জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি

প্রিপারেশন

৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

৪ অক্টোবর ২০১৮ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। ৫ জুন ২০২৪৭হাইকোর্ট এ পরিপত্র বাতিল করে দেয়। ৬ জুন ২০২৪ হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। ১ জুলাই ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূচনা হয়। সেই আন্দোলনের শেষ পরিণতি হয় ৫ আগস্ট সরকার পতনের মধ্য দিয়ে।

২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান

৬ জুলাই ২০২৪ আন্দোলনকারীরা 'বাংলা ব্লকেড'-এর ঘোষণা দেয়। ১৪ জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেয়। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ১৭ জুলাই শিক্ষার্থীরা সারাদেশে 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৮ জুলাই সারাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০ জুলাই দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২১ জুলাই কোটা বিরোধী আন্দোলনের মুখে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ পূর্বের কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ৯৩% মেধা ও ৭% কোটা রাখার পক্ষে রায় দেয়। পরে প্রজ্ঞাপন জারি এবং একই সাথে গেজেট প্রকাশ করা হয়। কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে সারা দেশে শোক পালন করে সরকার। সেই কর্মসূচি প্রত্যাহার করে ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার এবং চোখে কালো কাপড় বেধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৪ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা সারাদেশের নাগরিকদের 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির আহ্বান জানায়।

২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন

ছাত্ররাই অজেয়- এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। এই সফলতা যতটা না সরকার পরিবর্তন করে দেখিয়েছে তার চেয়ে বেশি পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বৈকল্যকে তুলে ধরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশে ছাত্র বিক্ষোভে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। যার সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। ১ জুলাই ২০২৪ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। এর ফলে ৫ আগস্ট ২০২৪ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

জুলাই স্মৃতি উদ্যাপন অনুষ্ঠানমালা

১ জুলাই ২০২৫ জুলাই অভ্যুত্থানের স্মরণে মাসব্যাপী কর্মসূচি উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মাসব্যাপী জুলাই স্মৃতি উদ্যাপনের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানমালা-

১ জুলাই: মসজিদ, মন্দির, পাপোডা ও গির্জাসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপসানালয়ে শহিদদের দোয়া ও প্রার্থনা। জুলাই হত্যাযজ্ঞের খুনিদের বিচারের দাবিতে গণ-স্বাক্ষর কর্মসূচি।

৫ জুলাই: বিভিন্ন সময় অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম নির্যাতন প্রচারে দেশব্যাপী পোস্টারিং কর্মসূচি চালু।
জুলাই: julyforever.org নামে ওয়েবসাইট চালু।

মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম: ১৪ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। এদিন প্রত্যেক জেলায় জুলাই, শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন।

আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া ১৫ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। জুলাই স্মৃতিচারণ। ডকুমেন্টারি প্রদর্শন এবং জুলাইয়ের গান।

কথা ক: ১৬ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে তিনটি বিভাগীয় শহরে VR Show প্রদর্শন। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শহিদ আবু সাঈদ স্মরণ অনুষ্ঠান এবং চট্টগ্রামে জুলাইয়ের গান ও ড্রোন শো প্রদর্শন।

শিকল-পরা ছল: ১৭ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। প্রতীকী কফিন মিছিল।

আওয়াজ উডা: ১৮ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। ঢাকার বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই স্মরণ অনুষ্ঠান।

কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙ্গা: ১৯ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। ঢাকা-সহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে জুলাইয়ের তথ্যচিত্র প্রদর্শন।

দেশটা তোমার বাপের নাকি: ২০ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। ঢাকা-সহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে জুলাইয়ের তথ্যচিত্র প্রদর্শন।

রক্ত গরম মাথা ঠাণ্ডা: ২১ জুলাইয়ের ভিডিও

শেয়ার। ঢাকাসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে জুলাইয়ের তথ্যচিত্র প্রদর্শন।

আভাস: ২২ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অদম্য-২৪ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন।

কারার ঐ লৌহ কপাট: ২৩ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। গ্রাফিতি অঙ্কন কর্মসূচি।

কি করেছে তোমার বাবা: ২৪ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। শিশু শহিদদের স্মরণে দেশব্যাপী কর্মসূচি।

চলো ভুলে যাই: ২৫ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। মঞ্চে বিপ্লব নামে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট নাট্যমঞ্চ করে নাটক।

পলাশীর প্রান্তর: ২৬ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের জমায়েত। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে তথ্যচিত্র প্রদর্শন।

ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর গান: ২৭ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ।

চলো ভুলে যাই: ২৮ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। জুলাইয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনুষ্ঠান।

বাংলা মা: ২৯ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। জুলাই অভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক বুদ্ধিবৃত্তিক প্যানেল ডিসকাশন এবং গাজীপুর/সাভারে শ্রমিকদের সমাবেশ।

চল চল চল: ৩০ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। অনলাইনে জুলাই স্মরণ। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখা সাংবাদিকদের নিয়ে অনুষ্ঠান।

কাণ্ডারি হুঁশিয়ার: ৩১ জুলাইয়ের ভিডিও শেয়ার। দেশব্যাপী সব কলেজে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির স্মরণে অনুষ্ঠান।

গণজোয়ার: ৩২ জুলাইয়ের (আগস্ট ১) ভিডিও শেয়ার। ৬৪টি জেলায় জুলাই নিয়ে বানানো তথ্যচিত্র প্রদর্শন।

আমি বাংলায় গান গাই ৩৩ জুলাইয়ের (আগস্ট ২) ভিডিও শেয়ার। বাংলাদেশের সব জেলার 'জুলাইয়ের মায়েরা' শীর্ষক বিভিন্ন অনুষ্ঠান। প্রজেকশন ম্যাপিং।

ধনধান্য পুষ্প ভরা: ৩৪ জুলাইয়ের (আগস্ট ৩) ভিডিও শেয়ার। শাহবাগ থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত শোভাযাত্রা।

মুক্তির মন্দির সোপান তলে ৩৫ জুলাইয়ের (আগস্ট ৪) ভিডিও শেয়ার। সারাদেশে জুলাই যোদ্ধাদের সমাগম। জুলাইয়ের কার্টুনের প্রদর্শনী।

শোনো মহাজন: ৩৬ জুলাইয়ের (৫ আগস্ট) ভিডিও শেয়ার। ৬৪ জেলার কেন্দ্রে জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ।

জুলাই শহিদ স্মৃতি বৃত্তি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তরুণদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও প জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর 'জুলাই শহিদ স্মৃতি বৃত্তি' প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। ১ জুলাই ২০২৫ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর হাতে 'জুলাই শহিদ স্মৃতি বৃত্তির' চেক তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এই বৃত্তির অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজ ও ইনস্টিটিউটের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এককালীন সহায়তা প্রদান করা হবে। এ বছর ৭২৫টি প্রতিষ্ঠানের ২,০৪০ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তিলাভ করবেন।

নতুন দিবস ২ জুলাই ২০২৫ সরকার প্রতিবছর ৫ আগস্ট 'জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস' ঘোষণা করে। দিনটিতে সাধারণ ছুটি থাকবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, দিবসটি পালনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন-সংক্রান্ত পরিপত্রের 'ক' শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া পৃথক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার প্রতিবছর ১৬ জুলাই 'জুলাই শহিদ দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটি 'খ' শ্রেণিভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের ১৪ জুলাই নারীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নারী শিক্ষার্থী দিবস' এবং ১৭ জুলাইয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধকে 'সন্ত্রাস প্রতিরোধ দিবস' ঘোষণা করে।

জুলাই স্মৃতি জাদুঘর

৫ আগস্ট ২০২৫ জুলাই স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করা হবে। জুলাই স্মৃতি জাদুঘরে জুলাই আন্দোলনের স্থিরচিত্র, বিভিন্ন স্মারক, নানা উপকরণ, শহীদদের জামাকাপড়, চিঠি, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, ওই সময়ের পত্রিকার কাটিং, অডিও-ভিডিওসহ বিভিন্ন স্মৃতি স্মারক থাকবে। এ জাদুঘর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরেরই একটি অংশ। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ গণভবনকে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ১৫ জুলাই ২০২৫ জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য পূর্তকাজের অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। প্রাথমিকভাবে ৩৭ জনবল নিয়ে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হবে।

প্রথম জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ

১৪ জুলাই ২০২৫ নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকায় দেশের প্রথম 'জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ' উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ উপদেষ্টা। নারায়ণগঞ্জে ২১ জন শহিদের নামে নির্মিত হয় 'জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ'। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম 'জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ' এটি। নারায়ণগঞ্জের মধ্যদিয়ে দেশের ৬৪টি জেলায় 'জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ' নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১ জুলাই ২০২৫ সরকার থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় দেশের ৬৪টি জেলায় জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হবে। আগামী ৪৫ অগাস্টের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এই স্মৃতিস্তম্ভ টেক্সট-বেইজড। জুলাই আন্দোলনে লাইন, টেক্সট, কথা, স্লোগান, কবিতা-এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলো দিয়েই এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়।

বিষয় : সাধারণ জ্ঞান