কুরআন শেখার কার্যকর পদ্ধতি নতুনদের জন্য
— প্রিপারেশন
আপনি যদি একদম নতুন হয়ে থাকেন এবং কুরআন শিখতে চান, তাহলে প্রথম যে কথাটি মনে রাখবেন তা হলো: কুরআন শেখা কোনো প্রতিযোগিতা নয়, এটি আল্লাহর সাথে একটি জীবন্ত সম্পর্ক গড়ে তোলার যাত্রা। অনেকেই শুরুতে ভয় পান যে আরবি জানা নেই, উচ্চারণ হবে না, সময় লাগবে অনেক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত ১৫ বছরে লক্ষ লক্ষ নন-আরব মানুষ কুরআন হেফজ করেছেন এবং তাজবিদসহ সঠিকভাবে পড়তে শিখেছেন। আজ আমি এমন কিছু বাস্তবসম্মত, পরীক্ষিত ও একদম নতুনদের জন্য উপযোগী পদ্ধতি শেয়ার করব যেগুলো আপনি কখনো অন্য কোনো বাংলা ব্লগে এভাবে একসাথে পাবেন না।
১. মানসিক প্রস্তুতি: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ
অনেকে সরাসরি অ্যাপ খুলে বসেন, কিন্তু ৯০% মানুষ প্রথম এক মাসের মধ্যে ছেড়ে দেন শুধু মানসিক প্রস্তুতি না থাকার কারণে। নতুনদের জন্য আমি তিনটি মানসিক সুইচ অন করার পরামর্শ দিই:
- আমি কুরআন শিখছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কারো প্রশংশা পাওয়ার জন্য নয়।
- আমার উচ্চারণ ভুল হলেও আল্লাহ আমার চেষ্টা দেখছেন, ফেরেশতা আমার জন্য দোয়া করছেন।
- আমি প্রতিদিন মাত্র ১৫-২০ মিনিট দিয়েও এক বছরে পুরো কুরআন খতম করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
এই তিনটি কথা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ও ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার মনে মনে বলুন। এটা আপনার মস্তিষ্কে একটা “কুরআন মোড” চালু করে দেবে।
২. নতুনদের জন্য সবচেয়ে সহজ শুরু: নূরানী কায়দা নয়, বরং “কুরআনি কায়দা”
আমাদের দেশে সবাই নূরানী কায়দা দিয়ে শুরু করে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের জন্য এটা প্রায়ই বোরিং হয়ে যায়। আমি গত ছয় বছরে হাজারো ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে দেখেছি, যারা একদম জিরো থেকে শুরু করে, তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো “কুরআনি কায়দা” পদ্ধতি। এর নিয়ম:
- প্রথম ৭ দিন শুধু হরফ চেনা ও উচ্চারণ। কিন্তু বইয়ের বদলে মোবাইলে “Quran Companion” অ্যাপে “Letter Mode” চালু করুন।
- প্রতিটি হরফ ১০০ বার শুনে শুনে বলুন। শুধু দেখে নয়, কান দিয়ে শুনতে হবে। কারণ কুরআন মুখস্থ হয় কানের মাধ্যমে।
- অষ্টম দিন থেকে সরাসরি সূরা ফাতিহা শিখুন। কায়দা শেষ করার জন্য অপেক্ষা করবেন না।
ফলাফল: যারা এভাবে শুরু করে, তারা ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে। যেখানে নূরানী কায়দা দিয়ে ৪-৬ মাস লাগে।
৩. দিনে মাত্র ১৫ মিনিটে এক পৃষ্ঠা মুখস্থ করার গোপন টেকনিক
অনেকে বলেন, “আমার মুখস্থ ক্ষমতা নেই”। আসলে মুখস্থ করার সঠিক পদ্ধতি জানা নেই। আমি যে পদ্ধতি ব্যবহার করি, তা মিশরের আল-আজহারের কিছু শায়খের কাছ থেকে শিখেছি, নতুনদের জন্য এটি অবিশ্বাস্যভাবে কার্যকর:
- প্রতিদিন নতুন এক পৃষ্ঠার প্রথম আয়াত ২০ বার পড়ুন (উচ্চস্বরে)
- তারপর পুরো পৃষ্ঠা ১০ বার একটান্তরে পড়ুন
- তারপর চোখ বন্ধ করে মুখস্থ বলার চেষ্টা করুন। ভুল হলে আবার শুনুন।
- সবশেষে আগের দিনের পৃষ্ঠা একবার রিভিশন দিন।
মোট সময় লাগবে ১৫-১৮ মিনিট। কিন্তু এক মাসে আপনার ৩০ পৃষ্ঠা মুখস্থ হয়ে যাবে। এই পদ্ধতির নাম “২০-১০-চোখবন্ধ-রিভিশন”। আমার ছাত্ররা এটাকে “২০১০ টেকনিক” বলে।
৪. তাজবিদ শেখার সবচেয়ে সহজ উপায় (যেটা কেউ বলে না)
তাজবিদের বই পড়ে অনেকে হতাশ হয়ে যান। নতুনদের জন্য আমি তিনটি স্তরের তাজবিদ পদ্ধতি ব্যবহার করি:
স্তর ১ (প্রথম ৩ মাস): শুধু তিনটি নিয়ম শিখুন
- মাদ্দ (লম্বা করা)
- গুন্নাহ (নাকি স্বর)
- ইখফা (লুকানো উচ্চারণ)
এই তিনটি শিখে ফেললে আপনার ৭০% তাজবিদ ঠিক হয়ে যাবে।
স্তর ২ (৪-৯ মাস): কালার কোডেড কুরআন দিয়ে পড়ুন। যেখানে মাদ লাল, গুন্নাহ সবুজ, ইখফা নীল। চোখ দেখে দেখে উচ্চারণ করলে ৬ মাসে তাজবিদ সয়ংক্রিয় হয়ে যায়।
স্তর ৩ (১০ মাস পর): এবার তাজবিদের বই পড়ুন। কারণ ততদিনে আপনার কান এতটাই সংবেদনশীল হয়ে যাবে যে বই পড়লে সাথে সাথে বুঝতে পারবেন।
৫. নতুনদের জন্য সেরা ৫টি অ্যাপ ও টুল (২০২৫ সালের হালনাগাদ)
১. Quran Companion – মুখস্থ করার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী। এখানে “Blind Test” ফিচার আছে, যেখানে আয়াত লুকিয়ে যায়, আপনাকে মুখস্থ বলতে হয়।২. Tarteel AI – আপড়লে সাথে সাথে ভুল ধরিয়ে দেয়। রাতে ঘুমানোর আগে ১০ মিনিট পড়ুন, সকালে দেখবেন ভুলগুলো মনে থেকে উধাও।৩. Ayah App – প্রতিটি আয়াতের বাংলা অর্থ সাথে সাথে দেখায়। অর্থ না জেনে মুখস্থ করলে ভুলে যান দ্রুত।৪. Quranera – বাংলা উচ্চারণসহ কুরআন। নতুনদের জন্য আলাদিনের চেরাগ।৫. Memorize Quran (by Bigitec) – এখানে “Gamification” আছে। প্রতিদিন পড়লে পয়েন্ট, লেভেল আপ। আমার এক ছাত্রী ৮ বছরের মেয়ে এই অ্যাপে আসক্ত হয়ে ২ জুজ মুখস্থ করে ফেলেছে।
৬. মেয়েদের জন্য বিশেষ টিপস (যেটা কেউ লেখে না)
- মাসিকের সময় কুরআন স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু মোবাইলে পড়া যায়। তাই এই ৭ দিন আপনি শুধু শুনুন ও মুখস্থ রিভিশন দিন।
- গর্ভাবস্থায় ক্লান্ত লাগলে শুয়ে শুয়ে Tarteel অ্যাপে পড়ুন। আল্লাহ এই আমলকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেন।
- বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কুরআন পড়লে বাচ্চার মস্তিষ্কে কুরআনের আয়াত ছাপ পড়ে। এটা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত।
৭. যারা চাকরি করেন, তাদের জন্য রাত ১২টার পরের রুটিন
অনেক ভাই-আপু বলেন, “দিনে সময় হয় না”। আমি তাদের জন্য “মিডনাইট মেথড” দিই:
- রাত ১২টা থেকে ১২:৩০ – তাহাজ্জুদ + নতুন ১০ আয়াত মুখস্থ
- ১২:৩০-১২:৪৫ – আগের দিনের রিভিশন
- ১২:৪৫-১টা – কুরআনের তাফসির শুনুন (নোমান আলি খান বা মুফতি মেনকের)
এক মাসে এই রুটিনে থাকলে আপনার দিনের বাকি ২৩ ঘণ্টা বরকতময় হয়ে যাবে।
৮. ৩০ দিনে নামাজের সব সূরা মুখস্থ করার চ্যালেঞ্জ
আমি আমার ছাত্রদের একটা ৩০ দিনের চ্যালেঞ্জ দিই:
দিন ১-৫: সূরা ফাতিহা + সূরা ইখলাসদিন ৬-১০: ফালাক + নাস + কাফিরুনদিন ১১-১৫: লাহাব + নসর + কাউসারদিন ১৬-২০: মাউন + কুরাইশ + ফিলদিন ২১-৩০: যিখলাস থেকে নাস পর্যন্ত সব একসাথে রিভিশন + সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত
৩০ দিন পর আপনি জামাতে দাঁড়ালে আর কখনো কারো পিছনে লাগতে হবে না।
৯. কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ার তিনটি গোপন আমল
১. প্রতিদিন একটি আয়াতের অর্থ পড়ে সারাদিন সেই আয়াত নিয়ে ভাবুন। যেমন আয়াতুল কুরসি পড়ে ভাবুন, “আল্লাহ সব দেখছেন, আমি কী করছি?”২. ফজরের নামাজের পর ১০ মিনিট কুরআনের সামনে বসে দোয়া করুন, “ইয়া আল্লাহ, আমাকে কুরআন বোঝার ও মানার তাওফিক দিন”৩. প্রতি জুমু’আয় একজনকে কুরআন শেখানোর চেষ্টা করুন। শেখানোর মাধ্যমে নিজের জ্ঞান পাকা হয়।
শেষ কথা
কুরআন শেখা কোনো কোর্স নয়, এটা জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক। আপনি যদি আজ থেকে শুরু করেন, তাহলে এক বছর পর যখন পুরো কুরআন খতম করবেন, তখন নিজেকে চিনতে পারবেন না। আল্লাহ আমাকে ও আপনাকে কুরআনের হাফেজ ও আমলকারী বানান। আমিন।
যদি আপনি এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলে ২০২৬ সালের রমজানে ইনশাআল্লাহ তারাবিহতে পুরো কুরআন শুনতে পারবেন নিজের মুখে। শুরু করুন আজ থেকেই। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।
