বঙ্গভঙ্গের ১২০ বছর
— প্রিপারেশন
আধুনিক বাংলার ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা বঙ্গভঙ্গ। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলের অন্যতম ঐতিহাসিক বড় ঘটনা বঙ্গভঙ্গ। ৭ আগস্ট ১৯০৫ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন। ২০২৫ সালে বঙ্গবঙ্গ ঘোষণার ১২০ বছর পূর্ণ হবে।
FACT FILE | |
|---|---|
বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রথম বিবেচনা করা হয় | ১৯০৩ সালে |
বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা সরকারিভাবে দেওয়া হয় | ৭ জুলাই ১৯০৫ |
বিপ্লবী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন | ১৮ জুলাই ১৯০৫ |
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর | ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ |
বঙ্গভঙ্গ রদ | ১২ ডিসেম্বর ১৯১১ |
আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি হয় | ১ এপ্রিল ১৯১২ |
পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের বর্তমান সীমানা | বাংলাদেশ, আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা |
বঙ্গভঙ্গ হয় | লর্ড কার্জন ভাইসরয় থাকাকালীন |
বঙ্গভঙ্গ রদ হয় | লর্ড হার্ডিঞ্জের সময়। |
পটভূমি
১৭৬৫ সাল থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামসহ আরও অনেক অঞ্চল নিয়ে গঠিত বঙ্গপ্রদেশ ব্রিটিশ ভারতের একটি বৃহৎ প্রদেশ ছিল। ১৮৩৬ সালে বঙ্গপ্রদেশের আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল। প্রদেশের রাজধানী ছিল কলকাতা। এছাড়া কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীও ছিল। প্রদেশের পূর্বাঞ্চল ভৌগলিক ও অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে প্রদেশটির প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে এবং এটিকে বিভক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৮৯৬ সালে আসামের চীফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ হওয়ায় প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়। ১৯০১ সালে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার অ্যাফ্র ফ্রেজার সম্বলপুরসহ উড়িষ্যাকে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে বাংলার সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করেন। ফ্রেজার ২৮ মার্চ ১৯০৩ পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করলে গভর্নর-জেনারেল লর্ড কার্জন ১ জুন ১৯০৩ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভারতের শাসন-সীমানা' নির্দিষ্ট করে দেন। ১৯০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সামান্য রদবদল করে পরিকল্পনাটি অনুমোদন করে।
বঙ্গভঙ্গ
১৯০৩ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ প্রথম বিবেচনা করা হয়। সরকারের প্রস্তাবসমূহ ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। তবে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা প্রবল গণ অসন্তোষের সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় জনমত নিরূপণের উদ্দেশ্যে লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণে তিনি নতুন প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বেশি সুযোগ সুবিধা লাভের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। এমতাবস্থায় কার্জন ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাটি অনুমোদনের জন্য ভারত সচিবের কাছে পাঠান। ৪ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯ জুলাই পরিকল্পনাটি সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভকরে। এরপর সরকারিভাবে ৭ জুলাই ১৯০৫ জানানো হয়। পরবর্তীতে ৭ আগস্ট ১৯০৫ লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা দেন। ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়।
নতুন প্রদেশ 'পূর্ব বাংলা ও আসাম'
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে দুটি প্রদেশ হয়। পূর্ব বঙ্গের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের সাথে জলপাইগুড়ি, পার্বত্য ত্রিপুরা, মালদাহ ও আসামকে যুক্ত করে 'পূর্ব বাংলা ও আসাম' নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। নতুন প্রদেশের আয়তন দাঁড়ায় ১,০৬,৫৪০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ৩.১০ কোটি। এর মধ্যে ১.৮০ কোটি ছিল মুসলমান ও ১.২০ কোটি হিন্দু। নতুন প্রদেশের রাজধানী করা হয় ঢাকা এবং অনুসঙ্গী সদর দপ্তর চট্টগ্রাম। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে আরেকটি প্রদেশ হয়। এর নামকরণ করা হয় 'বাংলা প্রদেশ'। বাংলা প্রদেশের রাজধানী করা হয় কলকাতা। বঙ্গভঙ্গের ফলে যেসব জেলা ও বিভাগ নবগঠিত 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় সেগুলো নিচের ছকে দেখানো হলো-
বিভাগের নাম | অন্তর্ভুক্ত জেলা |
|---|---|
ঢাকা | ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও সুন্দরবন |
চট্টগ্রাম | চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও কুমিল্লা |
রাজশাহী | রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, মালদহ ও জলপাইগুড়ি |
সুরমা উপত্যকা | সিলেট, কাছাড়, লুসাই পার্বত্য জেলা, নাগা পার্বত্য জেলা, |
ও পার্বত্য বিভাগ | খাসিয়া জয়ন্তিয়া পার্বত্য জেলা ও গারো পার্বত্য জেলা |
আসাম উপত্যকা | গোয়ালপাড়া, কামরূপ, দাররাং, নওগাও, শিবসাগর ও লখিমপুর জেলা |
দেশীয় রাজ্য | পার্বত্য ত্রিপুরা ও মণিপুর |
[সূত্র: Imperial Gazetteer of India : Provincial Series, Eastern Bangal and Assam, 1909]
বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ
১০ ডিসেম্বর ১৯০৩ ভারতের এলাহাবাদের দি পাইওনিয়ার পত্রিকায় মুদ্রিত প্রবন্ধ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে দ্য বাঙ্গালী প্রথম প্রতিবাদমূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এরপর ইন্ডিয়া গেজেটে সম্পূর্ণ চিঠিটি প্রকাশিত হলে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদও স্টার থিয়েটারে রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অধিবেশনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে প্রস্তাবটি বিরোধিতা করে। ১৭ ও ১৮ জুলাই ১৯০৫ কলকাতার রিপন কলেজে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ সিমলা থেকে ঘোষণা করা হয় ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। এ আন্দোলনের দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ গিরিডিতে অবস্থান করছিলেন। গিরিডিও তৎকালীন বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ লাগে। গিরিডিতে বসে তিনি এক মাসে বাউল সুরে ২১টি স্বদেশী সংগীত লেখেন। এই গানগুলো খেয়া কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়।
বঙ্গভঙ্গ রদ
বঙ্গভঙ্গ রদ (Annulment of Bengal Partition) 'স্বদেশী' ও 'বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী' আন্দোলন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অব্যাহত বিরোধিতার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ এর (১৯০৫-১১) বিষয়ে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের চরম অসন্তোষ প্রতীয়মান হয়। ১৯১০ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতের নতুন ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ্য করে বঙ্গভঙ্গ রদের বিষয়ে গোপন তৎপরতা শুরু করেন। ব্রিটেনের সম্রাট পঞ্চম জর্জ এবং ভারত সচিব লর্ড ক্রু প্রমুখ বঙ্গভঙ্গ রদের পক্ষে মত দেন। ১৯১১ সালে গ: সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও রাণি মেরী ভারত সফরে আসেন। তাদের সফর উপলক্ষে ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে এক ঐতিহাসিক দরবারের আয়োজন করা হয়। সেখানে সম্রাট পঞ্চম জর্জ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেন। ফলে কার্জনের বাংলা বিভক্তির ব্যবস্থা বাতিল হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি ও বর্ধমানের পাঁচটি বাংলা ভাষাভাষী বিভাগ নিয়ে বাংলা প্রদেশ পূনর্গঠন করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা হতে দিল্লিতে স্থানান্তর: করা হয়। ১ এপ্রিল ১৯১২ থেকে পূর্ববাংলা ও আসামের লেফটেনেন্ট গভর্নরের শাসন বাতিল করা হয়। এর মাধ্যমে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারায়।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত
ৎ১৯০৫ সালে আমার সোনার বাংলা গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত হয়। বাউল গায়ক গগন হরকরার গান আমি কোথায় পাব তারে থেকে এই গানের সুর ও সংগীত উদ্ভূত। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি ২৫ অগাস্ট ১৯০৫ কলকাতা টাউন হলের একটি প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথমবারের মতো গাওয়া হয়। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। তার এ গানটি বাউল নামক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ ব্যবস্থাকে বাতিল ঘোষণা করলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যঘাত ঘটে। পরে এই অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবিকে সম্মান জানিয়ে লর্ড কার্জন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদনে সম্মতি দেন। ১৯১৭ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের আইন সভা Imperial Legislative Council-এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও নিবন্ধনের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি বিল উত্থাপন করেন। পরে ২৩ মার্চ ১৯২০ এটি পাস হয় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯২০' নামে। ১৯২১ সালে পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
বঙ্গভঙ্গের সময় গভর্নর জেনারেল ও লেফটেনেন্ট গভর্নর
গভর্নর জেনারেল | লেফটেনেন্ট গভর্নর | ||
|---|---|---|---|
নাম | মেয়াদকাল | নাম | মেয়াদকাল |
লর্ড কার্জন | ৬ জানুয়ারি ১৮৯৯-১৮ নভেম্বর ১৯০৫ | ব্যামফিল্ড ফুলার | ১৬ অক্টোবর ১৯০৫-২০ আগস্ট ১৯০৬ |
লর্ড মিন্টো | ১৮ নভেম্বর ১৯০৫-২৩ নভেম্বর ১৯১০ | ল্যান্স লট হেয়ার | ২০ আগস্ট ১৯০৬-আগস্ট ১৯১১ |
লর্ড হার্ডিঞ্জ | ২৩ নভেম্বর ১৯১০-৪ এপিল ১৯১৬ | স্যার চার্লস স্টুয়ার্ট বেইলি | ২২ আগস্ট ১৯১১-৩১ মার্চ ১৯১২ |