ইসলামে জ্ঞান অর্জনের প্রকৃত গুরুত্ব
— প্রিপারেশন বিডি
ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মূলে রয়েছে জ্ঞান। জ্ঞান ছাড়া ইবাদত অন্ধ অনুসরণে পরিণত হয়, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না, আর ব্যক্তি নিজের স্রষ্টাকে সঠিকভাবে চিনতে পারে না। আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিলের প্রথম আয়াতেই বলেছেন, “পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন” (সূরা আলাক : ১)। এই একটি আয়াতই প্রমাণ করে যে, ইসলামে জ্ঞান অর্জন কেবল গৌণ বিষয় নয়, বরং সবচেয়ে বড় ফরজ। এই লেখায় আমরা দেখব, কুরআন ও হাদীসের আলোকে জ্ঞানের প্রকৃত মর্যাদা কী, কোন ধরনের জ্ঞান সর্বোচ্চ মর্যাদা পায়, কেন মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের একটি বড় কারণ জ্ঞান থেকে বিমুখতা, এবং বর্তমান যুগে আমরা কীভাবে সেই হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারি।
কুরআনে জ্ঞানের মর্যাদা
কুরআনুল কারীমে প্রায় ৭৫০টিরও বেশি আয়াতে জ্ঞান, চিন্তা, পর্যবেক্ষণ, তাফাক্কুর, তাদাব্বুর, আকল ব্যবহারের কথা এসেছে। “আফালা তা’কিলূন”, “আফালা তাতাফাক্কারূন”, “আফালা তুবসিরূন” এই ধরনের প্রশ্নবোধক বাক্য কুরআনে বারবার এসেছে। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলাম কখনো অন্ধ বিশ্বাসের ধর্ম নয়। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে” (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)। এই আয়াতে “উলিল আলবাব” তথা জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা বলা হয়েছে। তারা কারা? যারা দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায়, শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা করে। অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তি কেবল যে লেখাপড়া জানে তাই নয়, বরং যে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত হলো, “আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা বহু উঁচু করে দেবেন” (সূরা মুজাদালা : ১১)। এখানে ঈমান ও ইলমকে একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ঈমান যদি জ্ঞান দ্বারা আলোকিত না হয়, তবে তা অন্ধকারে ডুবে যায়।
হাদীসে জ্ঞানের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর উপর ফরজ” (ইবনে মাজাহ : ২২৪, সহীহুল জামি : ৩৯১৪)। এই হাদীসটি সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত হয়। কিন্তু এর গভীরতা অনেকেই বোঝেন না। এখানে “তালাবুল ইলম” বলা হয়েছে। “তালাব” অর্থ খোঁজা, অনুসন্ধান করা। অর্থাৎ জ্ঞান কেবল মাদ্রাসায় বসে পাওয়া যায় না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে খুঁজতে হবে।
আরেকটি হাদীসে এসেছে, “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে কোনো পথে যাত্রা করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন” (মুসলিম : ২৬৯৯)। এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, জ্ঞানের পথে কষ্ট করা নিজেই ইবাদত।
জ্ঞানী ও অজ্ঞ ব্যক্তির তুলনা করে রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “জ্ঞানী ও ইবাদতকারীর মধ্যে যে পার্থক্য, আমার ও তোমাদের মধ্যে সর্বনিম্ন ব্যক্তির মধ্যে তার চেয়ে বেশি পার্থক্য” (তিরমিযী : ২৬৮৫)। অর্থাৎ একজন আলিমের মর্যাদা সাধারণ আবেদের চেয়েও বেশি। কারণ আবেদ নিজের জন্য ইবাদত করে, আর আলিমের জ্ঞানের দ্বারা হাজারো মানুষ হেদায়াত পায়।
কোন জ্ঞান সবচেয়ে উত্তম?
ইসলামে দুই ধরনের জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়া। ফরজে আইন হলো প্রত্যেকের জন্য যা জানা আবশ্যক। যেমন তাওহীদ, নামাজের নিয়ম, হালালহারামের মৌলিক জ্ঞান। আর ফরজে কিফায়া হলো সমাজের কিছু লোক জানলে অন্যদের থেকে দায়িত্ব উঠে যায়। যেমন চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশল, কৃষিবিদ্যা ইত্যাদি।
কিন্তু সবচেয়ে উত্তম জ্ঞান হলো আল্লাহর পরিচয় লাভের জ্ঞান। ইমাম গাযযালী রহ. বলেছেন, “যে জ্ঞান তোমাকে আল্লাহর দিকে নিয়ে যায় না, সে জ্ঞান বোঝা ছাড়া কিছু নয়।” তাই দুনিয়াবি জ্ঞান অর্জন করলেও তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয়, তার মূল্য খুবই কম।
ইতিহাসে মুসলিমদের জ্ঞানের স্বর্ণযুগ
আট থেকে তের শতক পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব ছিল জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ, কর্ডোভার লাইব্রেরি, কায়রোর আল আজহার, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাখ লাখ পুঁথি সংরক্ষিত ছিল। আল খারিজমীর অ্যালজেবরা, ইবনে সিনার মেডিসিন, আল বিরুনীর ভূগোল, ইবনে হাইসামের আলোকবিজ্ঞান, এই সবই ছিল কুরআনের “ইকরা” আদেশের ফল।
ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগে ডুবে ছিল, তখন মুসলিম বিজ্ঞানীরা গ্রিক দর্শনকে আরবিতে অনুবাদ করে তাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন। আজকের ইউরোপীয় রেনেসাঁসের বীজ অনেকাংশে মুসলিম স্পেন থেকে গিয়েছিল।
আজকের অধঃপতনের কারণ
দুর্ভাগ্যক্রমে আজ মুসলিম উম্মাহ জ্ঞানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে। ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী, আরব বিশ্বের ২২টি দেশে বছরে যে পরিমাণ বই প্রকাশ হয়, তার চেয়ে বেশি বই একা স্পেনে প্রকাশ হয়। মুসলিম দেশগুলোতে গবেষণার জন্য জিডিপির ০.২% এরও কম বরাদ্দ হয়, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া ব্যয় করে ৪.৫%।
এর কারণ কী? কয়েকটি বড় কারণ:
১. ধর্মীয় জ্ঞান ও দুনিয়াবি জ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
২. মাদ্রাসাকে আধুনিক শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
৩. জ্ঞান অর্জনকে “দুনিয়াবি” বলে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা।
৪. ঔপনিবেশিক শাসনের পর থেকে নিজস্ব জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলা।
বর্তমান যুগে কী করণীয়?
আজকের যুগে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ আগের চেয়ে অনেক বেশি। ইন্টারনেটের যুগে এক ক্লিকে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দরকার দিকনির্দেশনা। কয়েকটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ:
১. প্রতিটি মসজিদকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করা। শুধু নামাজ নয়, সেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতির আলোচনা হওয়া দরকার।
২. মাদ্রাসা ও স্কুলকলেজের পাঠ্যক্রমের সমন্বয়। আলিম যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং জানবে, তেমনি ইঞ্জিনিয়ারও আরবি ও ফিকহ শিখবে।
৩. মুসলিম তরুণদের গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করা। বিশেষ করে এমন গবেষণা যা উম্মাহর সমস্যার সমাধান করবে। যেমন পানি বিশুদ্ধকরণ, নবায়নযোগ্য শক্তি, ইসলামী ফিন্যান্স।
৪. মেয়েদের শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সে, যে তোমার মেয়েকে শিক্ষা দেয়।” আজকের মা যদি জ্ঞানী হয়, আগামী প্রজন্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্ঞানী হবে।
শেষ কথা
জ্ঞান কখনো শেষ হয় না। যে দিন মানুষ মনে করে সে সব জেনে ফেলেছে, সে দিন তার পতন শুরু হয়। ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, “আমি জীবনে কারো সঙ্গে বিতর্ক করিনি যে, সে যদি সত্য বলে প্রমাণ করতে পারে, আমি তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত।” এই মানসিকতাই আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।
ইসলামে জ্ঞান অর্জন কেবল বই পড়া নয়, বরং আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য উন্মোচন করা, নিজের নফসকে চেনা, সমাজের কল্যাণে কাজ করা। যে উম্মাহ একদিন “ইকরা” আদেশ নিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেছিল, সেই উম্মাহ আবার পারবে। শুধু দরকার সেই প্রথম শব্দটি আবার উচ্চারণ করা, “পড়!”
