- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- অষ্টম শ্রেণি
- বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও বিকাশের ধারা
বাঙালি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অধিকারী একটি প্রাচীন জাতি। মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করে, যেসব জিনিস ব্যবহার করে, যেসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, যা কিছু সৃষ্টি করে, সব নিয়েই তার সংস্কৃতি। খাদ্য, বাসস্থান, তৈজসপত্র, যানবাহন, পোশাক, অলঙ্কার, উৎসব, গীতবাদ্য, ভাষা-সাহিত্য সবই তার সংস্কৃতির অংশ। তবুও এর মধ্যে সৃষ্টিশীল কিছু কিছু কাজ সংস্কৃতির বিচারে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব কাজে একটি জাতির চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলোকে আমরা বলি শিল্পকলা। আমরা আমাদের সেই সব সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হব এবং দৃশ্যশিল্প, সাহিত্যশিল্প ও সঙ্গীতশিল্প এই তিন শাখায় আমাদের অবদান ও কীর্তি স্মরণ করব।
দৃশ্যশিল্প: এগুলো বেশিরভাগই বস্তুগত শিল্প বা সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত। পলিমাটিতে গড়া আমাদের এই দেশ। এই দেশে একদিকে মাটি আর অন্যদিকে এ মাটিতে জন্মানো বাঁশ মানুষের ঘর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সুনির্মিত ঘর হলো মাটির তৈরি ও বাঁশের তরজার ছাউনিযুক্ত দোচালা, চারচালা, এমনকি আটচালা। কখনো কখনো বাঁশের কাঠামোর উপর শন দিয়ে চাল ছাওয়া হয়। এখনও গ্রামগঞ্জে এরকম ঘর দেখা যায়।
একসময় ছাঁচ অনুযায়ী মাটির তৈরি ইট দিয়ে মন্দির বানানো হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে শিল্পমূল্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাটির ফলক বা পাত তৈরি করে তাতে ছবি অঙ্কন করে পুড়িয়ে স্থায়ী রূপ দেওয়া। এগুলোকে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির শিল্প বলা হয়। দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরে এভাবে পোড়ামাটির শিল্পকর্মে রামায়ণের কাহিনিসহ নানা সামাজিক জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারেও পোড়ামাটির প্রচুর কাজ আছে। এতে সেকালের সমাজ জীবনের ছবি পাওয়া যায়। কালো রঙের কষ্টিপাথর আর নানা রকম মাটি দিয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি বানানোর ঐতিহ্যও বেশ পুরানো।
তবে পালযুগে তালপাতার পুঁথিতে দেশীয় রং দিয়ে যেসব ছবি আঁকা হয়েছে তার প্রশংসা আধুনিক বিশ্বের শিল্পরসিকদের কাছ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে। হাজার বছর পরেও ছবিগুলো চমৎকার ঝকঝকে রয়েছে। পুঁথিগুলো ছিল বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের।
বাংলার তাঁতশিল্পের সুনাম বহুকালের। প্রাচীন বাংলার দুকুল কাপড়ের বেশ খ্যাতি ছিল। কৌটিল্য বলেছেন, পুণ্ড্রদেশের (উত্তরবঙ্গ) দুকুল শ্যামবর্ণ এবং মণির মতো মসৃণ। দুকুল ছিল খুব মিহি আর ক্ষৌমবস্ত্র একটু মোটা। পত্রোর্ণ নামে এন্ডি বা মুগা জাতীয় সিল্ক তৈরি হতো মগধ ও পুঞ্জে। সেকালে এদেশের দুকুল, পত্রোর্থ, ক্ষৌম ও কার্পাস কাপড় বিদেশে রপ্তানি হতো।
বাংলায় বিভিন্ন সময় যেসব কাপড় উৎপন্ন হতো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খাসা, এলাচি, হামাম, চৌতা, উতানি, সুসিজ, কোসা, মলমল, দুরিয়া, শিরবান্দ ইত্যাদি। বাংলার বিখ্যাত মসলিন কাপড় এতই সূক্ষ্ম ও উন্নতমানের ছিল যে, এ কাপড় নিয়ে বহু কাহিনি বা কিংবদন্তির সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলার শাড়ির খ্যাতিও বহুকালের সিল্ক, জামদানি, টাঙ্গাইল, মসলিন, গরদ ইত্যাদি এখনও সুপরিচিত।
সুলতানি আমল থেকে বাংলার স্থাপত্যশিল্পে ইরানি প্রভাব পড়তে শুরু করে। গম্বুজ ও খিলানসহ মসজিদ তো নির্মিত হয়েছেই, অনেক দপ্তর ও বাড়িঘরও তৈরি হয়েছে এই রীতিতে। ছোটো সোনা মসজিদ, নবাব কাটরা, ঢাকার লালবাগের কুঠি এ সময়ের স্থাপত্য নিদর্শন।
বাংলার নকশিকাঁথার কথা না বললেই নয়। গ্রামীণ নারীরা ঘরে ঘরে কাঁথা সেলাই করে তাতে আশ্চর্য নিপুণতায় গল্পকাহিনি ও ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। এখনও গ্রামীণ সমাজের নারীরা এই শিল্পকর্মটি টিকিয়ে রেখেছেন।
এছাড়া কাঠের কাজ বা কারুশিল্প, শঙ্খের কাজ, বাঁশ-বেত ও শোলার কাজেও বাংলার মানুষ যেমন দক্ষতা দেখিয়েছে তেমনি তাদের সৃজনশীল মনের প্রকাশ ঘটিয়েছে।
সাহিত্য: বাঙালির প্রথম যে সাহিত্যকর্মের সন্ধান পাওয়া যায় তা চর্যাপদ নামে পরিচিত। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রথম নেপালের রাজদরবার থেকে এগুলো আবিষ্কার করেন। পরে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের কাল নির্ণয় করেন। তিনি গবেষণা করে জানান প্রায় বারোশো বছর আগে বৌদ্ধ সাধকরা এগুলো লিখেছেন। এখন হয়ত আমাদের পক্ষে এগুলো বোঝা কঠিন হবে। তাছাড়া শাব্দিক অর্থ ছাড়াও এগুলোর ভাবার্থও বুঝতে হয়। এগুলোই হলো আদি বাংলা সাহিত্যের নমুনা। চর্যাগীতির বিখ্যাত রচয়িতাদের মধ্যে ছিলেন লুইপা এবং কাহ্নপা প্রমুখ। আমরা নিচে চর্যাপদের একটি নমুনা ও তার অনুবাদের সঙ্গে পরিচিত হব।
লুই পা লিখেছেন-
কা আ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল।
বাংলায় এর শাব্দিক অর্থ হলো-
শ্রেষ্ঠ তরু এই শরীর, পাঁচটি তার ভাল। চঞ্চল চিত্তে কাল (ধ্বংসের প্রতীক) প্রবেশ করে।
এর ভাবার্থ হলো- শরীরের পাঁচটি ইন্দ্রিয় পাঁচটি ডালস্বরূপ। এই পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে জানাশোনা চলে। এতে বেশি আকৃষ্ট হলে বস্তুজগতকেই মানুষ চরম ও পরম জ্ঞান করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
সুলতানি আমলে শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ভাবধারার প্রভাবে বাংলায় কীর্তন গান রচনার জোয়ার আসে। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার কাহিনি নিয়ে এসব আবেগপূর্ণ গান রচিত হয়েছে। এগুলো বৈষ্ণব পদাবলী নামে পরিচিতি। বৈষ্ণব সমাজব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমানে এতই ঘনিষ্ঠ ভাব ছিল যে অনেক মুসলমান কবিও পদাবলি রচনা করেছেন।
দেশীয় দেবদেবীকে নিয়েও নানা কাব্যকাহিনি রচিত হয়েছে এক সময়। এগুলো মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল, ঘনরামের ধর্মমঙ্গল, বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এছাড়া ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে সেকালের বাংলার সমাজচিত্র পাওয়া যায়।
মুসলমান সমাজে পুঁথি সাহিত্যের ব্যাপক কদর ছিল। পারস্য থেকে পাওয়া নানা কল্পকাহিনি এবং রোমান্টিক আখ্যান নিয়ে এগুলো রচিত হতো। সেকালে বাড়ি বাড়ি পুঁথি পাঠের আসর বসত, আবার পুঁথি নকল করে সংরক্ষণও করা হতো। ইউসুফ-জুলেখা, লায়লি-মজনু, সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান, জঙ্গনামা, গাজিনামা ইত্যাদি বিখ্যাত সব পুঁথির নাম। আলাওল রচিত পদ্মাবতী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে আলোচিত।
ইংরেজ আমলে উনিশ শতকে আমাদের দেশে বাংলা গদ্যের সূচনা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিত গড়েছেন, বঙ্কিমচন্দ্র ও সমসাময়িক সাহিত্যিকরা যার উপর সৌধ তুলেছেন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে শোভন ও সুন্দর করে পূর্ণতা দিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন।
সংগীত শিল্প
বাংলা চিরকালই সংগীতের দেশ। এখানকার মাঠে-প্রান্তরে কৃষক হাল চাষ করতে করতে যেমন গান বেঁধেছে তেমনি নদী ও খালে নৌকা বাইতে বাইতে মাঝিও গলা ছেড়ে গান গেয়েছে। আবার সাধারণ মানুষ তার মতো করে গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধনা করেছে। আমরা সাহিত্য-শিল্পের আলোচনায় আমাদের দুই আদি সংগীত চর্যাপদ ও বৈষ্ণব পদাবলীর কথা আগেই জেনেছি। কীর্তনগান প্রধানত হিন্দু সমাজে হতো, এখনও হয়। তবে বাউল ও ভাটিয়ালি গান গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সকলেই গেয়ে থাকে। মুর্শিদি, পালাগান, বারমাস্যা, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা ইত্যাদি বহু ধরনের আঞ্চলিক লোকগান ছড়িয়ে আছে সারা বাংলা জুড়ে।
শহরাঞ্চলে একসময় পাঁচালি, খেউড়, খেমটা প্রভৃতি গানের আসর বসত। তবে উত্তর ভারতের সংস্পর্শে এসে হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের সাথে বাঙালি সংগীত সাধকদের পরিচয় ঘটে। তার প্রভাবে এখানে নাগরিক সংগীতের বিকাশ ঘটে। নিধুবাবু, কালী মির্জা প্রমুখ হয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলার নাগরিক গান উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছায়। তাঁরই গান আজ আমাদের জাতীয় সংগীত- 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'। এ গানের সুর তিনি নিয়েছেন বাউল গানের সুর থেকে। রবীন্দ্রনাথের পথ ধরে পরে আরও অনেকেই বাংলার নাগরিক গানকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আপন স্বাতন্ত্র্যে ও বৈচিত্র্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। মাত্র কুড়ি বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি প্রায় ছয় হাজারের মতো গান লিখেছেন। অতুল প্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন-আধুনিক বাংলা গানের সমৃদ্ধিতে এঁদের অবদানও ব্যাপক।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

