ইসলামিক স্টাডিজ কিভাবে শুরু করবেন সহজ উপায়ে
— প্রিপারেশন
ইসলামিক স্টাডিজ
অনেকেই মনে করেন ইসলামিক স্টাডিজ মানে শুধু মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া, আরবি শিখে ফেলা কিংবা বছরের পর বছর ধরে বইয়ের পড়ে যাচ্ছে। আসলে তা নয়। ইসলামিক স্টাডিজ শুরু করা যায় একদম জিরো থেকে, ঘরে বসে, নিজের গতিতে এবং এমনভাবে যাতে মনে হয় না “পড়াশোনা করছি”, বরং মনে হয় “নিজের সাথে কথা বলছি, আল্লাহর সাথে কথা বলছি”।
আজন্য আমি আজকে এমন একটা পথ দেখাব যেটা আমি নিজে অনুসরণ করেছি, আমার ছাত্ররা করেছে, এবং যেটা কখনো কোনো ব্লগে বা ইউটিউব চ্যানেলে এভাবে একসাথে বলা হয়নি। এটা কোনো “৭ দিনে আলেম হওয়ার কোর্স” নয়। এটা একটা জীবনব্যাপী যাত্রার প্রথম ধাপ, যেটা আপনি আজ থেকেই শুরু করতে পারেন।
১. প্রথম কাজ: মানসিকতা ঠিক করুন (সবচেয়ে বড় বাধা হলো “আমি তো কিছুই জানি না” এই চিন্তা। এটা ফেলে দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত পেয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামদের অধিকাংশই ছিলেন উম্মি। আল্লাহ যদি চান, এক রাতেই আপনাকে এমন জ্ঞান দিতে পারেন যেটা বছরের পর বছর পড়েও কেউ পায় না।
তাই শুরু করুন তিনটা কথা নিজের সাথে:
- আমি ছোট থেকেই শুরু করব
- ভুল হলে লজ্জা পাব না
- আমার উদ্দেশ্য শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি
এই তিনটা কথা মুখে না বলে দিলে পরে হাজারো বই পড়েও লাভ হবে না।
২. প্রথম ৩০ দিনের প্ল্যান (জিরো লেভেল)
দিনে মাত্র ৩০-৪০ মিনিট দিলেই হবে।
সকালে ফজরের পর (১৫ মিনিট)
- এক পৃষ্ঠা কুরআন পড়ুন শুধু বাংলা অর্থসহ (যেমন: মাওলানা আকরাম খাঁর অনুবাদ বা মুহিউদ্দীন খানের)। আরবি পড়তে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। শুধু অর্থটা পড়ুন। প্রথমে সূরা বাকারার প্রথম ৫ পৃষ্ঠা। কোনো তাফসীর পড়ার দরকার নেই এখনো।
রাতে এশার পর (১৫-২০ মিনিট)
- “রিয়াদুস সালেহীন” বই প্রথম বই। প্রতিদিন একটা হাদীস পড়ুন, বাংলা অনুবাদসহ। শুধু পড়বেন না, নিজের জীবনে কিভাবে আমল করবেন সেটা একটা কাগজে লিখে রাখুন। উদাহরণ: যদি হাদীস আসে “যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাতে পড়ে সে সারা দিন আল্লাহর হেফাজতে থাকে”, তাহলে লিখুন: “কাল থেকে ফজর জামাতে যাব ইন শা আল্লাহ”।
এই দুটো কাজ ৩০ দিন করলেই আপনার মধে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন আসবে। কুরআনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হবে, হাদীসের সাথ স্বাদ পাবেন।
৩. আরবি না জানলে কি হবে?
অনেকে ভাবেন আরবি না শিখলে ইসলামিক স্টাডিজ সম্ভব না। এটা পুরোপুরি ভুল।
প্রথম ছয় মাস আরবি শিখবেন না। শুধু তিনটা জিনিস শিখুন:
- হরফ চেনা (২৮টা অক্ষর + হরকত)
- নামাযের সূরা-দোয়া মুখস্থ (যেগুলো ইতিমধ্যে মুখস্থ আছে সেগুলোর অর্থ বোঝা)
- কুরআন পড়ার সময় হরকত দেখে দেখে পড়া
এই তিনটা শিখতে এক মাসের বেশি লাগবে না। তারপর ধীরে ধীরে মাদানী কায়দায় কুরআন পড়া শিখবেন। কিন্তু প্রথম বছর আরবি গ্রামারে হাত দেবেন না।
৪. কোন বই দিয়ে শুরু করবেন? (অনন্য লিস্ট)
অধিকাংশ ব্লগে যে বইগুলো বলা হয় সেগুলো একটু ভারী। আমি বলছি এমন কিছু বই যেগুলো খুব কম মানুষ বলে:
- “আমি কেন মুসলিম” – জাফর ইকবাল শেখ (১২০ পৃষ্ঠার ছোট বই, কিন্তু জীবন বদলে দেবে)
- “দিলের খবর কে রাখে” – শায়খ মুহাম্মাদ ইব্রাহীম (হৃদয় গলিয়ে দেবে)
- “সীরাতুন নবী সা. সহজ ভাষায়” – মাওলানা আবুল কালাম (৩০০ পৃষ্ঠা, কিন্তু গল্পের মতো পড়া যায়)
- “যিকিরের ফযীলত” – ইমাম নববী (ছোট বই, কিন্তু প্রতিটা যিকিরের দলিল আছে)
- “তাওহীদের মাসায়েল” – শায়খ উসাইমীন (বাংলা অনুবাদ আছে, খুব সহজ)
এই পাঁচটা বই শেষ করলে আপনার বেসিক ক্লিয়ার।
৫. অনলাইন ক্লাস নয়, বরং “নিজের ক্লাস”
ইউটিউবে হাজারো কোর্স আছে। কিন্তু ৯০% মানুষ শুরু করে শেষ করতে পারে না। কারণটা হলো: তারা অন্যের গতিতে চলে।
আমার পরামর্শ: নিজের জন্য একটা “পার্সোনাল ক্লাস” তৈরি করুন। কিভাবে?
- একটা খাতা কিনুন
- প্রতিদিন যা পড়বেন তার সারাংশ ৫ লাইনে লিখবেন
- সপ্তাহে একদিন নিজেকে প্রশ্ন করবেন: এই সপ্তাহে আমি কি শিখলাম? কি আমল বাড়ালাম?
- প্রতি মাসে নিজের জন্য একটা “পরীক্ষা” নেবেন। উদাহরণ: ১০টা হাদীসের অর্থ লিখতে হবে মুখস্থ
এটা করলে আপনার পড়াশোনা কখনো বন্ধ হবে না।
৬. মসজিদের সাথে সম্পর্ক (গোপন টিপস)
অনেকে মসজিদে যান শুধু নামায পড়তে। কিন্তু মসজিদ আসলে একটা জীবন্ত ইউনিভার্সিটি।
- ফজরের পর ১৫ মিনিট মসজিদে বসে থাকুন। দেখবেন বুড়ো আম্মারা কথায় কথায় দলিল দেন। তাদের কাছ থেকে শিখুন।
- জুমার আগে ৩০ মিনিট আগে যান। অনেক মসজিদে হালকা দারস হয়।
- মসজিদের লাইব্রেরি থাকলে সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ুন।
আমি নিজে অনেক কিছু শিখেছি মসজিদের সিঁড়িতে বসে বুড়ো মানুষদের কথা শুনে।
৭. মোবাইলকে আলেম বানান
আপনার মোবাইলে যা আছে তাতেই আলেম হওয়া যায়।
- অ্যাপ: Quran Majeed (অর্থ + তাফসীর + অডিও)
- Hisnul Muslim অ্যাপ (সব দোয়া বাংলা অর্থসহ)
- “ইসলামিক বই” নামে একটা ফোল্ডার খুলুন। সেখানে PDF রাখুন
- প্রতিদিন রাতে ফোনের স্ক্রিন টাইম চেক করুন। যদি ইসলামিক কনটেন্ট ৩০ মিনিটের কম হয়, তাহলে লজ্জা করুন
৮. মহিলাদের জন্য স্পেশাল টিপস
অনেক বোন ভাবেন ঘরে থাকলে ইলম হাসিল করা কঠিন। আসলে উল্টো।
- রান্না করতে করতে শায়খ উসাইমীন বা শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদের অডিও শুনুন
- বাচ্চাকে ঘুম পড়াতে পড়াতে কুরআনের অর্থ পড়ুন
- হোয়াটসঅ্যাপে “বোনদের ইলমের গ্রুপ” খুলুন। সেখানে প্রতিদিন একটা হাদীস শেয়ার করুন
৯. এক বছর পর আপনি কোথায় থাকবেন?
যদি উপরের প্ল্যান ১ বছর মেনে চলেন:
- কুরআনের অর্থ দিয়ে দিয়ে শেষ করবেন
- রিয়াদুস সালেহীন পুরোটা পড়া হয়ে যাবে
- তাওহীদ, ফিকহ, সীরাতের বেসিক ক্লিয়ার
- মানুষ আপনাকে দেখে বলবে “মাশাআল্লাহ, কবে থেকে এত ইলম হলো?”
শেষ কথা
ইসলামিক স্টাডিজ কোনো ডিগ্রি নয়, এটা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক। যে দিন আপনি কুরআন পড়ে চোখে পানি আসবে, যে দিন একটা হাদীস পড়ে নিজেকে বদলাতে ইচ্ছে করবে, সেদিন বুঝবেন আপনার ইলমের যাত্রা সত্যিই শুরু হয়েছে।
আজ থেকেই শুরু করুন। এক পৃষ্ঠা কুরআন। একটা হাদীস। আর একটা আমল।আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।