বাংলা ভাষার অপ্রচলিত শব্দগুলোর সহজ ব্যাখ্যা ও ব্যবহার নির্দেশিকা
— প্রিপারেশন
আমরা প্রতিদিন যে বাংলা বলি, লিখি, তা আসলে একটা ছোট্ট অংশ মাত্র। তার বাইরে আছে এক বিশাল ভাণ্ডার এমন হাজার হাজার শব্দ যারা একসময় গল্পে-কবিতায়-চিঠিতে-আলাপে ঝলমল করত, কিন্তু আজ আর মুখে আসে না। আমরা তাদের বলি “অপ্রচলিত শব্দ”। কেউ বলেন “পুরনো শব্দ”, কেউ বলেন “ভাষার হারানো রত্ন”। আমি বলি, এরা বাংলা ভাষার ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মারক।
এই শব্দগুলো শুধু পুরনো নয়, এরা বহন করে আসছে আমাদের পূর্বপুরুষের চিন্তা, জীবনযাপন, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক, এমনকি হাসি-কান্না-ভালোবাসার সূক্ষ্ম ছোঁয়া। “অম্বু” বললে যেখানে আমরা শুধু “জল” বুঝি, সেখানে আমাদের দাদু-ঠাকুর্দার কাছে এই শব্দে লুকিয়ে থাকত নদী আর সমুদ্রের বিশালতা। “সৌদামিনী” শুনলে আজকের ছেলেমেয়েরা হয়তো ভ্রূ কুঁচকে তাকাবে, কিন্তু একালে যখন বিদ্যুৎ চমকাত, তখন এই একটি শব্দেই আকাশ রাঙিয়ে উঠত।
কেন এই শব্দগুলো আজ অপ্রচলিত হয়ে গেল?
- সময় বদলেছে, জীবনযাত্রা বদলেছে।
- ইংরেজি-হিন্দি-বিদেশি শব্দের ঢল নেমেছে।
- আমরা সহজ, ছোট, দ্রুত কথা বলতে চাই।
- আর সবচেয়ে বড় কথা আমরা ভুলে গেছি যে ভাষা যত সমৃদ্ধ, আমাদের চিন্তাও তত গভীর ও সুন্দর হয়।
এই ব্লগটা ঠিক সেই ভুলে-যাওয়া শব্দগুলোকে আবার আলোয় আনার একটা ছোট্ট চেষ্টা। এখানে আমি কঠিন সংস্কৃত শব্দের পাহাড় চাপিয়ে দেব না। বরং হাত ধরে দেখাব যে “কুসুমিত” মানে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া,যে “অনুচর” মানে সঙ্গী বা সহচর,যে “নিশীথ” মানে গভীর রাত,আর “সৌরভ” মানে যে গন্ধ মনকে আনচান করে।
এই ব্লগ কার জন্য?
- যারা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসেন।
- যারা লেখেন – গল্প, কবিতা, ফেসবুক স্ট্যাটাস কিংবা চিঠি।
- যারা পুরনো বাংলা উপন্যাস পড়তে গিয়ে শব্দার্থ খুঁজে মরেন।
- যারা চান তাদের সন্তানের মুখে “চাঁদ” এর বদলে একদিন “চন্দ্র” বা “শশী” শুনতে।
- আর যারা বিশ্বাস করেন – ভাষা বাঁচলে সংস্কৃতিও বাঁচে।
আগামী কয়েকটা পর্ব জুড়ে আমরা একসঙ্গে ঘুরে আসব বাংলা ভাষার সেই হারানো বাগানে। হাতে নেব কিছু ফুল, যার নাম আজ আর কেউ মনে রাখে না, কিন্তু যার সৌরভ এখনো বাতাসে লুকিয়ে আছে।
অপ্রচলিত শব্দের উৎস ও বিবর্তন
এই অধ্যায়ে পাঠককে বোঝানো হবে যে বাংলা ভাষার অপ্রচলিত শব্দগুলো কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে সময়ের সাথে এদের ব্যবহার কমে গেছে এবং আজকের দিনে এরা কেন “অপ্রচলিত” বলে গণ্য হয়। অধ্যায়টি নিম্নলিখিত উপবিভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রধান উৎসসমূহ
বাংলা ভাষা শত শত বছর ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার সংস্পর্শে এসেছে। ফলে অপ্রচলিত শব্দের বেশিরভাগই বিদেশি উৎস থেকে এসেছে বা সংস্কৃতের তৎসম রূপ ধরে রেখেছে।
- সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ: বাংলার প্রাচীন সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ ও পান্ডিত্যপূর্ণ লেখায় এগুলো প্রচুর ছিল। উদাহরণ: অম্বর, জলধি, নভশ্চর, পয়োনিধি, তরবারি, কুসুম, পুষ্পাঞ্জলি।
- ফারসি ও আরবি শব্দ: মধ্যযুগে মুসলিম শাসন ও সংস্কৃতির প্রভাবে। উদাহরণ: দরবার, খোয়াব, ফরমায়েশ, কলমদানি, আয়না, বেগম, নবাব।
- পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজি শব্দের প্রাচীন রূপ: ঔপনিবেশিক যুগে প্রচলিত হয়েছিল কিন্তু পরে বদলে গেছে বা লুপ্ত। উদাহরণ: আলমারি, জানালা, কামরা, পায়েব, ইস্ত্রি, বিলাতি।
- দেশি ও আঞ্চলিক শব্দ: গ্রামবাংলার প্রাচীন শব্দ যেগুলো শহরায়নের সাথে হারিয়ে গেছে। উদাহরণ: ঢেঁকি, ওনা, পিঁড়ি, কুলা, ঝাঁঝরি।
কেন শব্দগুলো অপ্রচলিত হয়ে গেল
সময়ের সাথে ভাষার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নিচের কারণগুলো বাংলায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে।
- সরলীকরণের প্রবণতা: লোকে সহজ ও ছোট শব্দ পছন্দ করে। যেমন “জলধি” বা “সমুদ্র” এর বদলে “সাগর” বা “দরিয়া” প্রচলিত হল।
- শিক্ষা ও মিডিয়ার প্রভাব: বিংশ শতাব্দীতে স্কুলের পাঠ্যবই, সংবাদপত্র ও রেডিও সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষাকে প্রভাবিত করে। তৎসম শব্দ কমে যায়।
- শহরায়ন ও আধুনিক জীবনযাত্রা: গ্রামীণ জীবনের সাথে জড়িত শব্দ (যেমন হলদি, কোদাল, নাঙ্গলের বিভিন্ন প্রাচীন নাম) আর ব্যবহার হয় না।
- রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন: বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে “শুদ্ধ বাংলা” আন্দোলনে অনেক ফারসি-আরবি শব্দ বাদ দেওয়া হয়। পরে স্বাধীনতার পর আরও অনেক প্রাচীন শব্দ বাদ পড়ে।
- ইংরেজি ও হিন্দির প্রভাব: নতুন প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ইংরেজি বা হিন্দি শব্দ ব্যবহার করে।
কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিবর্তন দেখা
- আকাশ > অম্বর > নভঃ > ব্যোম > আসমান (বিভিন্ন যুগের শব্দ)। আজ শুধু আকাশ ও আসমান প্রচলিত।
- জল > বারি > অম্বু > সলিল > পানি। আজ সাধারণত “পানি” ও “জল”।
- ভাই > সহোদর > ভ্রাতা > বীর। আজ “ভাই” ছাড়া বাকিগুলো সাহিত্যিক।
- ঘর > গৃহ > ভবন > মহল > কামরা। আজ “ঘর” ও “রুম” প্রচলিত।
আজকের প্রেক্ষাপটে অপ্রচলিত শব্দের অবস্থান
অনেকে মনে করেন এই শব্দগুলো “মৃত”। আসলে এরা পুরোপুরি মরেনি। কবিতা, গান, নাটক, ধর্মীয় আলোচনা ও পুরানো সাহিত্যে এখনো বেঁচে আছে। আবার কিছু শব্দ আঞ্চলিক ভাষায় এখনো জীয়ন্ত (যেমন সিলেটে “আঁর” বা চট্টগ্রামে “আঁই”)।
অপ্রচলিত শব্দের শ্রেণীবিভাগ
এই অধ্যায়ে আমরা অপ্রচলিত শব্দগুলিকে বিষয়ভিত্তিক এবং অর্থগত ক্যাটাগরিতে ভাগ করব। প্রতিটি ক্যাটাগরির অধীনে কয়েকটি নির্বাচিত শব্দের নাম, তাদের আধুনিক সমার্থক এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো। এই বিভাজনের ফলে পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন কোন ধরনের শব্দ কোন প্রেক্ষাপটে বেশি ব্যবহৃত হতো এবং আজও কোথায় প্রয়োগ করা যায়।
প্রকৃতি, আবহাওয়া ও পরিবেশ সম্পর্কিত শব্দ
এই শ্রেণীর শব্দগুলো প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি বর্ণনায় প্রচুর ব্যবহৃত হতো।উদাহরণ:অম্বু (জল), জলধি (সমুদ্র), পয়োনিধি (সমুদ্র), বারিধি (সমুদ্র), তড়িত্ (বিদ্যুৎ), ঘনস্নিগ্ধ (ঘন মেঘ), সৌদামিনী (বিদ্যুৎ), অম্বর (আকাশ), নভ (আকাশ), শশী (চন্দ্র), ভানু (সূর্য), মেঘনাদ (বজ্রের শব্দ), স্তনয়িত্নু (বজ্রপাত)।
মানুষ, সম্পর্ক ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কিত শব্দ
পারিবারিক সম্পর্ক ও মানুষের বিভিন্ন অবস্থা বোঝাতে এগুলো ব্যবহৃত হতো।উদাহরণ:পিতামহ (দাদা), মাতামহ (নানা), সহোদর (আপন ভাই/বোন), ভ্রাতৃবধূ (ভাইয়ের বউ), জায়া (স্ত্রী), ভার্যা (স্ত্রী), পতি (স্বামী), গৃহপতি (গৃহকর্তা), তনয় (পুত্র), তনয়া/সুতা (কন্যা), দুহিতা (কন্যা), যমজ (যমজ সন্তান), কিশোর (কিশোর), কুমার (অবিবাহিত যুবক), বালক (শিশু), শিশু (শিশু), বৃদ্ধ (বয়স্ক পুরুষ), বৃদ্ধা (বয়স্কা নারী)।
খাদ্য, পানীয় ও রান্নার শব্দ
দৈনন্দিন জীবনের এই শব্দগুলো আজ প্রায় হারিয়ে গেছে।উদাহরণ:অন্ন (ভাত/খাদ্য), অমৃত (মধু/অমৃততুল্য পানীয়), সুধা (মধু/দুধ), পয়ঃ (দুধ), ক্ষীর (গাঢ় দুধ), মধু (মধু), ইক্ষু (আখ), মোদক (মিষ্টি), লাড্ডুক (লাড্ডু), পূপ (পিঠা), অন্নপান (খাবার-দাবার), ভোজন (খাওয়া), পান (পান করা)।
বস্তু, পোশাক ও গৃহস্থালি সম্পর্কিত শব্দ
প্রাচীন জীবনযাত্রার সাক্ষী এই শব্দগুলো।উদাহরণ:বস্ত্র (কাপড়), অম্বর (কাপড়/আকাশ), বসন (পোশাক), চীর (বস্ত্রের টুকরো), কাঞ্চী (কোমরবন্ধ), কেশ (চুল), কুন্তল (লম্বা চুল), অলক (চুলের কোঁকড়া অংশ), গৃহ (ঘর), ভবন (বাড়ি), সদন (বাড়ি), দ্বার (দরজা), তোরণ (দরজার উপরের অংশ), আসন (বসার জায়গা), শয়ন (শয্যা), অস্ত্র (অস্ত্র), খড়্গ (তলোয়ার)।
আবেগ, মনোভাব ও গুণ সম্পর্কিত শব্দ
এগুলো কাব্য ও দার্শনিক লেখায় প্রচুর ব্যবহৃত হয়।উদাহরণ:হর্ষ (আনন্দ), উল্লাস (উচ্ছ্বাস), শোক (দুঃখ), বিষাদ (গভীর দুঃখ), ক্রোধ (রাগ), রোষ (তীব্র রাগ), ভয় (ভয়), ত্রাস (আতঙ্ক), লজ্জা (লজ্জা), সঙ্কোচ (সঙ্কোচ), প্রেম (ভালোবাসা), অনুরাগ (গভীর ভালোবাসা), স্নেহ (স্নেহ), দয়া (করুণা), কৃপা (অনুগ্রহ)।
ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও পৌরাণিক শব্দ
সংস্কৃত-প্রভাবিত এই শব্দগুলো ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণে বেশি দেখা যায়।উদাহরণ:দেব (দেবতা), সুর (দেবতা), অসুর (দৈত্য), যক্ষ (যক্ষ), গন্ধর্ব (গন্ধর্ব), কিন্নর (কিন্নর), পুণ্য (ভালো কাজ), পাপ (পাপ), তপস্যা (তপস্যা), যজ্ঞ (যজ্ঞ), হোম (হোম), মন্ত্র (মন্ত্র), তীর্থ (পুণ্যস্থান), ধর্ম (ধর্ম), অধর্ম (অধর্ম)।
প্রশাসন, রাজনীতি ও যুদ্ধ সম্পর্কিত শব্দ
মধ্যযুগের রাজসভা ও যুদ্ধের বর্ণনায় এগুলো প্রচলিত ছিল।উদাহরণ:রাজা (রাজা), নৃপতি (রাজা), ভূপতি (রাজা), সভাপতি (সভার প্রধান), সেনাপতি (সেনাপতি), যোদ্ধা (যোদ্ধা), বীর (বীর), শত্রু (শত্রু), রিপু (শত্রু), সন্ধি (চুক্তি), বিগ্রহ (যুদ্ধ), জয় (বিজয়), পরাজয় (পরাজয়)।
বিবিধ ও বিরল শব্দ
যেগুলো কোনো নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে পুরোপুরি পড়ে না।উদাহরণ:অয়ি (হে), রে (হে), ভোঃ (হে), কিংকর (চাকর), দাস (দাস), অনুচর (সঙ্গী), সখা (বন্ধু), বন্ধু (বন্ধু), প্রিয় (প্রিয়জন), কান্ত (প্রিয়তম), কাল (সময়/মৃত্যু), মৃত্যু (মৃত্যু)।
সহজ ব্যাখ্যা: নির্বাচিত শব্দগুলির বিস্তারিত বর্ণনা
এই অংশটি ব্লগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পাঠকের কাছে সবচেয়ে উপকারী অংশ। এখানে অপ্রচলিত শব্দগুলিকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করে, প্রতিটি শব্দের জন্য নিম্নলিখিত তথ্যগুলি সুস্পষ্টভাবে দেওয়া হবে। পাঠক যেন এক নজরে বুঝতে পারেন এবং মনে রাখতে পারেন, সেজন্য প্রতিটি শব্দ একই ফরম্যাটে উপস্থাপন করা উচিত।
প্রস্তাবিত ফরম্যাট (প্রতিটি শব্দের জন্য)
শব্দ: অম্বুউচ্চারণ: ômbu (ওম্বু)আধুনিক সমার্থক: জল, পানিমূল অর্থ: জল, বিশেষত খাঁটি বা স্বচ্ছ জলউৎস: সংস্কৃতউদাহরণ বাক্য: গ্রীষ্মের তীব্র তাপে অম্বু পান করিয়া শরীর শীতল করিলাম।ব্যবহারের ক্ষেত্র: কাব্য, সাহিত্য, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, আধুনিক লেখায় শৈল্পিক ভাষার জন্য।
ক্যাটাগরি অনুযায়ী শব্দের তালিকা
প্রকৃতি ও পরিবেশঅম্বু (জল), জলধি (সমুদ্র), বারিধি (সমুদ্র), সলিল (জল), পয়োনিধি (সমুদ্র), নভ (আকাশ), অনিল (বায়ু), পবন (বায়ু), সুরভি (সুগন্ধ), তৃণাঙ্কুর (ঘাসের কচি অঙ্কুর)।
মানুষ, সম্পর্ক ও সমাজপিতামহ (দাদা/ঠাকুরদা), মাতামহী (দিদিমা/ঠাকুরমা), সহোদর (আপন ভাই), সহোদরা (আপন বোন), ভ্রাতৃবধূ (ভাইয়ের বউ), জায়া (স্ত্রী), ভার্যা (স্ত্রী), গৃহপতি (গৃহকর্তা), তনয় (পুত্র), তনয়া (কন্যা)।
দৈনন্দিন জীবন ও বস্তুঅন্নপান (খাওয়া-দাওয়া), ভোজন (খাওয়া), কুসুম (ফুল), পুষ্প (ফুল), অঙ্গরাগ (সাজগোজ/প্রসাধন), বস্ত্র (কাপড়), বসন (পোশাক), আসন্দী (চেয়ার/আসন), দর্পণ (আয়না), গৃহকোণ (ঘরের কোণ)।
সময়, আবেগ ও অবস্থাঅপরাহ্ন (বিকেল), সায়াহ্ন (সন্ধ্যা), প্রভাত (ভোর), নিশীথ (মধ্যরাত্রি), স্নেহ (ভালোবাসা), বাৎসল্য (মাতৃস্নেহ), হর্ষ (আনন্দ), শोक (দুঃখ), ক্রোধ (রাগ), লজ্জা (লজ্জা/শরম)।
প্রতিটি ক্যাটাগরির শুরুতে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা
উদাহরণ:“প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কিত শব্দগুলো প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ও কাব্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আধুনিক বাংলায় এগুলো খুব কম ব্যবহৃত হলেও কবিতা, গল্প বা উপন্যাসে ব্যবহার করলে ভাষা অসাধারণ সমৃদ্ধ ও কাব্যিক হয়ে ওঠে।”
ব্যবহার নির্দেশিকা: কীভাবে এগুলি প্রয়োগ করবেন
এই অংশটি ব্লগের সবচেয়ে ব্যবহারিক এবং পাঠকের কাজে লাগার মতো অংশ। এখানে শুধু শব্দের অর্থ বলা নয়, পাঠককে হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়া হবে যে অপ্রচলিত শব্দগুলো আজকের দিনেও কত সহজে, সুন্দরভাবে এবং অর্থবহ উপায়ে ব্যবহার করা যায়। নিচে এই বিভাগের বিস্তারিত গঠন দেওয়া হলো।
আধুনিক বাংলায় অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের সাধারণ নিয়ম
অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করলে বাক্য ভারী বা পুরনো লাগে, এই ভয় দূর করার উপায়।একটি মাত্র শব্দ দিয়েও বাক্যকে গভীরতা ও সৌন্দর্য দেওয়া যায়।কোনো বাক্যে সর্বোচ্চ এক বা দুটি অপ্রচলিত শব্দ রাখার পরামর্শ।প্রসঙ্গের সঙ্গে মিল রাখা জরুরি, জোর করে ঢোকালে হাস্যকর লাগে।
কথ্য ভাষায় ব্যবহার
অপ্রচলিত শব্দকে কথোপকথনে মজার ও আকর্ষণীয় করে তোলার কৌশল।উদাহরণ:“আজ বৃষ্টিতে রাস্তা জলময় হয়ে গেছে” বলার বদলে “আজ বৃষ্টিতে রাস্তা জলময় হয়ে গেল” বললে শুনতে অন্যরকম লাগে।“তোর দাদুকে দেখে মনে হল যেন কোনো পিতামহ এসেছেন”।হাস্যরস মিশিয়ে ব্যবহার করলে বন্ধুমহলেও গ্রহণযোগ্য হয়।
লেখায় ব্যবহার (গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, সোশ্যাল মিডিয়া)
গল্পে চরিত্রের বয়স, শিক্ষা, পটভূমি বোঝাতে অপ্রচলিত শব্দের জাদু।উদাহরণ: বুড়ো চরিত্র বলবে “আমি এই গৃহে পঞ্চাশ বসন্ত অতিবাহিত করেছি”।কবিতায় ছন্দ ও গাম্ভীর্য বাড়ানোর জন্য “অম্বর”, “নভোনীল”, “তমসা” ইত্যাদি।ফেসবুক স্ট্যাটাসে: “আজ সন্ধ্যা অতি মনোহর, চন্দ্র উদিত হয়েছে আকাশে”।
তুলনামূলক উদাহরণ (আগে ও পরে)
প্রতিটি শব্দের জন্য তিনটি বাক্য:সাধারণ বাক্য → অপ্রচলিত শব্দযুক্ত বাক্য → ব্যাখ্যা কেন দ্বিতীয়টি সুন্দর/গভীর।উদাহরণ:সাধারণ: বাবা বাড়ির কর্তা।অপ্রচলিত: পিতা এই গৃহের গৃহপতি।ব্যাখ্যা: গৃহপতি শব্দটি শুধু কর্তৃত্ব নয়, দায়িত্ব ও সম্মানের গভীরতা যোগ করে।
কখন ব্যবহার করবেন না
অফিসিয়াল ইমেইল, এসএমএস, চাকরির ইন্টারভিউতে অপ্রচলিত শব্দ বর্জন করা উচিত।যে শ্রোতা/পাঠক বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের কাছে অতিরিক্ত ব্যবহার বিভ্রান্তিকর।হাস্যকর বা ব্যঙ্গাত্মক প্রসঙ্গে ভারী শব্দ ব্যবহার করলে উল্টো ফল হয়।
ব্যবহারিক অনুশীলন (পাঠকের জন্য)
১০টি আধুনিক বাক্য দেওয়া হবে, পাঠককে বলা হবে একটি করে অপ্রচলিত শব্দ বসিয়ে নতুন করে লিখতে।উত্তর কমেন্টে লিখতে উৎসাহিত করা।চ্যালেঞ্জ: একটি ছোট গল্প বা কবিতা লিখতে হবে যেখানে কমপক্ষে পাঁচটি অপ্রচলিত শব্দ থাকবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহারের জন্য রেডিমেড ক্যাপশন
“আজকের সূর্যোদয় অতি দিব্য ছিল”“তোমার হাসি যেন চন্দ্রিকা ছড়ায়”“এই নগরীতে আমি একাকী পর্যটকের ন্যায় ঘুরে বেড়াই”এই ধরনের ১৫-২০টি ক্যাপশন যাতে পাঠক সরাসরি কপি করে ব্যবহার করতে পারেন।
অপ্রচলিত শব্দের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক গুরুত্ব
এই অংশটি ব্লগের সবচেয়ে আবেগঘন এবং অনুপ্রেরণাদায়ক অধ্যায় হতে পারে। এখানে পাঠক বুঝতে পারবেন যে অপ্রচলিত শব্দগুলি কেবল পুরনো শব্দ নয়, বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জীবন্ত ঐতিহ্যের অংশ। নিচে এই অধ্যায়ের বিস্তারিত গঠন দেওয়া হলো, যাতে আপনি সহজেই লিখতে পারেন।
বাংলা সাহিত্যে অপ্রচলিত শব্দের সোনালি যুগ
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সময়ে এই শব্দগুলি নিত্য ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, সোনার তরী, চিত্রা ইত্যাদি কাব্যে “অমৃত”, “নির্ঝর”, “কুসুমিত”, “বিবসন”, “অন্তরীপ” জাতীয় শব্দের অপূর্ব ব্যবহার।বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠে “বন্দেমাতরম্” গানে “সুজলাং সুফলাং”, “শস্যশ্যামলাং” ইত্যাদি শব্দ যা আজও জাতীয় সংগীতের অংশ।মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যে “তপোবন”, “অজেয়”, “দুর্জয়”, “সুরঙ্গমা” প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার।জীবনানন্দ দাশের কবিতায় “রূপসী বাংলা”র “হেমন্তের অরণ্য”, “ধানসিঁড়ি”, “শীতের হাওয়া” ইত্যাদি।এই অংশে ৫-৬টি বিখ্যাত লেখকের ২-৩টি করে উদাহরণ বাক্যসহ দিলে পাঠকের মনে গভীর ছাপ পড়বে।
অপ্রচলিত শব্দ ও বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়
অনেক শব্দ আমাদের ঋতু, উৎসব, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও জীবনধারার সঙ্গে জড়িত। যেমন:“শারদপ্রাত” (শরৎ সকাল), “বসন্তোৎসব”, “নবান্ন”, “আম্রমুকুল”, “কদলী”, “ফল্গু”, “শৈলজ” ইত্যাদি শব্দ শুধু প্রকৃতি নয়, বাঙালিয়ানার স্মৃতি বহন করে।“পৈতৃক”, “কুলবধূ”, “গৃহদেবতা”, “আখড়া”, “যাত্রাগান” এর মতো শব্দ আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর সাক্ষী।এখানে লিখতে পারেন: এই শব্দগুলি হারিয়ে গেলে আমরা আমাদের শেকড়ের একটা বড় অংশ হারাবো।
আধুনিক সময়ে অপ্রচলিত শব্দের পুনরুজ্জীবন
অনেকে ভাবেন এই শব্দগুলি শুধু পুরনো সাহিত্যের জন্য। কিন্তু বাস্তবে:সম্প্রতি বাংলা ওয়েব সিরিজ, ইউটিউব কনটেন্ট, গান ও বিজ্ঞাপনে এই শব্দগুলি ফিরে আসছে। উদাহরণ:“হৈমন্তী”, “শরৎচন্দ্রিকা”, “নিশীথিনী”, “অরুণিমা” এর মতো নাম বা শিরোনাম।ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে “নিবিড়”, “স্নিগ্ধ”, “মাধুর্য্য”, “অনুরাগ” শব্দের পুনর্ব্যবহার।কবিতা লেখা, ব্লগিং, স্টোরি রাইটিংয়ে নতুন প্রজন্ম এগুলো ব্যবহার করছে।
পাঠকের জন্য চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তাব
এই অংশে পাঠককে সরাসরি যুক্ত করুন:আজ থেকে একটি অপ্রচলিত শব্দ প্রতিদিন ব্যবহার করুন (ফেসবুক স্ট্যাটাসে, চ্যাটে বা লেখায়)।একটা ছোট গল্প বা কবিতা লিখুন যেখানে কমপক্ষে ৫টি অপ্রচলিত শব্দ থাকবে।কমেন্টে আপনার প্রিয় অপ্রচলিত শব্দটি লিখুন এবং তার সঙ্গে একটি বাক্য বানান।এই কাজগুলো পাঠকের সঙ্গে সংযোগ বাড়াবে এবং ব্লগটি ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
উপসংহার
এই বিভাগটি পুরো ব্লগের শেষ অংশ। এটি হবে সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রভাবশালী, যাতে পাঠকের মনে একটা স্থায়ী ছাপ থাকে এবং তারা ব্লগ পড়ে কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাধারণত ৪০০ থেকে ৭০০ শব্দের মধ্যে রাখলে ভালো হয়। নিচে ধাপে ধাপে কী কী থাকবে তার বিস্তারিত গাইডলাইন দেওয়া হলো।
১. মূল বার্তার সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি
একটা ছোট অনুচ্ছেদে বলুন যে বাংলা ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও চেতনার ধারক। অপ্রচলিত শব্দগুলো যেন আমাদের পূর্বপুরুষের পায়ের ছাপ, যেগুলো মুছে গেলে আমরা নিজেদের একটা বড় অংশ হারাব।
২. অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জোরালো যুক্তি
এখানে একটু আবেগের সঙ্গে যুক্তি মিশিয়ে লিখুন। উদাহরণ:“যখন আমরা ‘জলধি’ বলার বদলে শুধু ‘সমুদ্র’ বলি, তখন আমরা শুধু একটা শব্দ হারাই না, হারাই তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা বিশালতা ও গভীরতার অনুভূতি। ‘অম্বু’ বললে যে স্নিগ্ধতা আসে, ‘পানি’ শব্দে তা আসে না। ভাষা যত সমৃদ্ধ হবে, আমাদের চিন্তা ও অনুভূতিও তত গভীর হবে।”
৩. ব্যক্তিগত আহ্বান
পাঠককে সরাসরি সম্বোধন করুন।“আজ থেকেই একটা অপ্রচলিত শব্দ বেছে নিন। আপনার ফেসবুক স্ট্যাটাসে, চিঠিতে, কবিতায়, গল্পে বা সাধারণ কথায় ব্যবহার করুন। প্রথমে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু যত বেশি মানুষ ব্যবহার করবে, শব্দটা তত জীয়ন্ত হয়ে উঠবে।”
৪. আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
বলুন যে ভাষা কখনো মরে না যদি আমরা তাকে ভালোবাসি এবং বাঁচিয়ে রাখি। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ইউটিউব, পডকাস্টের যুগে অপ্রচলিত শব্দগুলোকে পুনরায় জনপ্রিয় করার সুযোগ আগের চেয়ে অনেক বেশি।
৫. শেষের শক্তিশালী লাইন
একটা স্মরণীয় বাক্য দিয়ে শেষ করুন। কিছু উদাহরণ (আপনি নিজের মতো বদলে নিতে পারেন):“যতক্ষণ আমরা ‘অম্বু’ বলব, ততক্ষণ আমাদের মুখে গঙ্গার জলের স্বাদ লেগে থাকবে।”“একটা শব্দ বাঁচিয়ে রাখলে আমরা আসলে একটা পুরো যুগকে বাঁচিয়ে রাখি।”“আসুন, আমাদের মায়ের ভাষাকে আবার তার পুরোনো গয়না পরিয়ে দিই।”
৬. পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন
শেষে একটা প্রশ্ন বা আমন্ত্রণ রাখুন:“আপনার প্রিয় অপ্রচলিত শব্দ কোনটি? কমেন্টে জানান। যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মানুষের পছন্দ হবে, পরের লেখায় তার ওপর বিস্তারিত আলোচনা করব।”