ইসলামি আদবকায়দা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
— প্রিপারেশন
আজকের দ্রুতগতির দুনিয়ায় আমরা অনেক কিছু শিখি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা, ভাষা, দক্ষতা। কিন্তু একটি বিষয় প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়, যে বিষয়টি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সুন্দর, সভ্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে নিয়ে যায়। সেটি হলো ইসলামি আদবকায়দা। আদব শব্দটির অর্থ শুধু শিষ্টাচার নয়, এর গভীরতা অনেক বেশি। এটি হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথে চলার কৌশল, মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারের শিল্প এবং নিজের নফসকে পরিশোধনের একটি মাধ্যম।
আজ আমি এই লেখায় একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব। সাধারণত আদব নিয়ে যে লেখা পড়া যায়, তাতে কিছু হাদীস উল্লেখ করে, কিছু নিয়ম বলে শেষ করা হয়। কিন্তু এখানে আমি চেষ্টা করব বোঝাতে যে, আদবকায়দা আসলে আমাদের জীবনের অক্সিজেন। এটি ছাড়া আমাদের সব ইবাদত, সব জ্ঞান, সব সফলতা ফিকে হয়ে যায়।
আদব ছাড়া ইবাদত অসম্পূর্ণ কেন?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সবচেয়ে কাছের লোক আমার কাছে সেদিন হবে যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।” (বুখারী ও মুসলিম)। এখানে লক্ষ করুন, নামাযের কথা বলেননি, রোজার কথা বলেননি, হজের কথা বলেননি। শুধু চরিত্রের কথা বলেছেন। কারণ চরিত্রই হলো আদবের ফসল।
একজন মানুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, কিন্তু তার মুখ থেকে গীবত বেরোয় না, পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না, বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ কথা বলে। তার নামায কি পূর্ণতা পাবে? আল্লাহ বলেন, “নামায মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।” যদি নামাযের পরও মানুষ খারাপ কাজ করে, তাহলে বোঝা গেল তার নামাযে আদবের আলো পৌঁছায়নি।
আদব হলো ইবাদতের রূহ। রূহ ছাড়া দেহ যেমন মৃত, আদব ছাড়া ইবাদত তেমনি নিষ্প্রাণ।
আধুনিক যুগে আদব শিক্ষার অভাবের ভয়াবহ ফল
আজকাল আমরা দেখি, একটি বাচ্চা পাঁচ বছর বয়সে মোবাইল চালাতে শিখে যায়, কিন্তু দশ বছরেও শিখতে পারে না যে বড়দের সঙ্গে কথা বলতে হলে আগে সালাম দিতে হয়। আমরা তাকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে দিই, কোচিং করাই, কিন্তু আদবের ক্লাসে পাঠাই না। ফল কী হচ্ছে?
১. পরিবারে শ্রদ্ধাবোধ লোপ পাচ্ছে
২. সমাজে সহানুভূতি কমে যাচ্ছে
৩. মসজিদেও শান্তি নেই, কাতারে ঝগড়া হচ্ছে
৪. সোশ্যাল মিডিয়ায় গালি দিয়ে নিজেকে মুসলমান ভাবা হচ্ছে
একটি ছোট ঘটনা বলি। সম্প্রতি একটি বিখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মসজিদে জুতা রেখে এসে দেখে তার জুতা অন্য এক ছাত্র নিয়ে গেছে। সে রাগে ফেসবুকে লিখল, “এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে তারা চোর।” লক্ষ লক্ষ লাইক পড়ল। কিন্তু কেউ বলল না, ভাই, আগে নিজের জুতা অন্য কারোটা ভেবে নিয়ে যাননি তো? এটাই আদবের অভাব।
আদব শিক্ষা কীভাবে জাতির চেহারা বদলে দিতে পারে?
জাপানের কথা সবাই বলে। কিন্তু আমরা কি জানি, জাপানে যে শিষ্টাচার শেখানো হয়, তার অনেক কিছুই আমাদের নবীর শেখানো আদবের সঙ্গে মিলে যায়? বাচ্চাকে শেখানো হয়, রাস্তায় কাগজ পড়লে কুড়িয়ে ফেলতে হবে, বড়দের সঙ্গে কথা বলার সময় নত হতে হবে, ট্রেনে চুপচাপ বসতে হবে। ফলাফল? একটি দেশ যার কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, সে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি।
যদি আমরা আমাদের বাচ্চাদের কুরআনের পাশাপাশি আদব শেখাতাম, তাহলে আজ বাংলাদেশের রাস্তায় পলিথিন পড়ে থাকত না, ট্রাফিক জ্যামে গালি দিতে হতো না, দোকানে লাইনবদ্ধভাবে দাঁড়াতে শিখতাম। একটি জাতি আদব শিখলে তার অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি সবকিছুতে শৃঙ্খলা আসে।
আদব শিক্ষা শুরু হবে কোথা থেকে?
১. ঘর থেকেমা-বাবা যদি নিজেরা ফোনে ঝুঁকে থাকেন, বাচ্চা কীভাবে শিখবে বড়দের সঙ্গে কথা বলতে? বাচ্চার প্রথম মাদরাসা হলো মায়ের কোল। সেখান থেকে শুরু হবে সালাম দেওয়া, হাসিমুখে কথা বলা, খাবার সময় বিসমিল্লাহ বলা, শুকরিয়া আদায় করা।
২. স্কুল-মাদরাসা থেকেশুধু কুরআন পড়ালে হবে না। কুরআনের আদব পড়াতে হবে। প্রতিদিন দশ মিনিটের একটা ক্লাস হতে পারে, “আজকের আদব”। যেদিন শেখাবেন, বাচ্চারা যেন বাড়িতে গিয়ে বাস্তবে প্রয়োগ করে।
৩. মসজিদ থেকেইমাম সাহেবরা জুমার খুতবায় শুধু রাজনীতি করবেন না, একটু সময় আদব নিয়েও বলবেন। মসজিদে কীভাবে প্রবেশ করবেন, কাতার সোজা করবেন, মোবাইল বন্ধ রাখবেন, এগুলো শেখাবেন।
৪. মিডিয়া থেকেআজকাল বাচ্চারা যতটুকু শিখছে, ইউটিউব আর টিকটক থেকে। যদি আমরা ভালো ভালো কনটেন্ট বানাই, যেখানে আদবকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে বাচ্চারা নিজে থেকেই শিখবে।
আদব শিক্ষার কিছু বাস্তব উদাহরণ যা আমরা ভুলে গেছি
আমরা অনেক কিছু জানি, কিন্তু প্রয়োগ করি না। কিছু উদাহরণ দিই:
অতিথি আসলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানানো। আজকাল বাসায় কেউ এলে আমরা বলি, “বসো, আমি চা বানাচ্ছি।” কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে দাঁড়িয়ে অতিথিকে বসাতেন।খাবার টেবিলে ছোটরা যেন আগে খেতে শুরু করে। আমরা বলি, “তুই বস, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।” অথচ হাদীসে আছে, ছোটদের আগে খাওয়ানো।কারো ভুল দেখলে সরাসরি বকা না দিয়ে সুন্দরভাবে বলা। আজ আমরা ফেসবুকে লিখি, “এই লোকটা মুনাফিক।” অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষের দোষ দেখায়, আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেবেন।”কথা বলার সময় চোখে চোখ রেখে বলা। আজকাল আমরা মোবাইল দেখতে দেখতে কথা বলি। এটা আদবের খেলাপ।
আদব শিখলে জীবনে কী কী লাভ হবে?
১. আল্লাহর বিশেষ ভালোবাসা পাওয়া যাবে
২. মানুষের মনে স্থান হয়ে যাবে
৩. দুনিয়া ও আখিরাত দুজায়গায়ই শান্তি আসবে
৪. দোয়া কবুলের রাস্তা সহজ হবে
৫. পরিবারে বরকত বাড়বে
৬. সমাজে সম্মান বাড়বে
৭. নিজের নফস পরিশোধিত হবে
শেষ কথা
ইসলামি আদবকায়দা শিক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি অপরিহার্য। এটি ছাড়া আমরা মুসলমান হতে পারি, কিন্তু মুমিন হতে পারি না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছিলেন পূর্ণতা দিতে। তিনি বলেছেন, “আমি তো শুধু একজন শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছি।” সেই শিক্ষার সবচেয়ে বড় অধ্যায় হলো আদব।
আজ থেকে শুরু করা যাক। নিজের থেকে। একটি ছোট কাজ দিয়ে। আজ বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে সালাম দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করব। প্রতিবেশীর সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলব। রাস্তায় কোনো কাগজ পড়ে থাকলে কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলব। দেখবেন, ছোট ছোট কাজ দিয়ে কীভাবে জীবনে বরকত নেমে আসে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যিকারের আদব শিখার এবং তা প্রয়োগ করার তাওফিক দিন। আমীন।