ইসলামি শিক্ষায় চরিত্র গঠনের ধাপসমূহ

প্রিপারেশন

৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

ইসলামি শিক্ষায় চরিত্র গঠনের ধাপসমূহ

ইসলামি শিক্ষায় চরিত্র গঠনের ধাপসমূহ

ইসলাম যখন এসেছিল, তখন আরবের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় অভাব ছিল না মসজিদ, না হজ, না যাকাতের বিধান; বরং ছিল সুন্দর চরিত্রের। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ঘোষণা করেছেন: إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ “আমি তো কেবল সুন্দর চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।” (মুয়াত্তা মালিক, বায়হাকী)

এই একটি হাদিসই প্রমাণ করে যে, নামায-রোযা-হজ-যাকাত সবই চরিত্রের জন্য ভিত্তি, আর চরিত্রই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। যদি চরিত্র না থাকে, তবে বাহ্যিক আমলগুলো কেবল খোলস হয়ে থাকে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন: أَتْدُرُونَ أَفْلَسُ مَنِ الْمُفْلِسُ؟ قَالُوا: مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ. فَقَالَ: إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا... “তোমরা কি জানো সবচেয়ে বড় দেউলিয়া কে? সাহাবীগণ বললেন, যার কাছে দিরহাম-দীনার ও সম্পদ নেই। তিনি বললেন, না। আমার উম্মতের দেউলিয়া সেই ব্যক্তি যে কিয়ামতে নামায, রোযা, যাকাত নিয়ে আসবে, কিন্তু এই লোককে গালি দিয়েছে, এর ইজ্জত নষ্ট করেছে, এর মাল খেয়েছে… শেষে তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, অন্যের পাপ তার ঘাড়ে চাপবে, আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (মুসলিম)

এই হাদিস প্রমাণ করে, চরিত্রই হলো আমাদের প্রকৃত পুঁজি। বাকি সব আমল তার সুদ।

আধুনিক যুগে মুসলিম যুবকের চরিত্র সংকটের বাস্তব চিত্র

আজকের মুসলিম যুবসমাজের অবস্থা দেখুন:

  • দাড়ি-টুপি, নামায-কুরআন আছে, কিন্তু মিথ্যা, ব্যাকবাইটিং, পর্নোগ্রাফি আসক্তি, মা-বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার, স্ত্রীর প্রতি অবিচার, সোশ্যাল মিডিয়ায় গিবতের মহড়া।
  • একজন যুবক রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে, সকালে অফিসে ঘুষ নেয়।
  • মসজিদের প্রথম কাতারে দাঁড়ায়, কিন্তু বাড়িতে এলে স্ত্রীকে গালি দেয়।
  • কুরআনের হাফেজ, কিন্তু তার জিহ্বা মানুষের ইজ্জত কেড়ে নেয়।

এই দ্বৈত চরিত্রের রোগ এতই ভয়াবহ হয়েছে যে, অনেক অমুসলিম বলে, “ইসলাম ভালো, কিন্তু মুসলমানদের দেখে ভয় লাগে।”এটা আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আমরা দাওয়াহ দিই, কিন্তু আমাদের চরিত্রই সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই লেখার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি

এই লেখার উদ্দেশ্য কোনো তত্ত্বকথা নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ দেওয়া, যাতে একজন সাধারণ মুসলিম (ছাত্র, চাকরিজীবী, গৃহিণী, ব্যবসায়ী) ধাপে ধাপে নিজের চরিত্রকে রাসূল (সা.)-এর চরিত্রের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।

আমরা এখানে কোনো সাধারণ কথা বলব না যা হাজার ব্লগে আছে। আমরা শুধু কুরআন-হাদিস-সাহাবা-তাবেয়ীদের বাস্তব জীবন থেকে প্রমাণিত, ধাপে ধাপে ব্যবহারিক পদ্ধতি দেব। এটা হবে একটা “চরিত্র গঠনের ট্রেনিং প্রোগ্রাম”, যা আপনি জীবনে কার্যকর করতে পারবেন।

চরিত্রের সংজ্ঞা: কুরআন ও হাদিসের আলোকে

“খুলুক” শব্দের গভীর তাৎপর্য

আরবি ভাষায় “খুলুক” শব্দটি এসেছে “খালাকা” থেকে, যার অর্থ সৃষ্টি করা। কিন্তু “খুলুক” মানে সেই সৃষ্টি যা মানুষের ভেতরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়, যা বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে তার স্বভাবে পরিণত হয়।ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেন:“খুলুক হলো এমন এক অবস্থা আত্মার, যেখান থেকে আমলসমূহ সহজে, বিনা চিন্তায়, বিনা কষ্টে বের হয়ে আসে।” (ইহয়া উলুমুদ্দিন)

অর্থাৎ যখন কেউ মিথ্যা বলতে গিয়ে কষ্ট পায়, সত্য বলতে গিয়ে আনন্দ পায়, তখন বুঝতে হবে তার মধ্যে সত্যবাদিতার খুলুক তৈরি হয়েছে।

রাসূল (সা.)-এর চরিত্রকে কুরআন যেভাবে “আজীম” বলেছে

আল্লাহ তাআলা বলেন: وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ “আর নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।” (সূরা কলম: ৪)

হযরত আয়েশা (রা.)-কে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, রাসূল (সা.)-এর চরিত্র কেমন ছিল? তিনি বললেন: كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ “তাঁর চরিত্রই ছিল কুরআন।” (মুসনাদ আহমাদ, সহীহ)

অর্থাৎ কুরআনের যা কিছু আদেশ, তিনি তাই করতেন। যা নিষেধ, তিনি তা থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতেন। কুরআন যেভাবে ক্ষমা করতে বলেছে, তিনি তাই করেছেন। যেভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছে, তিনি তাই করেছেন। এজন্যই তাঁর চরিত্রকে আল্লাহ “আজীম” বলেছেন।

বাহ্যিক আমল ও অভ্যন্তরীণ চরিত্রের পার্থক্য

অনেকে মনে করেন, নামায পড়লেই চরিত্র হয়ে যায়। কিন্তু ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন:“আমল দুই প্রকার:এক. শারীরিক আমল (নামায, রোযা)দুই. অন্তরের আমল (ইখলাস, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর, হায়া, তাকওয়া)

শারীরিক আমল যদি অন্তরের আমলের সাথে না মিলে, তবে তা প্রত্যাখ্যাত।”

উদাহরণ: এক ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, কিন্তু তার মুখে মিথ্যা, চোখে পর্ন, হাতে ঘুষ। তার নামায তার চরিত্রের জন্য কোনো ফায়দা দিচ্ছে না।আরেকজন হয়তো শারীরিকভাবে দুর্বল, কিন্তু তার অন্তরে আল্লাহর ভয়, মানুষের জন্য দয়া, সত্যের প্রতি ভালোবাসা আছে। তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি।

তাই চরিত্র গঠনের প্রথম ধাপ হলো এই সত্য উপলব্ধি করা যে, আমল যতই হোক, যদি অন্তর পরিশুদ্ধ না হয়, তবে কিছুই হবে না।

চরিত্র গঠনের প্রাক-শর্তসমূহ

ইসলামি শিক্ষায় চরিত্র গঠন কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত বৃক্ষ যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত না হলে কখনো ফল ধরবে না। এই শিকড়ই হলো কতগুলো প্রাক-শর্ত, যেগুলো ব্যতীত চরিত্রের ভবন নির্মাণ শুরুই করা যায় না।

আন্তরিক নিয়ত ও তাওবার গুরুত্ব

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ” “সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। ”চরিত্র গঠনের প্রথম শর্ত হলো, আমি কেন সুন্দর চরিত্র অর্জন করতে চাই? শুধু মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য? নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য? যদি নিয়ত শতভাগ খালেস না হয়, তবে সব আমল বৃথা। প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর একটি মাত্র দোয়া করুন: “আল্লাহুম্মা হাদিনি লি হুসনিল খুলুকি ওয়া কাফফানি আন সাইয়্যিইহি” (হে আল্লাহ! আমাকে সুন্দর চরিত্রের হিদায়াত দাও এবং খারাপ চরিত্র থেকে আমাকে দূরে রাখো।)

তাওবা ছাড়া চরিত্র গঠন অসম্ভব। ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি গুনাহের সাগরে ডুবে আছে, তার অন্তর এমন কালো হয়ে যায় যে, সেখানে ভালো কিছু উদ্ভিদ জন্মাতে পারে না। ” তাই প্রথমে তাওবাতুন নাসূহা করতে হবে। তাওবার বাস্তব পদ্ধতি:

১. গুনাহের কথা স্মরণ করে লজ্জাবোধ করা

২. সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করা৩. ভবিষ্যতে না করার দৃঢ় সংকল্প

৪. যার সাথে অত্যাচার করা হয়েছে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া (যদি সম্ভব হয়)

সঠিক আকিদা ছাড়া চরিত্র গঠনের অসম্ভবতা

অনেকে মনে করেন, ভালো মানুষ হতে গেলে শুধু ভালো কাজ করলেই হলো। কিন্তু ইসলাম বলে, চরিত্রের মূল ভিত্তি হলো আকিদা। যদি আল্লাহকে সঠিকভাবে না চিনি, তবে কার জন্য আমি রিয়া করব না? কার ভয়ে আমি মিথ্যা বলব না?ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, “যার আকিদা বিশুদ্ধ নয়, তার আমল কখনো বিশুদ্ধ হয় না।”তাই চরিত্র গঠনের আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন:আমি কি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমার অন্তরের খবর রাখেন?আমি কি বিশ্বাস করি মৃত্যুর পর হিসাব হবে?এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি দুর্বল হয়, তবে আগে কিতাবুত তাওহীদ, আকিদাতুত তাহাবী পড়ে আকিদা শক্ত করুন।

শৈশব থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া

রাসূল (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে।” এই ফিতরাত নষ্ট না করে যদি শৈশব থেকেই চরিত্রের বীজ বপন করা যায়, তবে কিশোর বয়সে গাছ হয়ে যায়।আজকাল বাবা-মা সন্তানকে কুরআন মুখস্থ করান, কিন্তু “আসসালামু আলাইকুম” বলতে শেখান না। ফলাফল: হাফেজ হয়, কিন্তু চরিত্রহীন।শিশুদের জন্য প্রথম পাঠ:

১. আল্লাহ দেখছেন – এই বোধ

২. মিথ্যা বললে জাহান্নাম – এই ভয়

৩. সত্য বললে জান্নাত – এই লোভ

এই তিনটি শৈশবে দিলে পরবর্তীতে তাকওয়া সহজ হয়।

প্রথম ধাপ: আত্ম-জ্ঞান ও আত্ম-সমালোচনা

চরিত্র গঠনের প্রথম সিঁড়ি হলো নিজেকে চেনা। রাসূল (সা.) বলেছেন,“মান আরাফা নাফসাহু ফাকদ আরাফা রাব্বাহু”“যে নিজেকে চিনল, সে তার রবকে চিনল।”অনেকে আল্লাহকে খুঁজতে আসমান-জমিনে ছোটাছুটি করে, কিন্তু নিজের অন্তরের কালো দাগ দেখে না।

“মান আরাফা নাফসাহু…” হাদিসের ব্যবহারিক প্রয়োগ

এই হাদিসটি শুধু তাসাউউফের কিতাবের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ১০ মিনিট বসে নিজেকে প্রশ্ন করুন:আজ আমি কোন কাজটি শুধু আল্লাহর জন্য করেছি? কোন কাজটি শুধু লোক দেখানোর জন্য করেছি?কোন গুনাহ আমি ইচ্ছা করে করেছি? এই তিন প্রশ্নের লিখিত উত্তর দিন। এক মাস পর দেখবেন, আপনার অন্তরের আয়না পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।

প্রতিদিনের মুহাসাবা পদ্ধতি (উমর রা.-এর নিয়ম)

হযরত উমর (রা.) প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজের নাফসকে বলতেন,“হে উমর! আজ তুমি কী করেছ? কোন ভালো কাজ করেছ যা আগে করোনি? কোন খারাপ কাজ ত্যাগ করেছ যা আগে করতে?”এই মুহাসাবার বাস্তব পদ্ধতি:

১. একটি ছোট ডায়েরি রাখুন। নাম দিন “কিতাবুল মুহাসাবা”

২. প্রতিদিন তিন কলামে লিখুন:

  • শুকরিয়া (আজ কী কী নেয়ামত পেয়েছি)
  • গুনাহ (আজ কী কী গুনাহ করেছি)
  • সংকল্প (আগামীকাল কোন একটি গুনাহ ছাড়ব)

৩. প্রতি শুক্রবার পুরো সপ্তাহের হিসাব মিলিয়ে দেখুন।

নিজের দোষগুলো লিখিতভাবে চিহ্নিত করার কৌশল

অধিকাংশ মানুষ নিজের দোষ দেখে না, কারণ তারা তা লিখে রাখে না। একটি কাগজে লিখুন আপনার সবচেয়ে বড় ১০টি দোষ। উদাহরণ:

১. রাগ

২. মিথ্যা

৩. অহংকার

৪. হিংসা

৫. পর্নোগ্রাফি

এরপর প্রতিটি দোষের পাশে লিখুন: এই দোষ আমার জান্নাতের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তারপর প্রতিদিন একটি দোষ নিয়ে কাজ করুন। ১০ মাসে ১০টি দোষ থেকে মুক্তির পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবেন ইনশা আল্লাহ।

দ্বিতীয় ধাপ: ইখলাসের প্রশিক্ষণ

ইখলাস হলো চরিত্র গঠনের মেরুদণ্ড। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ “সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (বুখারি ও মুসলিম)যতক্ষণ পর্যন্ত আমল আল্লাহর জন্য খাঁটি না হবে, সে আমল চরিত্রে কোনো গভীর প্রভাব ফেলতে পারবে না।

রিয়া থেকে মুক্তির তিনটি স্তর

ইবনুল কাইয়িম (রহ.) “মাদারিজুস সালিকীন” গ্রন্থে রিয়াকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। এই স্তরগুলো ধরে ধরে পরিষ্কার করতে হয়:

১. রিয়ায়ে জলি (স্পষ্ট রিয়া): মানুষ দেখবে বলে নামায পড়া, দাড়ি রাখা, পাগড়ি পরা। এটা শিরকের সবচেয়ে বড় ধরন।

২. রিয়ায়ে খফি (গোপন রিয়া): মানুষ দেখুক বা না দেখুক, নিজের মনে গর্ব হয় যে “আমি কত ভালো কাজ করি”। এটা নফসের সূক্ষ্ম রোগ।

৩. রিয়ায়ে আখফা (অতি গোপন): নিজের আমলের প্রতি ভালোবাসা ও গর্ব যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ দেখুক বা না দেখুক।

এটি পরিষ্কার করা সবচেয়ে কঠিন।

ছোট ছোট গোপন আমলের মাধ্যমে ইখলাস অর্জন

ইখলাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ট্রেনিং হলো এমন আমল করা যা কেউ কখনো জানবে না। ব্যবহারিক কিছু উদাহরণ:

  • রাতের শেষ প্রহরে ২ রাকাত নফল পড়ে কাউকে না বলা
  • কারো ফ্রিজে গোপনে টাকা রেখে আসা (যেভাবে আলী ও ফাতিমা (রা.) করতেন)
  • মসজিদের বাথরুম পরিষ্কার করা, কেউ না দেখলেও
  • মুঠোফোনে কাউকে দোআ করে মেসেজ না দিয়ে শুধু মনে মনে করা
  • কুরআনের একটি আয়াত শুধু আল্লাহর জন্য ১০০ বার পড়া, কাউকে না জানিয়ে

এই গোপন আমলগুলো যখন বারবার করা হয়, তখন নফস বুঝতে শেখে যে আমল শুধু আল্লাহর জন্যই করা যায়।

ইবনুল কাইয়িম (রহ.)-এর ব্যবহারিক উদাহরণ

ইবনুল কাইয়িম বলেছেন, যখন কোনো ভালো কাজের ইচ্ছা হবে, তখন নিজেকে প্রশ্ন করো:“যদি এই কাজটি কেউ কখনো প্রশংসা না করত, তাহলেও কি আমি এটা করতাম?”যদি উত্তর “হ্যাঁ” হয়, তবেই করো। যদি মনে একটুও খটকা লাগে, তবে স্থগিত করো। এটি দীর্ঘদিন করলে ইখলাস আপনাআপনি চলে আসে।

তৃতীয় ধাপ: তাকওয়ার স্তরভিত্তিক বিকাশ

তাকওয়া হলো চরিত্রের শক্ত ভিত্তি। কুরআনে এসেছে: يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো।” (আলে ইমরান ১০২)

তাকওয়ার চারটি স্তর (ইমাম গাযযালী ও ইবনে তাইমিয়া থেকে সংকলিত)

১. তাকওয়াতুল আউয়াম (সাধারণের তাকওয়া): শিরক ও কুফর থেকে বেঁচে থাকা২. তাকওয়াতুল খাওয়াস (বিশেষদের তাকওয়া): কবিরা গুনাহ ত্যাগ করা৩. তাকওয়াতুল আখয়ার (সর্বোত্তমদের তাকওয়া): সগিরা গুনাহ ত্যাগ করা৪. তাকওয়াতুল আবরার (আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের তাকওয়া): মুবাহ কাজেও আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর দিকে মন না দেওয়া

গুনাহ ত্যাগের ক্রমিক পদ্ধতি

চরিত্র গঠনে হঠাৎ সব গুনাহ ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। ধাপে ধাপে করতে হয়:

প্রথম বছর: কবিরা গুনাহ (যিনা, সুদ, মিথ্যা, গিবত, পিতা-মাতার অবাধ্যতা) পুরোপুরি বন্ধ করার লক্ষ্য।দ্বিতীয় বছর: সগিরা গুনাহ (অপ্রয়োজনে হাসা, দৃষ্টি অবনত না রাখা, অপচয়) কমিয়ে আনা।তৃতীয় বছর: মুবাহ কাজের অপচয় বন্ধ (অতিরিক্ত ঘুম, অতিরিক্ত খাওয়া, অতিরিক্ত কথা)।চতুর্থ বছর: সন্দেহজনক বিষয় (যেগুলো হালাল-হারামের মাঝামাঝি) থেকে দূরে থাকা।

হারাম থেকে শুভঙ্করী → মাকরুহ → মুবাহের সন্দেহজনক বিষয়

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হারাম ছেড়ে শুধু হালাল খায়, তার পরবর্তী ধাপ হলো শুভঙ্করী (যা হালাল কিন্তু উত্তম নয়) ছেড়ে দেওয়া। উদাহরণ:

  • হারাম: সুদের টাকায় খাওয়া
  • হালাল কিন্তু শুভঙ্করী: অন্যের টাকায় জাঁকজমকপূর্ণ খাবার খাওয়া
  • মাকরুহ: অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া যা শরীরের ক্ষতি করে
  • সন্দেহজনক: এমন দোকান থেকে খাবার কেনা যেখানে হালাল-হারাম মিশে যায়

যখন একজন মানুষ এই ধাপগুলো পার হয়, তখন তার অন্তরে তাকওয়া এত গভীর হয় যে গুনাহের চিন্তাও তার কাছে কষ্টকর লাগে। এটাই হলো চরিত্রের সবচেয়ে মজবুত স্তর।

এই দুটি ধাপ (ইখলাস ও তাকওয়া) যদি কেউ আয়ত্ত করতে পারে, তবে পরবর্তী ধাপগুলো তার জন্য সহজ হয়ে যায়। এই দুটির উপরই পুরো চরিত্র গঠনের ভবন দাঁড়িয়ে থাকে।

চতুর্থ ধাপ: সুন্দর আখলাকের দৈনন্দিন অনুশীলন

এই পর্যায়ে আমরা আর শুধু নিয়ত বা তাকওয়ার কথা বলি না। এখানে শুরু হয় প্রকৃত রিয়াজাত তথা কায়িক ও বাক্যিক অনুশীলন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ “আমি তো কেবল সুন্দর চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।” (মুয়াত্তা মালিক, হাকিম)

হাসি, সালাম, ক্ষমা ও দানের নিয়মিত রিয়াজাত

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে একটি “আখলাক টার্গেট” দিন। উদাহরণ:

  • আজ আমি কমপক্ষে ৪০ জনকে হাসিমুখে সালাম দিব।
  • যে কেউ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, আমি তার জবাবে শুধু “জাযাকাল্লাহু খাইরান” বলব।
  • বাড়ির কাজের লোককে বা রিকশাওয়ালাকে আজ অতিরিক্ত ৫০ টাকা বকশিশ দিব শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

ইবনে মুবারক (রহ.) বলতেন, “যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার কাউকে ক্ষমা করে, তার চরিত্র এক বছরে আবু বকর (রা.)-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায়।”

রাগ নিয়ন্ত্রণের রাসূল (সা.)-এর তিনটি অভ্রান্ত কৌশল

১. অবস্থান পরিবর্তন: দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়া, বসে থাকলে শুয়ে পড়া। (বুখারি ৫৬৪৮)

২. ওযু করা: “রাগ শয়তানের আগুন, পানি দিয়ে তা নিভিয়ে ফেল।” (আবু দাউদ ৪৭৮৪)

৩. নীরবতা: একবার এক লোক রাসূল (সা.)-কে গালি দিচ্ছিল, তিনি চুপ ছিলেন। আয়েশা (রা.) রাগ করে উত্তর দিতে গেলে রাসূল (সা.) বললেন, “আয়েশা! যে ব্যক্তি রাগের সময় চুপ থাকে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করেন।” (তাবারানি)

ব্যবহারিক টিপ: রাগ এলে মনে মনে ১০ বার পড়ুন: أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي وَأَذْهِبْ غَيْظَ قَلْبِي

সম্পর্কের ক্রমান্বয়ে আখলাক প্রয়োগ

চরিত্র গঠনের সবচেয়ে বড় মাঠ হলো পারিবারিক জীবন। ক্রম দাঁড়ায় এরকম:

১. পিতা-মাতা → ২. স্ত্রী/স্বামী → ৩. সন্তান → ৪. ভাই-বোন → ৫. প্রতিবেশী → ৬. কর্মচারী/সহকর্মী → ৭. অপরিচিত মানুষ

প্রতি সপ্তাহে একটি সম্পর্ককে “ফোকাস” করুন। যেমন এই সপ্তাহ মায়ের সাথে কথা বলার সময় চোখে চোখ রেখে, হাসি মুখে, নরম স্বরে কথা বলব। পরের সপ্তাহ স্ত্রীর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ প্রকাশ করব। এভাবে ধীরে ধীরে পুরো বৃত্তটা ঢেকে ফেলুন।

পঞ্চম ধাপ: কুরআনের সাথে জীবন্ত সম্পর্ক গড়ে তোলা

ইমাম নববী (রহ.) বলতেন, “যে ব্যক্তির সাথে কুরআনের সম্পর্ক নেই, তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই।” চরিত্র গঠনের এই ধাপে কুরআন আর শুধু পড়ার জিনিস থাকে না, হয়ে যায় জীবনের প্রতিটি ক্ষণের সঙ্গী।

চার স্তরের কুরআনী সম্পর্ক

১. তিলাওয়াত: সঠিক তাজবিদে পড়া

২. তাদাব্বুর: অর্থসহ গভীর চিন্তা

৩. তাৎসিল: নিজের জীবনে প্রয়োগ

৪. তাযক্কুর: সারাদিন সেই আয়াতের কথা মনে রাখা ও অনুভব করা

“এক আয়াত এক রাত” পদ্ধতি

প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের আগে একটি মাত্র আয়াত নিয়ে বসুন। পদ্ধতি:

  • ১০ বার উচ্চারণ করুন
  • বাংলা ও আরবি তাফসির পড়ুন (তাফসিরে জালালাইন + তাফসিরে ইবনে কাসির)
  • চোখ বন্ধ করে নিজের জীবনের সেই আয়াতের বিপরীত কোনো ঘটনা স্মরণ করুন
  • আল্লাহর কাছে কাঁদতে কাঁদতে দোয়া করুন: “ইয়া আল্লাহ! এই আয়াতকে আমার চরিত্রে পরিণত করে দাও।”

উদাহরণ: সূরা হুজুরাতের ১১ নং আয়াত«يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ...»যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম বানিয়ে মানুষের প্রতি ব্যঙ্গ করে, তারা এই একটি আয়াত নিয়ে ৭ দিন বসলে জীবন বদলে যাবে ইন শা আল্লাহ।

কুরআন কীভাবে চরিত্রে প্রবাহিত হয়: হযরত উসমান (রা.)-এর বাস্তব উদাহরণ

উসমান (রা.) যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন, তখন তিনি আয়াত পড়তে পড়তে কাঁদতেন এবং বলতেন, “এই আয়াত যদি আমার অন্তরে প্রবেশ না করে, তবে আমার তিলাওয়াত বৃথা।”একবার একজন তাঁকে বলল, “আপনি তো এত দান করেন, তবু কেন এত কাঁদেন?”উসমান (রা.) উত্তর দিলেন, “আমি যত টাকা দান করি, তার চেয়ে বেশি দান করি আমার নফসের খাহেশকে মেরে ফেলে। এটাই সবচেয়ে বড় দান।”

আধুনিক প্রেক্ষাপটে: আপনি যদি প্রতিদিন সূরা আল-আসর পড়ে নিজেকে বলেন, “আজ আমি সময় নষ্ট করব না, সৎকাজে উৎসাহ দেব”, তাহলে এক মাসের মধ্যে আপনার চরিত্রে শৃঙ্খলা চলে আসবে।

ষষ্ঠ ধাপ: সাহাবা-তাবেয়ীদের জীবনী থেকে বাস্তব প্রশিক্ষণ

সাহাবা ও তাবেয়ীদের জীবনী কেবল পড়ার বিষয় নয়, এটা একটা জীবন্ত ট্রেনিং প্রোগ্রাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, خير الناس قرني، ثم الذين يلونهم، ثم الذين يلونهم “সর্বোত্তম মানুষ আমার যুগের, তারপর যারা তাদের পরে, তারপর যারা তাদের পরে।” (বুখারী ও মুসলিম)

তাই চরিত্র গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী ধাপ হলো প্রতি সপ্তাহে একজন সাহাবি বা তাবেয়ীর জীবনী গভীরভাবে পড়া এবং তাঁর একটি বিশেষ গুণকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা।

প্রতি সপ্তাহে একজন সাহাবির জীবনী পড়া ও একটি গুণ গ্রহণের পদ্ধতি

  1. রবিবার রাতে বা সোমবার সকালে একজন সাহাবির নাম নির্বাচন করুন।
  2. সপ্তাহজুড়ে তাঁর জীবনীর অন্তত ৩টি নির্ভরযোগ্য সোর্স পড়ুন (যেমন: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, উসুদুল গাবা, সিয়ার আলামিন নুবালা)।
  3. একটি মাত্র গুণ বেছে নিন (যেমন: আবু বকরের সত্যবাদিতা, উমরের হায়া, উসমানের লজ্জা, আলীর ইলম, খালিদের সাহস, আবু উবাইদাহর আমানতদারিতা)।
  4. সেই গুণটি সপ্তাহের প্রতিদিন ৭ বার বাস্তবে প্রয়োগ করার টার্গেট রাখুন।
  5. শুক্রবার রাতে নিজের পারফরম্যান্স লিখিতভাবে মূল্যায়ন করুন।
  6. পরের সপ্তাহে নতুন সাহাবি ও নতুন গুণ।

কয়েকটি সাহাবির গুণ ও বাস্তব অনুসরণের উদাহরণ

  • আবু বকর (রা.): সিদ্দিকিয়াত (পরম সত্যবাদিতা)বাস্তব অনুশীলন: সপ্তাহে একবারও মিথ্যা না বলা, এমনকি মজা করেও নয়। ছোট্ট সাদা মিথ্যা (white lie) ধরা পড়লে তওবা করে সত্য বলে দেয়া।
  • উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.): হায়া ও আত্মসম্মানবাস্তব অনুশীলন: কথায় ও পোশাকে লজ্জার সীমা টপকে যাওয়া থেকে বিরত থাকা। কারো সামনে গীবত হলে “আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন” বলে চুপ করে যাওয়া।
  • উসমান ইবনে আফফান (রা.): লজ্জাশীলতা ও দানশীলতাবাস্তব অনুশীলন: প্রতিদিন গোপনে একটি সদকা দেয়া, যাতে বাম হাতও না জানে। রাতে কুরআন তিলাওয়াতে এত লজ্জা যে এক রাতে পুরো কুরআন খতম করতেন।
  • আলী ইবনু আবি তালিব (রা.): ইলম ও হিকমাহবাস্তব অনুশীলন: প্রতিদিন ১০ মিনিট তাফসীর বা হাদিসের শরহ পড়া এবং সেদিনের কোনো ঘটনায় তার প্রয়োগ করা।
  • খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.): সাহস ও কৌশলবাস্তব অনুশীলন: যে কাজটি ভয়ে করতে চান না (দাওয়াহ দেয়া, অন্যায়ের প্রতিবাদ), সেটি সপ্তাহে অন্তত ৩ বার করা।
  • আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা.): আমানতদারিতাবাস্তব অনুশীলন: অন্যের জিনিস, টাকা, গোপন কথা – সবকিছুতে আমানতের চূড়ান্ত হেফাজত।

এভাবে এক বছরে ৫২ জন সাহাবির ৫২টি গুণ নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা করলে চরিত্রে বিপ্লব আসবে ইন শা আল্লাহ।

সপ্তম ধাপ: সঠিক সঙ্গ ও পরিবেশ নির্বাচন

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: المرء على دين خليله فلينظر أحدكم من يخالل  “মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর থাকে। তাই তোমাদের প্রত্যেকে দেখে নিক সে কার সাথে বন্ধুত্ব করে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, হাসান)

চরিত্র গঠনের সবচেয়ে বড় বাধা হলো খারাপ সঙ্গ। আর সবচেয়ে বড় সহায়ক হলো সৎ সঙ্গ।

“মানুষ তার সঙ্গীর দ্বীনের উপর থাকে” হাদিসের ব্যবহারিক প্রয়োগ

  • আপনার সবচেয়ে কাছের ৫ জন মানুষের নাম লিখুন।
  • তাদের নামাজ, পর্দা, আমল, কথাবার্তা, লক্ষ্য দেখুন।
  • এই ৫ জনের গড় চরিত্রই আগামী ৫ বছরে আপনার চরিত্র হবে।
  • যদি তাদের মধ্যে ৩ জনও দ্বীনের ব্যাপারে গাফিল হন, তবে তাদের সাথে দূরত্ব বাড়ানো ফরজ হয়ে যায়।

মসজিদভিত্তিক হালকায়ে যিকর ও ইলমের গ্রুপ তৈরি করা

  • প্রতি সপ্তাহে একদিন ফজর/ইশার পর মসজিদে ৫-৭ জনের ছোট গ্রুপ।
  • কার্যক্রম:১. ১৫ মিনিট যিকর (সালাতুত তাসবীহ বা দরূদ)২. ২০ মিনিট রিয়াদুস সালিহীন বা ফিকহুল কুলূবের একটি অধ্যায় পড়া৩. প্রত্যেকে সপ্তাহের একটি গুনাহ ও একটি ভালো কাজ শেয়ার করবে৪. পরস্পরের জন্য দোয়া
  • এই গ্রুপের নাম রাখুন “হালকাতুত তাযকিয়া”। এক বছর চালালে আপনার চরিত্রে আসমানী নূর নেমে আসবে।

সোশ্যাল মিডিয়া ও বন্ধু-চক্র থেকে ডিজিটাল তাওবা

  • হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টিকটকের যে গ্রুপগুলোতে গীবত, অশ্লীলতা, সময় নষ্ট হয় – সেগুলো থেকে একদিনে বের হয়ে যান।
  • ফোনের হোম স্ক্রিনে রাখুন শুধু ৩টি অ্যাপ: কুরআন, হাদিস, যিকর কাউন্টার।
  • যে বন্ধুরা শুধু গল্প করে, দ্বীনের কথা করে না – তাদের সাথে সপ্তাহে একদিনের বেশি দেখা বন্ধ করুন।
  • বদলে যারা আপনাকে নামাজের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাদের সাথে সময় বাড়ান।

যখন আপনি সঠিক সঙ্গ পাবেন, তখন চরিত্র গঠন আর কঠিন থাকবে না। বরং আপনি টের পাবেন, আল্লাহ আপনার জন্য পরিবেশটাই পাল্টে দিচ্ছেন।

অষ্টম ধাপ: দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে রবের সাহায্য প্রার্থনা

চরিত্র গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং অবহেলিত ধাপ হলো আল্লাহর কাছে সরাসরি সাহায্য চাওয়া। নিজের শত চেষ্টা করলেও মানুষের নফস এতটাই দুর্বল যে, একমাত্র আল্লাহই তাকে পবিত্র করতে পারেন। কুরআনে আছে:“যে নিজেকে পবিত্র করল সে সফলকাম হল” (সূরা আ’লা: ১৪) এবং পরের আয়াতেই বলা হয়েছে, আল্লাহই তাকে পবিত্র করেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে যে সাতটি দোয়া প্রায়শই করতেন এবং আমাদের শিখিয়েছেন

(এগুলো প্রতিদিন ফরয নামাযের পর ও তাহাজ্জুদে পড়লে চরিত্রের গভীর পরিবর্তন আসে)

  1. اللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا، وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا، أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا “হে আল্লাহ! তুমি আমার নফসকে তার তাকওয়া দান কর এবং তাকে পবিত্র কর, তুমিই সর্বোত্তম পবিত্রকারী, তুমিই তার অভিভাবক ও মালিক।” (মুসলিম)
  2. اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الْأَخْلَاقِ وَالْأَعْمَالِ وَالْأَهْوَاءِ “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই খারাপ চরিত্র, খারাপ আমল ও খারাপ খেয়াল থেকে।” (তিরমিযী)
  3. اللَّهُمَّ حَسِّنْ خُلُقِي كَمَا حَسَّنْتَ خَلْقِي “হে আল্লাহ! যেমন তুমি আমার সৃষ্টি সুন্দর করেছ, তেমনি আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।” (আহমদ)
  4. اللَّهُمَّ اهْدِنِي لِأَحْسَنِ الْأَخْلَاقِ لَا يَهْدِي لِأَحْسَنِهَا إِلَّا أَنْتَ، وَاصْرِفْ عَنِّي سَيِّئَهَا لَا يَصْرِفُ سَيِّئَهَا إِلَّا أَنْتَ “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের দিকে হিদায়াত দান কর, তোমা ছাড়া কেউ তা দিতে পারে না। আর খারাপ চরিত্রকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দাও, তোমা ছাড়া কেউ তা সরাতে পারে না।” (মুসলিম)
  5. يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ “হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর অটল রাখ।” (তিরমিযী)
  6. اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعِفَّةَ وَالْغِنَى “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হিদায়াত, তাকওয়া, সতীত্ব ও বেপরোয়া থেকে মুক্তি চাই।” (মুসলিম)
  7. اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ حُسْنَ الْخُلُقِ وَحُسْنَ الْخَاتِمَةِ “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে সুন্দর চরিত্র ও সুন্দর পরিণতি প্রার্থনা করি।” (তাবারানী)

প্রতিদিন এই সাতটি দোয়া ৭ বার করে পড়ার অভ্যাস গড়লে ৪০ দিনের মধ্যে চরিত্রের মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসতে শুরু করে।

তাহাজ্জুদে চরিত্রের দুর্বলতা নিয়ে কান্না

ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদে নিজের চরিত্রের ত্রুটি নিয়ে কাঁদে না, তার চরিত্র কখনো পূর্ণতা পায় না।”প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের শেষ দুই রাকাতে সিজদায় গিয়ে নিজের সবচেয়ে বড় চরিত্রের দোষটি (যেমন: রাগ, হিংসা, অহংকার, মুখরোচক কথা) মনে করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে হয়:“ইয়া আল্লাহ! তুমি ছাড়া আমার এই রোগের কোনো চিকিৎসক নেই। আমি নিজেকে বদলাতে পারছি না, তুমি আমাকে বদলে দাও।”অনেকে ২১ দিন এভাবে কাঁদার পর দেখেছেন, আল্লাহ তাদের সেই দোষটি কেড়ে নিয়েছেন।

চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা

পরিবার হলো চরিত্র গঠনের প্রথম ও সবচেয়ে শক্তিশালী মাদরাসা। রাসূল (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক সন্তান ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে, তারপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান বা মজুসী বানায়।” (বুখারী-মুসলিম) অর্থাৎ চরিত্রের প্রথম ছাঁচ গড়ে পরিবার।

পিতা-মাতার জন্য সন্তানের চরিত্র গঠনের ১০টি ব্যবহারিক উপায়

  1. জন্মের পরপরই আযান-ইকামত দেওয়া এবং সুন্দর নাম রাখা।
  2. সাত বছর বয়স পর্যন্ত খেলার মাধ্যমে আখলাক শেখানো (শাসন নয়)।
  3. দশ বছর বয়স থেকে নামাযের প্রতি কঠোরতা, কিন্তু ভালোবাসার সাথে।
  4. প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে একসাথে বসে “আজ কার সাথে কী ভালো ব্যবহার করেছি” গল্প শোনা।
  5. বাড়িতে কখনো গালি-গালাজ, চিৎকার বা মিথ্যা বলতে দেখা যাবে না। বাচ্চারা যা দেখে, তাই শেখে।
  6. মেহমান আসলে বাচ্চাদের দিয়ে সালাম দিতে ও খেদমত করতে বলা।
  7. প্রতি শুক্রবার পরিবারের সবাই মিলে একটি করে হাদিস মুখস্থ করা ও সারা সপ্তাহ আমল করা।
  8. বাচ্চার ভুল হলে শাস্তি দেওয়ার আগে নিজে সেই ভুল করলে কী শাস্তি পেতাম তা নিজের উপর প্রয়োগ করে দেখানো।
  9. মায়ের কাছ থেকে সন্তান হায়া ও লজ্জা শেখে, বাবার কাছ থেকে সাহস ও দায়িত্ববোধ। দুজনের ভারসাম্য রাখতে হবে।
  10. সন্তান যখন কিশোর হয়, তখন তার সাথে বন্ধুর মতো সময় দিতে হবে, নইলে সে বাইরে খারাপ বন্ধু খুঁজে নেবে।

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পারস্পরিক চরিত্র শুদ্ধির প্রশিক্ষণ

ঘরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাদরাসা হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম যে তার পরিবারের কাছে সর্বোত্তম।” (তিরমিযী)

ব্যবহারিক পদ্ধতি:

  • প্রতিদিন সূর্য ডোবার পর ১৫ মিনিট দুজনে মুখোমুখি বসে “আজ আমি তোমার সাথে কোন ভুল করেছি কি?” জিজ্ঞেস করা।
  • একে অন্যের জন্য প্রতিদিন একটি করে দোয়া লিখে রাখা এবং সপ্তাহে একদিন পড়ে শোনানো।
  • রাগ হলে তিনবার “আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম” বলে আলাদা হয়ে যাওয়া। ১০ মিনিট পর ফিরে এসে হাসিমুখে কথা বলা।
  • স্ত্রী যখন রাগ করে, স্বামী যেন চুপ থাকে এবং তার জন্য পানি এনে দেয়। এটা রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত।
  • প্রতি মাসে একবার দুজনে মিলে কোনো গরিবের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া। এতে দুজনের মধ্যে দানশীলতা ও নম্রতা বাড়ে।

যে ঘরে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের চরিত্র গঠনের শিক্ষক হয়, সেই ঘর থেকে বের হওয়া সন্তানরা সমাজের জন্য রহমত হয়ে যায়।

সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠন

ইসলামি শিক্ষার মূল লক্ষ্য যেখানে ব্যক্তির তাযকিয়া, সেখানেই তার চূড়ান্ত ফল হলো একটি পূর্ণাঙ্গ সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় যেমন ব্যক্তি গঠন করেছিলেন, মদিনায় তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। আজকের মুসলিম সমাজে চরিত্রের যে ভয়াবহ সংকট, তার মূলে রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে “তাযকিয়াতুন নফস”কে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া।

মাদরাসা ও স্কুলের পাঠ্যক্রমে আখলাকের স্থান

বর্তমানে অধিকাংশ মাদরাসায় কেবল ইলমে জাহেরি (ফিকহ, হাদিস, তাফসির) পড়ানো হয়, কিন্তু “ইলমে বাতিন” বা আখলাক-তাযকিয়ার কোনো পৃথক সিলেবাস নেই। ফলে ছাত্র হাফেজ-আলেম হয়, কিন্তু তার মধ্যে তাকওয়া, হায়া, আমানতদারি, সত্যবাদিতা দেখা যায় না। প্রস্তাবিত সমাধান:

  • প্রতি ক্লাসে সাপ্তাহিক ২টি ক্লাস “কিতাবুল আখলাক” বা “রিয়াদুস সালিহীন”-এর নির্বাচিত অধ্যায় পড়ানো
  • প্রতি মাসে একটি সাহাবির জীবনী থেকে একটি গুণ গ্রহণের বাধ্যতামূলক প্রজেক্ট
  • পরীক্ষায় ২০% নম্বর রাখা হবে “আমলি আখলাক” (শিক্ষক-সহপাঠী-অভিভাবকের মূল্যায়নের ভিত্তিতে)

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামি চরিত্র শিক্ষার ঘাটতি ও সমাধান

সাধারণ স্কুল-কলেজে ইসলামি শিক্ষা বলতে শুধু কয়েকটি সূরা মুখস্থ আর কিছু মাসয়ালা। চরিত্র গঠনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে একজন ছাত্র প্রথম র‍্যাঙ্ক করেও ঘুষ, মিথ্যা, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।সমাধানের বাস্তব মডেল:

  • স্কুলে “মেন্টর-মেন্টি” প্রোগ্রাম: প্রতি ১০ জন ছাত্রের জন্য একজন আলেম/শিক্ষক মেন্টর যিনি সপ্তাহে একদিন ব্যক্তিগত মুহাসাবা নেবেন
  • “চরিত্র ডায়েরি” চালু: প্রতিদিন ছাত্র নিজের ভালো-মন্দ কাজ লিখবে, মাসে একবার শিক্ষক দেখবেন
  • রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে “জাতীয় আখলাক সনদ” চালু: যে ছাত্র স্কুল জীবনে নির্দিষ্ট মানের আখলাক দেখাতে পারবে, তার সার্টিফিকেটে বিশেষ সিল থাকবে, চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবে।

সাধারণ ভুল ও বিভ্রান্তি দূরীকরণ

“চরিত্র জন্মগত, পরিবর্তন করা যায় না” – এই ধারণার খণ্ডন

অনেকে বলেন, “আমি তো রাগী, এটা আমার স্বভাব।” কিন্তু রাসূল (সা.) বলেছেন: “আখলাক মানুষ শিখে” (মুসনাদে আহমাদ)। আবু হুরায়রা (রা.) জাহেলি যুগে অত্যন্ত লজ্জাশীল ছিলেন না, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি হায়ার প্রতিমূর্তি হয়ে গেলেন। আখলাক স্বভাব নয়, অভ্যাস। আর অভ্যাস পরিবর্তনযোগ্য।

শুধু বই পড়লেই চরিত্র হয় না – আমলের প্রয়োজনীয়তা

অনেকে “ইহয়াউ উলুমুদ্দিন”, “রিয়াদুস সালিহীন” পড়ে মনে করেন চরিত্র এসে গেছে। কিন্তু ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেছেন: “ইলম যদি আমলের সাথে না থাকে, তবে তা হুজ্জত (প্রমাণ) হয়ে দাঁড়াবে বিপক্ষে।” বাস্তব উদাহরণ: একজন যুবক ১০ বছর ধরে রিয়াদুস সালিহীন পড়ছে, কিন্তু মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। তার ইলম তার বিরুদ্ধে সাক্ষী।

তাযকিয়া ছাড়া তাসাউউফের নামে বিভ্রান্তি

আজকাল অনেকে “পীর সাহেবের হাতে বায়াত” নিয়ে মনে করেন চরিত্র হয়ে গেল। অথচ শরিয়তের আমল (ফরজ-ওয়াজিব) ছেড়ে শুধু যিকর-মুরাকাবা করলে তা “নফসের ধোঁকা”। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি শরিয়তের বাইরে তরিকত খুঁজে, সে পথহারা।”

উপসংহার

রাসূল (সা.) বলেছেন: “মুমিনের কাছে তার চরিত্রের চেয়ে উত্তম কিছু নেই” (মুসনাদে আহমাদ)। নামায-রোযা-হজ-যাকাত সবই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু সুন্দর চরিত্র কিয়ামত পর্যন্ত সওয়াব দিতে থাকে। একটি হাসি, একটি ক্ষমা, একটি সত্য কথা – এগুলোই জান্নাতের পথ সহজ করে।

প্রতিদিন রাতে ১০ মিনিট মুহাসাবা (আজ কী কী ভুল করেছি?)

১১-২০ দিন: প্রতিদিন একটি গোপন নেক আমল (যেমন: কাউকে না জানিয়ে দান)

২১-৩০ দিন: প্রতিদিন একটি সুন্নাত আখলাক অনুশীলন (যেমন: রাগ হলে চুপ থাকা, হাসিমুখে সালাম দেওয়া)

৩০ দিন পর দেখবেন, আপনার ভেতরের মানুষটি বদলে গেছে।

রাসূল (সা.)-এর দোয়াহে আল্লাহ! যেমন তুমি আমার চেহারা সুন্দর করেছ, তেমনি আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।(আল্লাহুম্মা কামা হাসসানতা খালকি ফাহাসসিন খুলুকি)

এই দোয়া প্রতিদিন ১০০ বার পড়ুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হুসনে খুলুক দান করুন। আমিন।

বিষয় : ইসলাম শিক্ষা