ইসলামে নৈতিক শিক্ষা কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ

প্রিপারেশন

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

ইসলামে নৈতিক শিক্ষা কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ

নৈতিক শিক্ষা

আজকের পৃথিবীতে যখন আমরা প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি আর রাজনীতির দৌড়ে এতটাই ব্যস্ত যে মানুষের ভেতরের মানুষটাকে ভুলতে বসেছি, তখন ইসলাম আমাদের সামনে যে বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে ধরে রেখেছে, সেটি হলো নৈতিক শিক্ষা। কুরআন ও হাদীসের পাতায় পাতায় যদি আমরা খুঁজি, তবে দেখব যে ইবাদতের বিধানের পাশাপাশি চরিত্র গঠনের উপর যে পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থে এত সুস্পষ্ট ও ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলেছেন, “ইন্নামা বু‘ইস্তু লিউতাম্মিমা মাকারিমাল আখলাক” অর্থাৎ “আমি তো কেবল উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।” (মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ১৬২৩)

এই একটি বাক্যই যথেষ্ট প্রমাণ করে যে ইসলামের দৃষ্টিতে নবুওয়তের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যই ছিল মানুষের ভেতরের সৌন্দর্য তৈরি করা। জ্ঞান অর্জন, ইবাদত, জিহাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুর আগে যদি চরিত্র না থাকে, তবে সেগুলোর কোনো মূল্য থাকে না। এ কারণেই ইসলামে নৈতিক শিক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়।

নৈতিকতা ছাড়া ইবাদতের অসম্পূর্ণতা

অনেকে মনে করেন নামায, রোযা, হজ, যাকাত পালন করলেই তারা পরিপূর্ণ মুসলিম হয়ে গেছেন। কিন্তু কুরআন স্পষ্টভাবে বলছে, “কিয়ামতের দিন সবার আগে যে জিনিসটির ওজন করা হবে, সেটি হলো চরিত্র। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন মুমিনের পাল্লায় তার উত্তম চরিত্র ছাড়া আর কোনো জিনিস ভারী হবে না।” (তিরমিযী ২০০৩, আবু দাউদ ৪৭৯৯)

একজন মানুষ যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, কিন্তু তার জিহ্বা মিথ্যা বলে, চোখ যিনা করে, হাত অন্যায়ভাবে কিছু নেয়, তবে তার নামায আল্লাহর কাছে কবুল হবে কি? কুরআন বলছে, “ফাওয়াইলুল লিল মুসাল্লীন, আল্লাযীনা হুম আন সালাতিহিম সাহূন” অর্থাৎ “দুর্ভোগ সেই নামাযীদের জন্য যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন” (সূরা মাঊন: ৪-৫)। তাফসীরে দেখা যায়, এখানে “উদাসীন” বলতে শুধু সময়মতো নামায না পড়াকেই বোঝানো হয়নি, বরং নামায পড়েও যারা অন্যায়, অহংকার, পরনিন্দা থেকে বিরত থাকে না, তাদেরকেও বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নৈতিকতা ছাড়া ইবাদত যান্ত্রিক হয়ে যায়, আত্মার স্পর্শ পায় না।

নৈতিক শিক্ষা ছাড়া জ্ঞানের বিপদ

আজকাল আমরা দেখি অনেক আলেম, ডক্টরেটধারী, বিজ্ঞানী আছেন যারা কুরআন-হাদীস মুখস্থ, কিন্তু তাদের ব্যবহারে ইসলামের ছিটেফোঁটাও নেই। এর কারণ একটাই: তারা জ্ঞান অর্জন করেছেন, কিন্তু নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। ইমাম গাযযালী রহ. বলেছেন, “যে জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর দিকে নিয়ে যায় না, সে জ্ঞান বোঝা ছাড়া কিছু নয়।” আর আল্লাহর দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপই হলো চরিত্রের সংশোধন।

ইতিহাস সাক্ষী, যখনই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নৈতিক শিক্ষার অভাব দেখা দিয়েছে, তখনই জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তারা পরাজিত হয়েছে। আব্বাসীয় যুগের শেষ দিকে বাগদাদে লাইব্রেরি ভর্তি ছিল পান্ডুলিপি, কিন্তু আলেমদের মধ্যে যখন হিংসা, দলাদলি, ক্ষমতার লোভ ঢুকে গেল, তখন মঙ্গোল আক্রমণে পুরো সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল। অথচ ক্রুসেড যুদ্ধের সময় সালাহুদ্দিন আইয়ুবী রহ.-এর সেনাবাহিনীতে যোদ্ধার সংখ্যা কম থাকলেও তারা জয়ী হয়েছিল শুধু চরিত্রের কারণে। শত্রুপক্ষের আহত হলে তিনি তাদের চিকিৎসা করিয়েছেন, বন্দীদের মুক্তি দিয়েছেন। এই নৈতিক শক্তিই তাকে অপরাজেয় করেছিল।

সমাজে নৈতিকতার অভাবে যা ঘটে

আজ আমরা যে দুর্নীতি, ঘুষ, পরকীয়া, মিথ্যা, হিংসা, পারিবারিক অশান্তি দেখছি, তার মূলে একটাই রোগ: নৈতিক শিক্ষার অভাব। একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৯০% মানুষ নিজেদের ধার্মিক দাবি করে, কিন্তু একই জরিপে ৮৭% মানুষ বলেছে তারা দুর্নীতিকে স্বাভাবিক মনে করে। এটা কীভাবে সম্ভব? কারণ আমরা ধর্মকে শুধু আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। আমাদের মাদ্রাসা-স্কুলে কুরআন-হাদীস পড়ানো হয়, কিন্তু “আখলাকে হাসানা” বা উত্তম চরিত্র গঠনের উপর আলাদা কোনো সিলেবাস নেই। ফলে বাচ্চারা কুরআনের হরফ মুখস্থ করছে, কিন্তু তার অর্থ বা চরিত্রে প্রয়োগ করতে পারছে না।

ইসলাম কীভাবে নৈতিক শিক্ষা দেয়

ইসলাম নৈতিক শিক্ষাকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করে দিয়েছে:

১. আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক (ইহসলামের প্রথম স্তম্ভই হলো ঈমান): যখন মানুষ বিশ্বাস করে আল্লাহ সব দেখছেন, তখন সে গোপনে পাপ করতে ভয় পায়। এটাই সবচেয়ে বড় নৈতিক প্রশিক্ষণ।২. নিজের সঙ্গে সম্পর্ক: সত্যবাদিতা, ধৈর্য, আত্মসংযম, লজ্জাশীলতা।৩. পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক: পিতা-মাতার সেবা, স্ত্রীর হক, সন্তানের লালন-পালন।৪৪. সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক: প্রতিবেশীর হক, এতিম-মিসকীনের প্রতি দয়া, ব্যবসায় সততা, কথায় মিথ্যা না বলা।৫. পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক: পরিবেশ রক্ষা, প্রাণীদের প্রতি দয়া (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বিড়ালকে পানি পান করিয়েছিলেন বলে জান্নাত পেয়েছেন এক মহিলা)।

ব্যক্তিগত জীবনে নৈতিক শিক্ষার প্রভাব

যারা নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে, তাদের জীবনে যে শান্তি আসে, তা বর্ণনাতীত। আমি নিজে একব একজন বন্ধুকে দেখেছি যিনি আগে মিথ্যা বলতেন, ঘুষ নিতেন। একদিন তিনি তাওবা করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন আর কখনো মিথ্যা বলবেন না। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, চাকরি হারানোর ভয় ছিল। কিন্তু এক বছর পর তিনি বললেন, “জীবনে এই প্রথম আমার ঘুম শান্তিতে হচ্ছে।” আজ তিনি তার অফিসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ। কারণ সততা একবার প্রমাণিত হলে, মানুষ আর কখনো ফিরে তাকায় না।

শিশুদের মাঝে নৈতিক শিক্ষা কীভাবে দেবেন

অভিভাবকদের জন্য কিছু বাস্তবসম্মত উপায়:

  • নিজে সত্যবাদী হোন। বাচ্চারা যা দেখে, তাই শেখে।
  • ছোট ছোট কাজে দায়িত্ব দিন। যেমন: নিজের জুতা গুছিয়ে রাখা, খেলনা ভাগ করে নেওয়া।
  • ভুল হলে শাস্তি নয়, বোঝান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো শিশুকে গালি দেননি।
  • প্রতিদিন একটি করে হাদীস পড়ে শোনান। যেমন: “যে ব্যক্তি মানুষের জন্য যা পছন্দ করে নিজের জন্যও তাই পছন্দ করে, সে পরিপূর্ণ মুমিন।”
  • টিভি-মোবাইলের বদলে গল্প বলুন। উমার রা., খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর সততা, আবু বকর রা.-এর দানশীলতার গল্প।

উপসংহার

ইসলামে নৈতিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটিই একমাত্র জিনিস যা মানুষকে পশু থেকে মানুষ, মানুষ থেকে ফেরেশতার মর্যাদায় নিয়ে যায়। এটি ছাড়া ইবাদত যান্ত্রিক, জ্ঞান বিপজ্জনক, সমাজ অসুস্থ। যদি আমরা সত্যিই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হতে চাই, তবে আমাদের আজ থেকেই চরিত্র গঠনের কাজ শুরু করতে হবে। শুরুটা হোক নিজে থেকে, তারপর পরিবার, তারপর সমাজ।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম চরিত্র দান করুন এবং আমাদের সন্তানদের মাঝেও তা ছড়িয়ে দিতে তাওফিক দিন। আমীন।

বিষয় : ইসলাম শিক্ষা