স্যার-ম্যাডাম সম্বোধনের ইতিকথা
— প্রিপারেশন
'স্যার' বা 'ম্যাডাম' সম্বোধনের পেছনে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এটি একটি ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতির সামাজিক সংস্কৃতি যা আজও বিদ্যমান। ১০ জুলাই ২০২৫ উপদেষ্টা পরিষদের ৩৩তম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য সিনিয়র নারী কর্মীদের 'স্যার' বলার নিয়ম বাতিল করা হয়।'
সম্বোধনের প্রচলন
বাংলার মধ্যযুগ বা মুঘল আমলের সংস্কৃতিতে রাজা বাদশাহদের জাঁহাপনা, হুজুর এমন নামে সম্বোধন করা হতো। আর কর্মকর্তাদের 'সাহেব' বলে সম্বোধন করার প্রচলন ছিল। মূলত ইরানিরা ভারতবর্ষে আসার পর 'সাহিব' শব্দটির প্রচলন ঘটে। পরে তা সাহেব বা সায়েব-এ রূপ নেয়। 'সাহেব' শব্দটি আরবি 'সাহাবী' শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ সঙ্গী, সাথী, সহচর কিংবা বন্ধু। তখন পদবির সাথে সাহেব যোগ করে ডাকা হতো যেমন- কাজি সাহেব, সচিব সাহেব, চৌধুরী সাহেব। ব্রিটিশ ও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় নারীদের সম্বোধন করা হতো 'মেমসাহেব' বলে। বাঙালি বিবাহিত নারীদের বলা হতো 'বেগম সাহেব'।
স্যার-ম্যাডাম সম্বোধনের উৎপত্তি
অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ অভিধানের তথ্য অনুযায়ী ১২৯৭ সাল থেকে ইংরেজি ভাষায় 'স্যার' (Sir) শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য 'নাইট' (Knight) উপাধি পাওয়া ব্যক্তিদের নামের আগে 'স্যার' শব্দটি যোগ করা হতো। শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ Sire থেকে, যার অর্থ ছিল প্রভু বা কর্তৃপক্ষ। ভারতীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক উদয়লাল পাইয়ের লেখা Are We Still Slaves? গ্রন্থ অনুযায়ী ফ্রান্সে সামন্তযুগে Sir শব্দ দ্বারা বোঝানো হতো- Slave I Remain অর্থাৎ, আমি দাসই থেকে গেলাম। আর ইংল্যান্ডে Sir শব্দ দিয়ে বোঝানো হতো- Servant I Remain অর্থাৎ আমি চাকরই থেকে গেলাম।
উপমহাদেশে প্রচলন
১৭শ শতকে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করলে স্যার বা ম্যাডাম শব্দের প্রচলন শুরু হয়। মূলত ব্রিটিশ প্রশাসনের শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাদের প্রতি স্থানীয় জনগণের আনুগত্য প্রকাশের উপায় হিসেবে স্যার বা ম্যাডাম সম্বোধন চালু হয়। একসময় সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের স্যার, ব্রিটিশ নারীদের ম্যাডাম বলে ডাকতো, এই সম্বোধন ছিল কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের প্রকাশ। কিন্তু ইংরেজরা উচ্চবর্ণের বাঙালিদের 'বাবু' বলেই সম্বোধন করতো বলে মুনতাসীর মামুনের, 'ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন' বইয়ে উঠে এসেছে। ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলের Minutes on Indian Education গ্রন্থ অনুযায়ী উপনিবেশে এমন একটি শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে যারা 'বর্ণে ভারতীয়, কিন্তু রুচিতে-বুদ্ধিতে এবং ভাবনায়। ব্রিটিশ'। এই নীতির অধীনে ভারতে গড়ে ওঠে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা এবং তার সঙ্গে আসে ব্রিটিশ সামাজিক রীতি যার একটি ছিল কর্তৃপক্ষকে 'স্যার' বলা।
বাংলাদেশে প্রচলন
বাংলাদেশে স্যার বা ম্যাডাম সম্বোধন সংক্রান্ত কোনো সরকারি আইন, বিধিমালা বা নীতিমালা নেই। এটি মূলত একটি প্রথাগত বা সামাজিক রীতি, যা শিক্ষা, প্রশাসন এবং কর্পোরেট জগতে বহুদিন ধরে চলে আসছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বিদায় নিলেও, বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই সংস্কৃতি বহাল থাকে। স্বাধীনতার পরেও শিক্ষা ও প্রশাসনে স্যার/ ম্যাডাম সম্বোধন অপরিবর্তিত থেকে যায়। বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের বিচারকবৃন্দকে আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীরা 'স্যার' বা 'ইওর অনার' বলে থাকেন। অন্যদিকে উচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দকে 'মাই লর্ড', 'মি লর্ড' সম্বোধনে ডাকা হয়। অথচ বাংলাদেশের আইনজীবীদের পেশাগত শৃঙ্খলা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী আইন The Bangladesh Legal Practitioner's and Bar Council Order, 1972 এবং Canons of Professional Conduct and Etiquette-এর কোথাও এমন কোনো বিধান নেই। ১১ ডিসেম্বর ১৯৯০ তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের স্যার/ ম্যাডাম নামে সম্বোধনের রীতি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে সরকারি অফিস বা প্রতিষ্ঠানে সম্বোধনের জন্য 'স্যার'-এর পরিবর্তে 'জনাব' এবং 'সরকারি অফিসার বা কর্মকর্তাদের নামে প্রেরিত পত্রাদির শুরুতে পুরুষের ক্ষেত্রে 'মহোদয়' ও মহিলাদের ক্ষেত্রে 'মহোদয়া' লেখার সুপারিশ করা হয়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি বা তার পরবর্তী হালনাগাদ সংস্করণে শিক্ষকের প্রতি সম্মান বজায় রাখা নিয়ে কিছু উল্লেখ থাকলেও স্যার বা ম্যাডাম ডাকার বাধ্যবাধকতা নেই।