শিশুদের মাঝে ইসলামি মূল্যবোধ গড়ে তোলার উপায়

প্রিপারেশন

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

আজকের দ্রুতবর্ধনশীল ডিজিটাল যুগে শিশুদের মনে ইসলামি মূল্যবোধ গড়ে তোলা একইসাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব। টিভি, ইউটিউব, টিকটক, গেমিং অ্যাপ আর পিয়ার প্রেশারের ঝড়ের মধ্যে একটি শিশুকে আল্লাহর ভালোবাসা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ, সততা, দয়া, ধৈর্য ও তাকওয়ার পথে রাখা সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও নয়। এই লেখায় আমি এমন কিছু বাস্তবসম্মত, পরীক্ষিত ও একেবারেই অনন্য উপায় শেয়ার করব যেগুলো অন্য কোনো ব্লগে বা বইয়ে এভাবে একসাথে পাবেন না। লেখাটি দীর্ঘ হবে, কারণ বিষয়টি গভীর এবং আমি চাই আপনি শেষ পর্যন্ত পড়ে একটা পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ নিয়ে বের হন।

১. শিশুর জন্মের আগে থেকেই শুরু করুন

হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। ইসলামি মূল্যবোধ গঠন গর্ভাবস্থা থেকেই শুরু হয়।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক সন্তান ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে।” (বুখারি ও মুসলিম)। এই ফিতরাতকে অক্ষত রাখার দায়িত্ব বাবা-মায়ের।

গর্ভাবস্থায় মা যদি নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করেন, দরূদ শরীফ পড়েন, হালাল খান, গীবত-পরনিন্দা থেকে বাঁচেন, তাহলে সন্তানের রূহের উপর তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমি নিজে দেখেছি, যেসব মা গর্ভকালে প্রতিদিন সূরা মারইয়াম, সূরা ইউসুফ, সূরা লুকমান তিলাওয়াত করেছেন, তাদের সন্তানেরা ছোটবেলা থেকেই কুরআনের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এবং মিথ্যা বলতে ভয় পায়। এটা কোনো জাদু নয়, এটা রূহের খাদ্য।

২. বাড়িকে “মাদরাসাতুল উলা” বানান

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেকেই রাখাল এবং প্রত্যেকে তার রাখালের জন্য দায়ী।” বাড়ি হলো শিশুর প্রথম মাদরাসা।

অনেকে মনে করেন মাদরাসায় ভর্তি করলেই হলো। না। বাড়িতে যদি ইসলাম না থাকে, মাদরাসা দিয়ে কিছু হবে না। বাড়িতে যা শেখাবেন, মাদরাসা শুধু তাকে আরো মজবুত করবে।

কিছু ব্যবহারিক উপায়:

  • বাড়িতে কোনো টিভি চ্যানেল বা ইউটিউব ভিডিও চলবে না যেখানে গান বা হারাম দৃশ্য আছে। পরিবর্তে একটা আলাদা ট্যাব রাখুন যেখানে শুধু ইসলামি কার্টুন (ওমর সিরিজ, হুদহুদ, কালিলা ও দিমনা ইসলামি ভার্সন) থাকবে।
  • ঘরে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় “কুরআনের ঘর” হবে। সবাই বসবে, একটা পারা পড়া হবে। শিশু যদি ছোট হয় তাহলেও তাকে কোলে নিয়ে বসান। সে বুঝুক না বুঝুক, কুরআনের আওয়াজ তার কানে যাক।
  • বাড়ির দেওয়ালে শুধু ইসলামি ক্যালিগ্রাফি ও ছবিহীন ফ্রেম থাকবে। কোনো কার্টুন চরিত্র বা সুপারহিরোর পোস্টার থাকবে না।

৩. “খেলার মাধ্যমে দ্বীন” পদ্ধতি

শিশুরা খেলতে খেলতে শিখে। আমি নিজে আমার সন্তানদের সাথে এই পদ্ধতি ব্যবহার করি। কিছু উদাহরণ:

ক. সাহাবীদের নামে পুতুল বানানকাপড়ের পুতুল বানিয়ে তাদের নাম রাখুন আবু বকর, উমর, খালিদ, ফাতিমা। তারপর গল্প বলুন। “আজ আবু বকর রা. গরিবকে খাবার জন্য তার শেষ খেজুরটা দিয়ে দিলেন।” বাচ্চা নিজেই পরের দিন খেজুর দিতে চাইবে।

খ. “মসজিদ গেম”ঘরে একটা ছোট কার্পেট পেতে মসজিদ বানান। পুতুল দিয়ে জামাতে নামাজ পড়ান। যে পুতুল ইমামতি করবে সে আজ রাতে বাবার পাশে ঘুমাবে। দেখবেন বাচ্চারা লাইন ধরে দাঁড়াতে শিখে যাবে।

গ. “দানের বাক্স”একটা সুন্দর বাক্স রাখুন। প্রতিদিন বাচ্চা তার পকেটমানি থেকে একটা টাকা বা কয়েন দান করবে। মাসে একবার সেই টাকা দিয়ে গরিবকে কিছু কিনে দেবেন এবং বাচ্চাকে সাথে নেবেন। ৫ বছর বয়সেই সে বুঝে যাবে দানের আনন্দ।

৪. গল্পই হলো সবচেয়ে বড় হাতিয়ার

কিন্তু একই গল্প বারবার বললে বাচ্চারা বোর হয়। তাই আমি নিজে ১৫০+ নতুন গল্প তৈরি করেছি যেগুলো কোনো বইয়ে নেই। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি:

  • “ছোট্ট বেলালের বীজ” : বেলালাল রা. একটা বীজ পান। তিনি তা লাগান। অনেক কষ্টে গাছ বড় হয়। ফল আসার আগেই দুর্ভিক্ষ পড়ে। বেলাল রা. গাছ কেটে গরিবদের জন্য কাঠ দিয়ে দেন। আল্লাহ পরের বছর তার বাগানে হাজার গাছ দেন। (ধৈর্য ও কুরবানির গল্প)
  • “ফাতিমার জাদুর চাদর” : ফাতিমা রা. একটা পুরোনো চাদর পরেন। এক গরিব মহিলা এসে বলে, “আমার কোনো চাদর নেই।” ফাতিমা রা. নিজের চাদর খুলে দেন। রাতে ঘুমাতে গিয়ে ঠান্ডা লাগে। সকালে দেখেন তার আলনায় সবচেয়ে সুন্দর নতুন চাদর ঝুলছে। (আল্লাহ কখনো ত্যাগকারীকে খালি হাতে রাখেন না)

এই গল্পগুলো রাতে ঘুমানোর আগে বলুন। বাচ্চারা স্বপ্নেও সেটা দেখবে।

৫. মোবাইলকে শত্রু নয়, বন্ধু বানান

অনেকে মোবাইল পুরোপুরি কেড়ে নেন। ফলাফল উল্টো হয়। বাচ্চা বড় হয়ে প্রতিশোধ নেয়।

পরিবর্তে:

  • একটা পুরোনো ফোন নিন। সিম ছাড়া। তাতে শুধু ইসলামি অ্যাপ (Quran for Kids, Noorani Qaida Game, Little Muslim) ইনস্টল করুন।
  • প্রতিদিন ২০ মিনিট নির্দিষ্ট সময় দিন “ইসলামি স্ক্রিন টাইম”। এর বাইরে ফোন ছোঁা নিষেধ।
  • “কুরআন রেস” গেম খেলুন। যে আগে সূরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্থ বলবে, সে আজ আইসক্রিম পাবে। দেখবেন মুখস্থ করার গতি বেড়ে যাবে।

৬. বাবার ভূমিকা অপরিহার্য

মা যতই চেষ্টা করুন, বাবা যদি ফজরে না ওঠেন, টিভিতে গান শোনেন, মিথ্যা বলেন, তাহলে সব বৃথা।

বাবার করণীয়:

  • প্রতিদিন ফজরের নামাজ জামাতে পড়ে বাচ্চাকে কোলে করে বাড়ি ফিরবেন। বাচ্চা নিজ থেকেই ফজরে উঠতে চাইবে।
  • সপ্তাহে একদিন “বাবা-সন্তান দিন” পালন করুন। শুধু বাবা আর সন্তান। মসজিদে যাবেন, কবরস্থানে যাবেন, গরিবকে খাবার দেবেন। এই দিনে কোনো মোবাইল না।
  • বাড়িতে বাবাই কুরআন পড়বেন জোরে জোরে। বাচ্চারা বাবাকে অনুসরণ করে।

৭. শাস্তি নয়, ফলাফল শেখান

বাচ্চা মিথ্যা বললে চড়থাপ্পড় মারবেন না। বসান। বলুন, “যদি তুই মিথ্যা বলিস, তাহলে আল্লাহ তোর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবেন। তখন তুই দোয়া করবি, আল্লাহ শুনবেন না।”

একবার আমার ছেলে মিথ্যা বলেছিল। আমি তাকে নিয়ে গেলাম মসজিদে। বললাম, “এখন দোয়া কর।” সে দোয়া করল। আমি বললাম, “আল্লাহ এখন তোর দোয়া শুনছেন না কারণ তুই মিথ্যা বলেছিস।” সে কাঁদতে কাঁদতে তওবা করল। তারপর থেকে মিথ্যা বলার নাম নেয় না।

৮. স্কুল ও পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ন্ত্রণ

যদি স্কুলে হারাম কার্যক্রম (গানের প্রতিযোগিতা, মিক্সড ডান্স) থাকে, তাহলে সরাসরি প্রিন্সিপালের কাছে চিঠি লিখুন। আমি নিজে এভাবে তিনটা স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান থেকে গানের আয়োজন বন্ধ করিয়েছি।

পাড়ায় যদি খারাপ বাচ্চারা থাকে, তাদের সাথে খেলতে দেবেন না। পরিবর্তে নিজের বাড়িতে ইসলামি খেলার আয়োজন করুন। সবাই আপনার বাচ্চার সাথে খেলতে আসবে।

৯. নিজেকে আদর্শ বানান

শিশু যা দেখে তাই শিখে। আপনি যদি মোবাইলে টিকটক দেখেন আর বাচ্চাকে বলেন “কুরআন পড়”, সে কোনোদিন পড়বে না।

প্রতিদিন নিজে ১ পারা কুরআন পড়ুন। নিজে ফজরে উঠুন। নিজে সত্য বলুন। নিজে দান করুন। বাচ্চা নিজ থেকেই অনুসরণ করবে।

১০. দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প

  • ৭ বছর বয়সের মধ্যে পুরো কুরআন মুখস্থ করিয়ে দিন। সম্ভব। আমার মেয়ে ৬ বছর ৮ মাসে হেফজ সম্পূর্ণ করেছে।
  • ১২ বছরের মধ্যে সহি বুখারির ৫০০ হাদিস মুখস্থ করান।
  • ১৫ বছর বয়সে তাকে হজে নিয়ে যান। সে জীবনে ভুলবে না।

শেষ কথা

ইসলামি মূল্যবোধ গড়ে তোলা কোনো একদিনের কাজ নয়। এটা একটা জীবনব্যাপী সংগ্রাম। কিন্তু যদি আপনি আজ থেকে শুরু করেন, ইনশাআল্লাহ আপনার সন্তান কিয়ামতের দিন আপনার জন্য নূর হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন মানুষ মারা যায়, তার আমল বন্ধ হয়ে যায় তিনটি জিনিস ছাড়া... সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান এবং নেককার সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।”

আপনার সন্তানই আপনার সবচেয়ে বড় সদকায়ে জারিয়া হতে পারে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দিন। আমিন।

বিষয় : ইসলাম শিক্ষা