতে বলা আছে:“কোনো পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য শারীরিক যোগ্যতা নির্ধারিত তারিখে পূরণীয় হইতে হইবে এবং উক্ত তারিখ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।”

অর্থাৎ আইন নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। তাই যতদিন না একটি একক নীতি করা হচ্ছে, ততদিন এই বৈচিত্র্য থাকবে।

কিছু বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক

১. ৪৫তম বিসিএস: বিজ্ঞপ্তি ৩০ নভেম্বর ২০২২। বয়স গণনা ১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে।২. সোনালী ব্যাংক অফিসার (ক্যাশ) ২০২৪: আবেদন শুরু ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, শেষ ৩১ জানুয়ারি ২০২৫। বয়স গণনা ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে।৩. প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ২০২৩: আবেদন শুরু ২৪ অক্টোবর, বয়স গণনা ২৪ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে।

দেখা যাচ্ছে একই সরকারের অধীনে তিন ধরনের নিয়ম চালু আছে।

ভবিষ্যতে কী হওয়া উচিত?

১. একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা থাকবে যে সব সরকারি ও আধা-সরকারি নিয়োগে বয়স গণনা হবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখে।২. বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে লিখতে হবে “বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা গণনা করা হবে অমুক তারিখে”। বর্তমানে অনেক বিজ্ঞপ্তিতে এই লাইন থাকে না, যা বিভ্রান্তির মূল কারণ।৩. দুর্যোগকালীন সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১-২ বছর বয়সের ছাড় দেওয়ার বিধান রাখা।

শেষ কথা

চাকরির পরীক্ষায় বয়স গণনার তারিখ পরিবর্তনের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র নেই; আছে প্রশাসনিক জটিলতা, আইনি শূন্যতা এবং সময়ের সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতি। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা লাখ লাখ তরুণের মনে আশঙ্কা তৈরি করে। তাই সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি: একটি স্থায়ী, সুনির্দিষ্ট এবং সবার জন্য সমান নিয়ম প্রণয়ন করুন। যাতে কোনো তরুণকে আর বলতে না হয়, “আমি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কিন্তু বয়স পার হয়ে গেছে শুধু তারিখ বদলে গেছে বলে।”

আপনার পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি পড়ার আগে শুধু একটা লাইন খুঁজবেন: “বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা গণনা করা হইবে…………তারিখে”। সেই তারিখটাই আপনার ভাগ্য নির্ধারণ করবে।

বিষয় : পড়াশোনার টিপস