- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- মহুয়া [গদ্য]
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
মহুয়া [গদ্য]
মহুয়া- দ্বিজ কানাই
মহুয়া
দ্বিজ কানাই
গারো পাহাড় পেরিয়ে হিমানী পর্বত ছাড়িয়ে 'সপ্ত সমুদ্দুর' পারে বাঘ-ভালুকের বসতি রয়েছে এমন নির্জন বনে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা বাইদ্যা। তার ছোট ভাই মাইন্কা। এই বেদের দল ভ্রমণ করতে করতে এল ধনু নদীর পারে কাঞ্চনপুর গ্রামে। সেখানে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের-
ছয় মাসের শিশুকন্যা পরমা সুন্দরী।
রাত্রি নিশিকালে হুমরা তারে করল চুরি ।
এক দুই তিন করি শুল বছর যায়।
খেলা কছরত তারে যতনে শিখায় ।
বাইদ্যা বাইদ্যা করে লোকে বাইদ্যা কেমন জনা।
আন্দাইর ঘরে থুইলে কন্যা জ্বলে কাঞ্চা সোনা ॥
হাট্টিয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল।
মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল ।।
আগল ডাগল আখিরে আস্থানের তারা।
তিলেক মাত্র দেখলে কইন্যা না যায় পাশুরা ॥
মুনির মন টলে যাওয়ার মতো সুন্দরী হয়ে ওঠে সে। নাম তার মহুয়া সুন্দরী। অনেক দিন পরের কথা। বেদের দল উপস্থিত হলো বামনকান্দা গ্রামে। তাদের সঙ্গে রয়েছে খেলা দেখানোর নানা উপকরণ-
তোতা লইল ময়না লইল আরও লইল টিয়া।
সোনামুখী দইয়ল লইল পিঞ্জিরায় ভরিয়া ॥
ঘোড়া লইল গাধা লইল কত কইব আর।
সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়।
শিকারি কুকুর লইল শিয়াল হেজা ধরে।
মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে ॥
এই গ্রামে বাস করে নদ্যার চাঁদ-পূর্ণিমার চাঁদের মতো তার রূপ। মায়ের অনুমতি নিয়ে সে 'বাইর বাড়ি'র মহলে বাইদ্যার খেলার আয়োজন করে। বেদে কন্যার রূপের কথা আগেই শুনেছিল নদ্যার চাঁদ-স্বচক্ষে তা দেখে এবং খেলা কসরতে মুগ্ধ হয়ে মহুয়াকে সে হাজার টাকার শালসহ নানা বশিস প্রদান করে। তাদের উলুয়াকান্দায় বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য জমি প্রদান করে।
বেদের দলের দিন কাটছিল সুখেই। পরস্পরের প্রতি মুগ্ধ নদ্যার চাঁদ ও মহুয়ার এক সন্ধ্যাবেলা জলের ঘাটে দেখা হয় এবং ব্যাকুল হৃদয়ের কথা জানাজানি হয়।
'জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ মন।
কাইল যে কইছিলাম কথা আছে নি স্মরণ'।
'শুন শুন ভিনদেশি কুমার বলি তোমার ঠাঁই। কাইল বা কি কইছলা কথা আমার মনে নাই । তুমি ত ভিনদেশি পুরুষ আমি ভিন্ন নারী। তোমার সঙ্গে কইতে কথা আমি লজ্জায় মরি'।
'কেবা তোমার মাতা কইন্যা কেবা তোমার পিতা।
এই দেশে আসিবার আগে পূর্বে ছিলি কোথা'।।
'নাহি আমার মাতাপিতা গর্ভ সুদর ভাই।
সুতের হেওলা অইয়া ভাইস্যা বেড়াই'।
দিন যায়। দিবস রজনী আনমনা মহুয়ার মনের খবর জানতে পারে পালঙ্কসই- পরামর্শ দেয় ভুলে যাবার। মহুয়া বলে।
চন্দ্রসূর্য সাক্ষী সই সাক্ষী হইও তুমি।
নদ্যার ঠাকুর হইল আমার প্রাণের সোয়ামী ॥
বাইদ্যার সঙ্গে আমি যে সই যথায় তথায় যাই। আমার মন বানধ্যা রাখে এমন স্থান আর নাই ।।
বন্ধুরে লইয়া আমি অইবাম দেশান্তরি। বিশ খাইয়া মরবাম কিম্বা গলায় দিয়াম দড়ি ॥
এদিকে চিরকেলে ভ্রমণ-পিয়াসী বেদের দলের এই গৃহী জীবন বাইদ্যা সর্দার হুমরার ভালো লাগে না। মাইনকার সাথে সে ভিনদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ করে। সময় থেমে থাকে না। ফাগুন যায় যায়। নির্ঘুম নদের চাঁদ মধ্যরাতে বাঁশি তুলে নেয় হাতে। সে বাঁশির আহ্বানে ছুটে আসে প্রাণপ্রতিমা মহুয়া। মহুয়া জানায়-
শুন শুন নদ্যার ঠাকুর বলি যে তোমারে।
এই না গেরাম ছাড়্যা যাইবাম আজি নিশাকালে ॥ তোমার সঙ্গে আমার সঙ্গেরে বন্ধু এইনা শেষ দেখা। কেমন কর্যা থাকবাম আমি হইয়া অদেখা ॥ আর না শুনবাম রে বন্ধু তোমার গুণের বাঁশি। আর না জাগিয়া বন্ধু পুয়াইবাম নিশি। মনে যদি লয়রে বন্ধু রাখ্যো আমার কথা। দেখা করতে যাইও বন্ধু খাওরে আমার মাথা ॥
যাইবার কালে একটি কথা বল্যা যাই তোমারে।
উত্তর দেশে যাইও তুমি কয়েক দিন পরে ।।
সেইদিনই অন্ধকার রাতে বেদের দল উত্তর দেশে পালিয়ে যায়- সকাল বেলা এলাকার সবাই দেখে বাড়িঘর সবই আছে কিন্তু বেদের দল নেই। খবর পৌঁছে যায় নদের চাঁদের কাছে। আহার নিদ্রা ত্যাগ করে সে পাগল হয়ে ওঠে মহুয়ার সন্ধানে। গভীর বেদনা সত্ত্বেও একদিন ঘুমন্ত মায়ের পায়ে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়ে নদের চাঁদ। ঘুরতে থাকে মাসের পর মাস, যে পথে গেছে বেদের দল। সবাইকে জিজ্ঞাসা করে তার মহুয়াকে দেখেছে কি-না।
এদিকে পুত্রের অদর্শনে কাঁদতে কাঁদতে মা প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। অগ্রহায়ণ মাসের অল্প শীতে কংসাই নদীর পাড়ে নদের চাঁদ মহুয়াকে পেল। আহার নিদ্রাহীন মহুয়া তখন পাগলপ্রায়। সংসারে মন নেই, শরীরের দিকে তাকানো যায় না। সেই মহুয়া নদের চাঁদের আগমনে-
আজি কেনে অকস্মাতে হইল এমন ধারা।
ছয় মাইস্যা মরা যেন উঠ্যা হইল খারা ।
দেল ভরিয়া কন্যা করিল রন্ধন।
জাতি দিয়া নদীয়ার ঠাকুর করিল ভোজন।।
হুমরা বাইদ্যাও নতুন অতিথিকে তার দলে বরণ করে নিল- কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ভিন্ন। গভীর রাতে বিষমাখানো ছুরি মহুয়ার হাতে দিয়ে বলল-
'আমার মাথা খাওরে কন্যা আমার মাথা খাও দুষমনে মারিয়া ছুরি সাওরে ভাসাও।'
মহুয়ার সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। ঘুমন্ত প্রিয়তমের কাছে এসে সকল বৃত্তান্ত জানিয়ে নিজ বুকে ছুরি বসাতে চায়। এমন সময় জেগে ওঠে নদের চাঁদ। সকল ঘটনা শুনে বলে-
'তোমার লাগিয়া কন্যা ফিরি দেশ বিদেশে।
তোমারে ছাড়িয়া কন্যা আর না যাইবাম দেশে।
কী কইবাম বাপ মায়ে কেমনে যাইবাম ঘরে।
জাতি নাশ করলাম কন্যা তোমারে পাইবার তরে ।।
তোমায় যদি না পাই কন্যা আর না যাইবাম বাড়ি।
এই হাতে মার লো কন্যা আমার গলায় ছুরি'।।
'পইড়া থাকুক বাপ মাও পইড়া থাকুক ঘর।
তোমারে লইয়া বন্ধু যাইবাম দেশান্তর।।
দুই আঁখি যে দিগে যায় যাইবাম সেইখানে।
আমার সঙ্গে চল বন্ধু যাইবাম গহিন বনে'।।
চন্দ্র সূর্য সাক্ষী রেখে, বাপের বাড়ির তাজি ঘোড়ায় চড়ে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে দুজন। পথে পার্বত্য খরস্রোতা নদী। তাজি ঘোড়া বিদায় দিয়ে দুজন তখন পারাপারের চিন্তায় অস্থির। এমন সময় ভিনদেশি এক সাধুর নৌকা পেয়ে তারা তাতে উঠে পড়ে। মহুয়ার রূপ-যৌবনে মুগ্ধ সাধু কৌশলে নদের চাঁদকে 'উজান পাকে' ফেলে দেয়। মহুয়াকে পাওয়ার ইচ্ছায় তাকে সে রানি করে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। নানা প্রতিশ্রুতির পর-
এতেক শুনিয়া মহুয়া কী কাম করিল।
সাধুর লাগিয়া কন্যা পান বানাইল ॥
পাহাড়িয়া তক্ষকের বিষ শিরে বান্ধা ছিল।
চুন-খয়েরে কন্যা বিষ মিশাইল ।
হাসিয়া খেলিয়া কন্যা সাধুরে পান দিল মুখে।
রসের নাগইরা পান খায় সুখে ॥
'কী পান দিছলো কন্যা গুণের অন্ত নাই।
বাহুতে শুইয়া তোমার আমি সুখে নিদ্রা যাই'।।
'পান খাইয়া মাঝিমাল্লা বিষে পরে ঢলি।
নৌকার উপরে কন্যা হাসে খলখলি'।
অচৈতন্য সাধুসহ নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে নদীপারের বনে প্রিয়কে খুঁজতে থাকে মহুয়া। এক ভাঙা মন্দিরে মুমূর্ষু নদের চাঁদকে খুঁজে পায় সে। এখানেও এক বৃদ্ধ জটাধারী সন্ন্যাসীর কবলে পড়ে মহুয়া। সন্ন্যাসীর হাত থেকে বাঁচার জন্য শেষ পর্যন্ত এক রাত্রে অসুস্থ নদ্যার চাঁদকে কাঁধে নিয়ে বন ত্যাগ করে। অন্য বনে দিনে দিনে সুস্থ হয়ে ওঠে নদের চাঁদ। সুখেই কাটে সময় এই বনদম্পতির। কিন্তু একদিন হঠাৎ বংশী ধ্বনি শুনে চমকে ওঠে মহুয়া- চোখ থেকে গড়ায় পানি। নদের চাঁদ ভাবে- তার প্রাণপ্রতিমা হঠাৎ এমন বিরস-বদন ও চঞ্চল কেন? হুমরা বাইদ্যা ছোটকালে তাকে চুরি করে এনেছে, এটুকুর বাইরে তার জন্মপরিচয় আজও যে শোনা হলো না। মহুয়া জানায়- কালকে যদি সে বেঁচে থাকে তাহলে সেকথা বলবে। বলতে বলতেই ঢলে পড়ে সে। নদের চাঁদ ভাবে মহুয়াকে হয়ত সাপে কেটেছে। সেমতেই সে পরিচর্যা করতে চায়। তখন-
কান্দিয়া মহুয়া কয়, এই শেষ দিন।
সাপে নাহি খাইছে মোরে গেছে সুখের দিন ॥ দূর বনে বাজল বাঁশি শুন্যাহ যে কানে। আসিছে বাদ্যার দল বধিতে পরাণে ॥ আমারও পালং সই বাঁশি বাজাইল। সামাল করিতে পরান ইসারায় কহিল । আইজ নিশি থাকরে বন্ধু আমার বুকে শুইয়া।
আর না দেখিব মুখ পরভাতে উঠিয়া'।।
ঘুম ভাঙতেই দেখে সামনে হুমরা বাইদ্যা দাঁড়ানো। হুমরা মহুয়াকে নির্দেশ দেয় দুশমন নদের চাঁদকে মেরে সুজনকে বিয়ে করতে। সর্দার মহুয়ার হাতে তুলে দেয় বিষলক্ষার ছুরি। মৃত্যু আসন্ন জেনে মহুয়া বলে-
শুন শুন প্রাণপতি বলি যে তোমারে।
জন্মের মতন বিদায় দেও এই মহুয়ারে ।
শুন শুন মাও বাপ বলি হে তোমায়।
কার বুকের ধন তোমরা আইনাছিলা হায় ।।
জনিন্ময়া না দেখলাম কভু বাপ আর মায়।
কর্মদোষে এত দিনে প্রাণ মোর যায় ॥
বলতে বলতে মহুয়া নিজের বুকেই ছুরি বিদ্ধ করে। হুমরার আদেশে বেদের দল নির্মমভাবে হত্যা করে নদের চাঁদকে। অনুশোচনা জাগে হুমরা বাইদ্যার। ভালোবাসার অমলিন স্মৃতি জাগিয়ে রেখে দুজনেই শায়িত হয় এক কবরে।
তাদের কবরে টুপটুপ ঝরে পড়ে পালঙ্ক সইয়ের মতো নানা জনের চোখের জল।
[গদ্যে রূপান্তরিত]
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

