চাকরির এমসিকিউ পরীক্ষায় সহজে উত্তীর্ণ হওয়ার কৌশল

প্রিপারেশন

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

চাকরির এমসিকিউ পরীক্ষায় সহজে উত্তীর্ণ হওয়ার কৌশল

এমসিকিউ পরীক্ষা

বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি, ব্যাংক, এনজিও, টেলিকম, ফার্মা কিংবা বিসিএস হোক না কেন, প্রায় সব চাকরির প্রথম ধাপই এখন এমসিকিউ (Multiple Choice Question)। লাখ লাখ প্রার্থীর ভিড়ে মাত্র ১০০ বা ১২০টি প্রশ্নের মাধ্যমে আপনাকে প্রমাণ করতে হয় যে আপনি পরবর্তী ধাপের যোগ্য। অনেকেই ভাবেন, “এমসিকিউ তো গেস করলেই হয়!” কিন্তু যারা প্রস্তুতি গোছানো, তার গেসও সঠিক জায়গায় পড়ে। আজকের এই লেখায় আমি শুধু বইয়ের নাম বা রুটিন বলব না, বরং এমন কিছু কৌশল, মনস্তাত্ত্বিক হ্যাক, সময় ব্যবস্থাপনার গোপন সূত্র আর ভুল থেকে শেখা শত শত পরীক্ষার্থীর বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ গাইড তৈরি করব, যা আপনি অন্য কোনো ব্লগে পাবেন না।

১. মানসিকতা: “আমি হারব না, শিখব”

এমসিকিউ পরীক্ষার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ভয় আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। যারা বলে “আমি তো সব জানি, শুধু একটু রিভিশন দিই”, তারা প্রায়ই নেগেটিভ মার্কিংয়ে ধরা খায়। আবার যারা বলে “আমার কিছুই হবে না”, তারা ৩০ নম্বরও তুলতে পারে না।

সফল প্রার্থীরা একটা মন্ত্র মুখস্থ করে:“প্রতিটি ভুল উত্তরই আমাকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়।”আপনি যদি ১০০টা মক টেস্ট দেন আর প্রতিবার ২০টা করে ভুল করেন, তাহলে ২০০০ ভুল থেকে শিখে আসল পরীক্ষায় ভুল করার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে যায়। এটা কারণে প্রস্তুতির শুরুতেই নিজেকে বলুন, “আমি এখানে পাশ করতে আসিনি, আমি এখানে নিজেকে অপরাজেয় বানাতে এসেছি।”

২. পরীক্ষার প্যাটার্নের গোয়েন্দাগিরি

বেশিরভাগ চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রথম ৭ দিনের মধ্যে ওয়েবসাইটে “পরীক্ষার সিলেবাস ও মানবণ্টন” দেওয়া হয়। কিন্তু ৯৫% প্রার্থী সেটা পড়েই না। আপনি পড়বেন। আরও এগিয়ে যাবেন। গত ৫ বছরের প্রশ্নের হিসেব করে দেখবেন:

  • বাংলা থেকে কতগুলো গ্রামার, কতগুলো সাহিত্য, কতগুলো শব্দভাণ্ডার
  • ইংরেজিতে Vocabulary না Grammar বেশি আসে?
  • গণিতে শতকরা, লাভ-লসা-ঘ, অনুপাতই বেশি নাকি জ্যামিতি?
  • সাধারণ জ্ঞানে বাংলাদেশ বিষয়ক না আন্তর্জাতিক বেশি?

একটা এক্সেল শিট খুলুন। প্রতি বিষয়ের নম্বর আলাদা কলামে লিখুন। দেখবেন কিছু বিষয়ে ৮০% প্রশ্নই একই টপিক থেকে ঘুরে আসছে। সেই টপিকগুলোকে আপনি “গোল্ড মাইন” বলে চিহ্নিত করবেন।

৩. প্রস্তুতির তিন স্তরের কৌশল

স্তর ১: বেস বিল্ডিং (প্রথম ৩০-৪৫ দিন)

এই সময় কোনো মক টেস্ট দেবেন না। শুধু বেসিক ক্লিয়ার করবেন। কিন্তু বইয়ের পাতা উল্টানো নয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করুন:

  • বাংলা: প্রতিদিন ৫০টা সমার্থক, বিপরীত, এককথায় প্রকাশ শিখুন। কাগজে না লিখে মুখে মুখে বলুন। মুখে বললে মস্তিষ্কে গেঁথে যায়।
  • ইংরেজি: ৩০০০ সবচেয়ে কমন শব্দ (যেমন Saifur’s Vocabulary) মুখস্থ নয়, বাক্যে ব্যবহার করে শিখুন। প্রতিদিন ২০টা শব্দ নিয়ে ২০টা বাক্য লিখুন।
  • গণিত: প্রতিদিন একটা টপিক শেষ করুন। শুধু সূত্র মুখস্থ নয়, ৫০টা প্রশ্ন হাতে কলমে সমাধান করুন। ক্যালকুলেটর বন্ধ।
  • সাধারণ জ্ঞান: লুসিড, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নয়। বাংলাদেশের মানচিত্র হাতে আঁকুন। ৬৪ জেলার সদর, বিভাগ, নদী, পার্বত্য জেলা মুখস্থ করুন। আন্তর্জাতিক পুরস্কারের তালিকা একটা কাগজে লিখে দেয়ালে টাঙান করুন।

স্তর ২: টাইমড প্র্যাকটিস (পরের ৩০-৪৫ দিন)

এখন থেকে প্রতিদিন একটা করে ১০০ মার্কের মক টেস্ট দেবেন। কিন্তু শর্ত:

  • ঘড়ি ধরে ঠিক ৬০ মিনিটে শেষ করতে হবে (বেশিরভাগ পরীক্ষায় ১ মিনিটে ১.৬৭ প্রশ্নের হিসেব)।
  • উত্তরপত্র জমা দেওয়ার পর প্রতিটি ভুলের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করুন। কেন ভুল হলো? কনসেপ্ট ক্লিয়ার ছিল না, নাকি সময়ের চাপে?
  • একটা “ভুল রেজিস্টার” রাখুন। প্রতিটি ভুল প্রশ্ন কপি করে লিখুন। পরীক্ষার আগের রাতে শুধু এই রেজিস্টার পড়বেন।

স্তর ৩: পিক পারফরম্যান্স (পরীক্ষার আগের ১৫ দিন)

এই সময় নতুন কিছু শিখবেন না। শুধু গত ৬০ দিনের মক টেস্টের ভুলগুলো শতবার রিভিশন দেবেন। প্রতিদিন ২টা করে পূর্ণাঙ্গ মক টেস্ট দেবেন। একটা সকালে, একটা রাতে। দেখবেন আপনার স্কোর ৮৫+ এ স্থিত হয়ে গেছে।

৪. পরীক্ষার হলে ৭টা গোপন কৌশল

১. প্রথম ৫ মিনিট প্রশ্নপত্র উল্টে দেখুন। যে বিষয়ে আপনি সবচেয়ে দুর্বল, সেগুলো শেষে রাখুন।২. প্রথমে যে প্রশ্নগুলো ১০০% সঠিক জানেন, সেগুলো করুন। এতে মনের জোর বাড়ে।৩. যে প্রশ্নে ৫০-৫০ সন্দেহ, চিহ্ন দিয়ে রাখুন। শেষ ১০ মিনিটে গেস করবেন।৪. নেগেটিভ মার্কিং থাকলে ৩টা বা তার বেশি অপশন বাদ দিতে পারলে গেস করুন। ২টা থাকলে ছেড়ে দিন।৫. সময় শেষ হওয়ার ৫ মিনিট আগে সব উত্তর OMR এ ফিল করুন, এমনকি খালি থাকলেও। কারণ কিছু পরীক্ষায় খালি থাকলে নেগেটিভ হয়।৬. OMR এ বৃত্ত ভরার সময় পাশের লাইনে গিয়ে ভরবেন না। অনেকের ১০-১৫ নম্বর এভাবে কাটা যায়।৭. পরীক্ষা শেষে কারো সাথে উত্তর মেলাবেন না। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরবেন না।

৫. বিষয়ভিত্তিক স্পেশাল ট্রিকস

বাংলা

  • বানান ভুলের প্রশ্ন এলে “যুক্তাক্ষর” খেয়াল করুন। ৯০% ক্ষেত্রে সেখানেই ফাঁদ।
  • সাহিত্যের প্রশ্নে লেখকের নামের সাথে “প্রথম/সর্বপ্রথম” শব্দ থাকলে সতর্ক হবেন। অনেক সময় ভুল তথ্য দেওয়া হয়।

ইংরেজি

  • Sentence correction এ subject-verb agreement আর tense এর দিকে নজর দিন।
  • Synonym/Antonym এ যদি একদম অজানা শব্দ থাকে, root word (pre-, un-, dis-) দেখে গেস করুন।

গণিত

  • শতকরার প্রশ্নে ১০০ দিয়ে গুণ/ভাগ না করে সরাসরি শতকরা সূত্র ব্যবহার করুন। সময় বাঁচে ৩০ সেকেন্ড।
  • গড়ের প্রশ্নে প্রথমে সব সংখ্যা যোগ করে মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ করুন, তারপর টুইস্ট দেখুন।

সাধারণ জ্ঞান

  • সংবিধানের সংশোধনী মুখস্থ নয়, বোঝার চেষ্টা করুন কোন সংশোধনী কী এনেছে।
  • পুরস্কারের প্রশ্নে “প্রথম বাংলাদেশি” বা “প্রথম মুসলিম” খেয়াল করুন।

কম্পিউটার

  • শর্টকিউট (Ctrl+A, Ctrl+C) গুলো একদিনে ৫০ বার প্র্যাকটিস করুন। পরীক্ষায় ২ সেকেন্ডে উত্তর হয়ে যায়।

৬. শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি

  • পরীক্ষার আগের রাতে ৭ ঘণ্টা ঘুমান। ৪ ঘণ্টা ঘুমালে মস্তিষ্ক ২০% স্লো হয়।
  • সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট। চা/কফি বেশি খাবেন না, বাথরুমের চাপ পড়বে।
  • পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় প্রিয় একটা গান শুনুন। ডোপামিন বাড়ে, আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

শেষ কথা

চাকরির এমসিকিউ পরীক্ষা কোনো জ্ঞানের পরীক্ষা নয়, এটা একটা খেলা। যে খেলার নিয়ম ভালো জানে, সে জিতে। আপনি যদি এই লেখার একটাও কৌশল কাজে লাগান, তাহলে আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনার স্কোর আগের চেয়ে কমপক্ষে ২৫ নম্বর বাড়বে।

আর মনে রাখবেন, যারা আজ পরীক্ষায় ফেল করছে, তারা কাল আপনার বস হতে পারে না। কারণ তারা শুধু পড়েছে, আর আপনি যুদ্ধ করেছেন।

শুভকামনা। যান, জয় করুন।

বিষয় : পড়াশোনার টিপস