আধুনিক শিক্ষায় ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির ভূমিকা

প্রিপারেশন

৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

আজকের বিশ্ব এক অভাবনীয় গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তাধারা ও সমাজব্যবস্থাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। এই দ্রুতগতির পরিবর্তনের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা, ডিজিটাল ক্লাসরুম, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ভিত্তিক শিক্ষণ, জিন সম্পাদনা, রোবোটিক্স, ব্লকচেইন প্রযুক্তি এবং নিউরাল নেটওয়ার্কের মতো বিষয়গুলো এখন শিক্ষাক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। কিন্তু এই আধুনিক শিক্ষার প্রবাহে মুসলিম সমাজ ও ব্যক্তি কোথায় দাঁড়াবে? কীভাবে আমরা আমাদের সন্তানদের এই নতুন জগতের জন্য প্রস্তুত করব, যেন তারা একই সাথে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে এবং ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়?

ইসলাম কখনো জ্ঞানার্জনের বিরোধী ছিল না। বরং জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছে। “ইকরা” (পড়) ছিল নবুয়তের প্রথম আদেশ। আধুনিক শিক্ষাকে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার অর্থ হলো, এই শিক্ষাকে কেবল প্রযুক্তিগত বা বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে না দেখে, একে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা।

আধুনিক শিক্ষার সংকট ও চ্যালেঞ্জ

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই বস্তুবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর মূল লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাজারের চাহিদা পূরণ এবং ব্যক্তিগত সাফল্য। এতে আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা ও পরকালের চেতনা অনুপস্থিত বা অত্যন্ত দুর্বল। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রায়শই প্রযুক্তি ও তথ্যে দক্ষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মূল্যবোধ, সহানুভূতি, ন্যায়বিচার ও আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনায় দুর্বল থেকে যায়।

আবার কিছু কিছু আধুনিক শিক্ষাক্রমে এমন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যা ইসলামের সুস্পষ্ট নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। যৌনশিক্ষার নামে অশ্লীলতার প্রসার, লিঙ্গ পরিচয়ের তরলতা, ডারউইনবাদের অন্ধ সমর্থন, ধর্মকে কুসংস্কার হিসেবে উপস্থাপন এসব বিষয় মুসলিম শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। তাই আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে এমনভাবে, যেন এর কল্যাণকর দিকগুলো আমরা নিতে পারি এবং ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। এখানেই ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে আধুনিক শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করতে পারে?

১. জ্ঞানের উদ্দেশ্য নির্ধারণইসলাম বলে, জ্ঞানার্জনের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহকে চেনা এবং তাঁর সৃষ্টির মাঝে তাঁর শক্তি ও সৌন্দর্যের চিহ্ন খুঁজে বের করা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পড়তে গিয়ে যদি একজন মুসলিম শিক্ষার্থী চিন্তা করে, “এই অ্যালগরিদম যিনি মানুষের মস্তিষ্কে এত জটিল চিন্তার ক্ষমতা দিয়েছেন, তিনিই তো সবচেয়ে বড় স্রষ্টা”, তাহলে তার শিক্ষা ইবাদতে পরিণত হয়। জিন সম্পাদনা পড়তে গিয়ে যদি সে মনে করে, “আল্লাহ যে নিয়মে ডিএনএ তৈরি করেছেন, আমি সেই নিয়ম বুঝতে চাই, যেন মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারি”, তাহলে তার গবেষণা সদকায়ে জারিয়াহ হয়ে যায়।

২. নৈতিকতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠাআধুনিক প্রযুক্তি নৈতিকতা ছাড়া ভয়ংকর অস্ত্রে পরিণত হতে পারে। ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি রাষ্ট্র গড়ে তোলা, ডিপফেক ভিডিও দিয়ে মিথ্যা প্রচার, জিন সম্পাদনা দিয়ে “ডিজাইনার বেবি” তৈরি এসবের বিরুদ্ধে ইসলামি নৈতিকতা একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। “যা নিজের জন্য পছন্দ কর, অন্যের জন্যও তাই পছন্দ কর” এই হাদিস ডেটা প্রাইভেসি আইনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি দিতে পারে।

৩. ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গঠনইসলাম শুধু বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি শিক্ষা দেয় না, পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শিক্ষা, চারিত্রিক শিক্ষা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ শিক্ষা দেয়। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার যদি প্রতিদিন ফজর পড়ে, কুরআন তিলাওয়াত করে, তার মা-বাবার খেদমত করে, তাহলে সে যে অ্যাপ তৈরি করবে, তাতে হারাম কন্টেন্টের প্রমোশন থাকবে না। তার কোডে সততা থাকবে, তার প্রোডাক্টে মানুষের কল্যাণের চিন্তা থাকবে।

৪. সমালোচনামূলক চিন্তার প্রশিক্ষণইসলাম কখনো অন্ধ অনুসরণ শেখায়নি। ইমাম গাজ্জালি, ইবনে সিনা, আল-বিরুনি, ইবনে রুশদের মতো বিজ্ঞানী-দার্শনিকরা গ্রিক দর্শনের সমালোচনা করেছেন, ভুল ধরিয়েছেন, নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। আজকের মুসলিম শিক্ষার্থীদেরকেও শেখাতে হবে, ডারউইনের তত্ত্ব পড়, কিন্তু সমালোচনামূলকভাবে পড়। বিগ ব্যাং থিওরি পড়, কিন্তু এটাও মনে রাখ, “আসমান ও জমিন যখন একসাথে ছিল, আমি তাদেরকে পৃথক করেছি” (সূরা আম্বিয়া : ৩০) এই আয়াতের সাথে এর কতটুকু মিল আছে, তা ভেবে দেখ।

বাস্তবায়নের পথ

১. শিক্ষাক্রমে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়মাদরাসার শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ করতে হবে, আবার আধুনিক স্কুলের শিক্ষাকে ইসলামি মূল্যবোধ দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। কম্পিউটার সায়েন্স পড়ানোর সময় শিক্ষক যদি বলেন, “তোমরা যে অ্যালগরিদম লিখছ, এটা আল্লাহর সৃষ্ট নিয়মের অনুকরণ মাত্র”, তাহলে শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে।

২. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণযে শিক্ষক নিজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বোঝেন না, তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীকে এর ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি শেখাবেন? তাই আধুনিক বিষয়ে দক্ষ এবং ইসলামি জ্ঞানে সমৃদ্ধ শিক্ষক তৈরি করতে হবে।

৩. পাঠ্যপুস্তক রচনাবর্তমানে বেশিরভাগ বিজ্ঞানের বই ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা। আমাদের দরকার এমন পাঠ্যপুস্তক, যেখানে বিজ্ঞানের তথ্যের পাশাপাশি কুরআন-হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, এমব্রায়োলজি পড়ানোর সময় সূরা মু’মিনুনের ১২-১৪ আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে।

৪. অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও কন্টেন্টইউটিউব, কোর্সেরা, উদেমির মতো প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষায় উচ্চমানের ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন কোর্স তৈরি করতে হবে। “ইসলামের আলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা”, “কুরআন ও আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা”, “ইসলামি অর্থনীতি ও ব্লকচেইন” এমন শিরোনামে কোর্স থাকলে তরুণরা আগ্রহ পাবে।

ভবিষ্যতের স্বপ্ন

যদি আমরা সফল হই, তাহলে আগামী দিনে দেখব:একজন মুসলিম সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত ব্যাংকিং সিস্টেম তৈরি করছে, কারণ সে জানে, মানুষের আমানতের হক নষ্ট করা কবিরা গুনাহ।একজন মুসলিম বায়োটেকনোলজিস্ট ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করছে, কারণ সে বিশ্বাস করে, মানুষের কষ্ট দূর করা ইবাদত।একজন মুসলিম ডেটা সায়েন্টিস্ট দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিচ্ছে, কারণ সে জানে, একজন মানুষের ক্ষুধাও দায়িত্ব তার।

এই হোক আমাদের স্বপ্ন। আধুনিক শিক্ষা আমাদের হাতে থাকবে, কিন্তু তার রূহ হবে ইসলামি। আমরা পিছিয়ে থাকব না, বরং বিশ্বকে পথ দেখাব। কারণ আমরা সেই উম্মত, যাদেরকে আল্লাহ “খায়েরা উম্মাহ” বলে সম্বোধন করেছেন।

বিষয় : ইসলাম শিক্ষা