- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
সুশাসন
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
সুশাসন
সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যাসমূহ | Problems of Good Governance
জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে সুশাসন অপরিহার্য। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ সমস্যা ও অন্তরায় পরিলক্ষিত হয়। নিচে এ সমস্যাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব সুশাসনের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সরকারি কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার তীব্র অভাব পরিলক্ষিত হয়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বড় সমস্যা।
২. দায়িত্বশীলতার অভাব দায়িত্বশীলতার অভাব সুশাসনের জন্য আর একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ যদি তাদের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে, তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম বড় বাধা। এর ফলে আইনের অপপ্রয়োগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকে ব্যাপকভাবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি দেশের গণতন্ত্র নিশ্চিত করে। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
৪. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক যে কোনো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সমস্যা। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় স্বার্থকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকে। তাই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সবসময়ই একটি দ্বন্দ্ব কাজ করে।
৫. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সুশাসন প্রতিষ্ঠার আর একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনসহ আমাদের সমাজের সর্বত্রই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করছে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন কাজে ও নিয়োগে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি পরিলক্ষিত হয়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা।
৬. স্বাধীন বিচার বিভাগের অভাব: স্বাধীন বিচার বিভাগের অভাব সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সমস্যা। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন, "There is no better test of the excellence of government than the efficiency of its judicial system." অর্থাৎ, "সরকারের উৎকর্ষতা পরিমাপের জন্য বিচার ব্যবস্থার দক্ষতার চেয়ে উৎকৃষ্টতর কোনো মাপকাঠি নেই।" কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব লক্ষ করা যায়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বড় অন্তরায়।
৭. নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী গণমাধ্যমের অভাব সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সমস্যা হলো নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী গণমাধ্যমের অভাব। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণমাধ্যম তাদের ভূমিকা সঠিক ও কার্যকরভাবে পালন করতে পারে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার অভাব সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে।
৮. রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও একটি বড় বাধা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব। দেশের জাতীয় বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতানৈক্য দেখা যায়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা।
৯. আইনের শাসনের অভাব আইনের শাসনের অভাব সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম অন্তরায়। আইনের শাসন অর্থ আইন ধারাই রাষ্ট্র ও সমাজের সবকিছু নিয়ান্ত্রিত হবে। সবাই আইনের সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে। তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ অনেকটা সহজ হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশসমূহে নানা কারণে আইনের আশ্রয় লাভ ও সুবিচার প্রাপ্তি জনগণের কাছে স্বপ্নের মতো।
১০. রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করে থাকে। নেতৃত্ব যদি অসৎ, অদক্ষ হয়ে থাকে এবং জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে দলীয় স্বার্থ বা ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে, তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১১. আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সুশাসনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। আমলারা অনেক সময় নিজেদের জনগণের সেবক না ভেবে প্রভু ভাবতে থাকেন। ফলে তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতায় মানসিকতার অভাব দেখা দেয়। এ ধরনের মানসিকতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বাধা হিসেবে কাজ করে।
১২. সরকারি ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা সুশাসনের জন্য সঠিক সময়ে সরকারি নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন জরুরি। অনেক সময় সরকারি ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা এবং ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সরকারি নীতি, জনকল্যাণের কর্মকাণ্ড ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হতে পারে না। ফলে দেখা দেয় অরাজকতা, যা সুশাসকে ব্যাহত করে।
১৩. জনগণের অংশগ্রহণের অভাব সরকারি নীতি গ্রহণ, বাস্তবায়ন তথা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ বা মতামত প্রদানের সুযোগের অভাব সুশাসনের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে। সরকারি কর্মকাণ্ডে জনগণের মতামত, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না ঘটলে তা সফল হতে পারে না।
১৪. সামরিক হস্তক্ষেপ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সামরিক শাসন গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকারকে ভুলুণ্ঠিত করে। নাগরিক অধিকারকে করে সংকুচিত। ফলে অনিবার্যভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
১৫. গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব: স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম যেমন- সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট প্রভৃতি সুশাসনের জন্য প্রয়োজন। অনেক সময় সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে। ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ে। যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৬. সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভাব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের অভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই রাজনৈতিক বিরোধ ও হানাহানি লেগেই থাকে। এ ধরনের সামাজিক অস্থিরতা, শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
১৭. কার্যকর স্বানীয় সরকারের অভাব শক্তিশালী, দক্ষ ও কার্যকর স্থানীয় সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত। কার্যকর স্থানীয় সরকার যেমন জনগণের কল্যাণ সাধন করে, তেমনি স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন দেশসমূহে স্থানীয় সরকার কাঠামো খুবই দুর্বল ও অকার্যকর হওয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
১৮. দারিদ্র্য ও অশিক্ষা: দারিদ্র্য ও অশিক্ষা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় রকমের বাধা। দারিদ্র্যের কারণে অনেক দেশের জনগণ সহজে শিক্ষিত ও সচেতন হয়ে উঠতে পারে না। ফলে তারা নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে তেমন সজাগ থাকে না। এ ধরনের অজ্ঞতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করে।
১৯. রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতা রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা। অনেক দেশেই সরকার ও বিরোধী দলসমূহের তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ দেশে হানাহানি, জ্বালাও-পোড়াও এর মাধ্যমে অশান্তিময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এতে যেমন জানমালের ক্ষতি হয়, তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
২০. গণসচেতনতার অভাব দেশের জনগণ সচেতন না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হয় না। জনগণ নিজ অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হলে সরকারও দায়িত্বশীল হয়। এ ধরনের পরিবেশ সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে বেগবান করে।
২১. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব দেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত বিভিন্ন ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতিময় সম্পর্ক না থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব সুশাসনের পরিবর্তে সমাজে বিষময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ।
২২. দেশপ্রেমের অভাব সুশাসনের জন্য সরকার ও জনগণ সকলের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম প্রয়োজন। যে সমাজে দেশপ্রেমের অভাব পরিলক্ষিত হয় সেখানে সুশাসনের পরিবর্তে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্র ও সমাজকে গ্রাস করে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ