• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • গহন কোন বনের ধারে [গদ্য]
গহন কোন বনের ধারে [গদ্য]

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

গহন কোন বনের ধারে [গদ্য]

গহন কোন বনের ধারে - দ্বিজেন শর্মা

উঁচু টিলার ওপর একটা চালাঘর, ছনের ছাউনি, এক চিলতে বারান্দা, ঝকঝকে নিকোনো উঠোন, চারদিকে অনুচ্চ পাঁচিল, তারপর নিবিড় বন, টিলার পর টিলা- পুবে উত্তরে দক্ষিণে সীমানাহীন, কে জানে কোথায় ঠেকেছে, হয়তো-বা হিমালয়ে। পশ্চিমটাই শুধু কিছুটা খোলা, সবুজ নদীর মতো একফালি ধানখেত এঁকেবেঁকে চলেছে ছোট ছোট টিলার ফাঁকে ফাঁকে, পাশে একটা ছড়া- কাঁকড়ের ওপর গড়িয়ে চলা কল্লোলিত স্বচ্ছ জলধারা, এমন যে পায়ের পাতাটুকুই কেবল তাতে ডোবে, কিন্তু বৃষ্টি নামলেই প্রমত্তা, ঘোলাজলের ঢল পাক খেতে খেতে পাড়-খেত জমিন ডুবিয়ে দিয়ে গর্জে ছুটে চলে।

তখন সবে পাঠশালার পাঠ শেষ হয়েছে। বাড়ি থেকে মাইল চারেক দূরের হাইস্কুলে যাওয়া-আসা করার মতো শক্ত হয়ে উঠি নি বলে এক বছরের ছুটি মিলেছিলো। ছুটির এই সময়টার বেশির ভাগই কাটে পাহাড়ের ওই টিলাবাড়িতে। মাঝেমধ্যে মা আসতেন, নইলে একমাত্র অভিভাবক শোভা বুড়ো- বাগানের পাহারাদার। ছ'ফুট লম্বা, দশাসই চেহারা, কচকুচে কালো গায়ের রঙ, মাথায় মস্ত টাক, কানছুঁয়ে ঘাড়ের দিকে চুলের একটা হালকা ঘের, দাড়িগোঁফ নেই, পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে ফতুয়া- এই আমাদের শোভা বুড়ো। জাতটাতের দিক থেকে কোল-ভিল-সাঁওতাল-এই রকম কিছু একটা হবে হয়তো, বাগানের দলছুট কুলি। রোগা আর কচে, গরু চরাতো, ফাইফরমাশ খাটতো।

শোভা বুড়োর অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে মন কাড়তো এমন কিছু কিছু জিনিসের কোনোটাই সে আমাদের ছুঁতে দিতো না: তার কাঁধসমান উঁচু একটা ধনুক, একগাদা তীর, উদ্ভট আকারের ধপধপে শাদা ধারালো তিনটা দা, ছুলোর ওপর দেয়ালে গুঁজে রাখা নানা রঙের পাখির পালক। অবসর সময় সে মাছ ধরার চাঁই, পাখির ফাঁদ বানাতো। তীরের জন্য বাঁশের কঞ্চি, ফাঁদের সুতোর জন্য উদাল গাছের ছাল শুকোতে দিতো উঠোনের কোণে। তার সব কিছুই ছিলো ছিমছাম, আমরা হাত লাগালে বুড়ো ভারি বিরক্ত হতো। অবশ্য মনমেজাজ ভালো থাকলে সে আমাদের ফাঁদ তৈরি শেখাতো, তীর-ধনুক ধরতে আর লক্ষ্যভেদের তালিম দিতো।

অচিরেই আমরা শিকারী হয়ে উঠলাম। তির, ধনুক আর একগাদা ফাঁদ নিয়ে বনে বনে ঘুরতাম। অস্ত্র আমাদের দুঃসাহস দিয়েছিলো। আহ্লাদের সঙ্গে থাকতে ভয় ছিলো না। শিকারে তেমন কিছুই জুটতো না, সারা বছরে গোটা দুয়েক কাঠবেড়ালী, তিন-চারটা পুচকে পাখি, সবই শোভা বুড়োর ভোজে লেগেছিলো। যা ছিলো একান্ত কাঙ্ক্ষিত তাই অলভ্য থেকে গিয়েছিলো: বনমোরগ, তিতির আর হরিয়াল। একটা গাছে ফল পাকলে ঝাঁক ঝাঁক হরিয়াল হুটোপুটি খেত। এক অদম্য নেশা আমাদের বাঁশবনের গভীরে, নলখাগড়ার ঝোপ, লতাপাতা-জড়ানো খানাখন্দ টানতো, আটকে রাখতো, কিছুতেই বাড়ি ফিরতে দিতো না।

শোভা বুড়ো ব্যাপারটা লক্ষ্য করে থাকবে। একদিন আমাদের সঙ্গে নিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে ওদিকে পা বাড়াতে নিষেধ করলো। আমরা অবাক। বারবার জিগ্যেস করেও হেতুটি জানা গেলোনা। শোভা বুড়ো কপালে জোড়হাত তুলে। কেবলই বলে, 'ওখানে দেওতার বাস, নাম নিতে মানা।' আকারে-ইঙ্গিতে শেষ পর্যন্ত বোঝালো তার অর্থ- ওখানে একজোড়া সাপ থাকে, ভয়ঙ্কর, ওরা লেজ দিয়ে ঝেটিয়ে ঝেটিয়ে শুকনো পাতা, ডালপালা আর মাটির ঢেলা দিয়ে বাসা বানায়, তাতে ডিম পাড়ে। ডিম ছেড়ে দূরে যায় না, আর তখন কাছেপিঠে কেউ গেলে নির্ঘাৎ মরণ। এমনকি হাতির মতন জানোয়ারেরও রেহাই নেই।

শরতের দুপুর। ঝলমলে দিন। ঝোপঝাড় উচ্ছিত পাতায় নিবিড়। দেখলাম, পিচাশ ঝাড়ের ওপর শরীর এলিয়ে তিনি রোদ পোহাচ্ছেন কিংবা কোনো শিকারের দিকে নজর রাখছেন। হাত দশেক লম্বা, ডলু বাঁশের মতো মোটা, ধূসর-কালো রঙ, সারা গায়ে অনেকগুলো শঙ্খধবল বেড়। আমাদের উপস্থিতি তার বিরক্তি ঘটিয়ে থাকবে। তাই প্রথমে ফস্ করে মাথাটা তুললেন, পরমহূর্তে শরীরের অর্ধেকটাই খাড়া করলেন, ফণাটি মেললেন যেনো ছোটোখাটো একটা কুলো এবং এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন আমাদের ভস্ম করে ফেলবেন। জ্বলজ্বলে হিংস্র ওই চোখ দুটো এখনো মনে পড়লে শরীরে কাঁপুনি ধরে। তিনি মহানাগ শঙ্খচুড়।

শোভা বুড়ো মাঝে মাঝে কোথায় যেন উধাও হতো। শুরুতে কিছুই বলতো না, তবে আমরা প্রস্তুতি টের পেতাম। সে তার ধনুকে তেল ঘষতো, তিরগুলো তুণে রাখতো, সারাদিন বসে দা ধারাতো। সকালে উঠে দেখতাম সে নেই। বদলি হয়ে এসেছে তার বন্ধু বুধু, মাঝবয়সী, বাগানের দলছুট কুলি, একটু বোকা ধরনের। আমাদের দারুণ ফুর্তি। বুড়োর বকাঝকার ঝক্কি নেই। যথেচ্ছাচারের অবাধ সুযোগ। বুধু নির্দ্বিধায় আমাদের সবগুলো আবদার মেটাতো, ভালো ভালো খাবার রাঁধতো, রাতে শুয়ে শুয়ে যতো রাজ্যের পাহাড়ি গল্পআমি, কচে আর রোগা প্রায়ই ওই ছড়ার জল ছিটিয়ে-ছিটিয়ে হাঁটতাম, উজিয়ে যেতাম অনেক দূর, নিরালোক গহনবনে। ছড়ার বাঁকে বাঁকে কিছুটা বেশি জল, হাঁটু কিংবা কোমর অবধি, তাতে নানান কুঁচোমাছের তিড়িং বিড়িং ছুটোছুটি, আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। এইসব ছোটোখাটো ডহরের আশপাশে ছড়ানো বড় বড় পাথর সবুজ শ্যাওলায় ঢাকা, পাড়ে মুলি বাঁশের ঘন বন, আনাচে-কানাচে ফার্নের ঝোপ, অচেনা যত ঘাসপাতা। এই নিঃশব্দ আলোআঁধারির মাঝখানে ভয় ও রোমাঞ্চ মেশানো এক অদ্ভুত অনুভূতি আমাদের জোর করে আটকে রাখতো, নেশা-ধরানো এক আশ্চর্য গন্ধ পেতাম, নড়তে পারতাম না: আরও দূরে, বনের গভীরে যেতে কে যেন আমাদের হাতছানি দিতো, এক সময় কিছু পড়ার কোনো শব্দে, পাখির ডানাঝাপটায় আমাদের হুঁশ হতো। আমরা আবার চলতাম, কখনও আরও উজানে, কখনও ভাটিতে ঘরের পানে।

শোনাতো। শোভা বুড়ো এবার তার অজ্ঞাতবাস থেকে এলো। মাথা মুড়িয়ে বললো: মন্ত্রলিয়েছি রে গুরুর কাছে, মাছ মাংস মানা, শিকার ভি মানা। সত্যি সত্যি বুড়ো সাধু বনে গেলো। কয়েকটা চিয়াড়ি রেখে বাকি তির, সবগুলো ফাঁদ সে আমাদের বিলিয়ে দিলো। সকাল-সন্ধ্যা অনেকক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করলো।
বনে বনে 'অকারণ পুলকে' আমরা ঘুরে বেড়াতাম। সবকিছুই ভালো লাগতো বড় বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজস্র জাতের লতা, পাথর, পাথরের গায়ে রেশমি সবুজ শ্যাওলার আস্তর, ঢাউস পাতার বুনো রামকলার ঝোপ, হলুদ হয়ে ওঠা ঘাস। আমাদের পাহাড়ে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলগাছ দেখেছি অশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাঁপা, পারুল, জংলী জুঁই, নাগবল্লী, লুটকি, নীললতা, ল্যাডিস আম্ব্রেলা। নাম না-জানা ফুলও কিছু কম ছিলো না। একটা বাহারি লতা, আঁকশি দিয়ে বেয়ে উঠতো ঝোপের ওপর, লম্বাটে পাতা, গাঢ় খয়েরি, অদ্ভুত সুন্দর, যেনো বনদেবীর কণ্ঠহার। ছিলো কয়েক জাতের অর্কিডও- তাদের বেগুনি, শাদা, কমলা রঙের লম্বা লম্বা মঞ্জরি দোলাতো আশ্রয়দাতা উঁচু গাছের কাণ্ড কিংবা ডাল থেকে।
কিন্তু ফুল নয় পাখির জগৎই তখন আমাকে পাগল করে তুলেছিলো। ফুল ও পাখির উদয় পৃথিবীতে বলা চলে এক সঙ্গে, প্রায় ১০-১২ কোটি বছর আগে। সৌন্দর্যে, বৈচিত্র্যে উভয়ই সমতুল- তবু পাখি ছোটদের এতোটা মন ভোলায় কেন? পাঠশালায় পড়ার সময় স্কুলের দেয়ালে টানানো ময়নার একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে প্রায় সম্মোহিত হয়ে পড়তাম, কখনও মনে হতো পাখিটা বেঁচে উঠছে নড়ছে, এখুনি ঘর জুড়ে উড়ে বেড়াবে, আমার চোখের সামনে ঘর ভরা ছাত্রের দল কোথায় মিলিয়ে যেতো, শুনতে পেতাম এক আশ্চর্য সুরেলা কাকলি ভেসে আসছে কোন গভীর গহন থেকে। পাহাড়ে এসেও এই তদ্‌গত ভাবটা কাটে নি, বরং বেড়েই গিয়েছিলো।
বনের যে মোহন মায়া আমাকে কাছে টানতো, সেটা পাখি ছাড়া আর কিছু নয়। ডালে ডালে লাফাচ্ছে ময়নার ঝাঁক, কালো শরীর, সোনালি কান ও ঠোঁট, কিন্নরকণ্ঠ। নিঝুম দুপুরে হঠাৎ উলুর আওয়াজে ওপরে তাকিয়ে দেখি গাছের আড়ালে একটা বসন্তবৌরি, ঘনসবুজ পিঠ, মাথায় লাল টুকটুকে টোপর। আর বেনেবৌ, আমাদের হলদে পাখি, সে তো রূপকথার হীরামন। ছেলেবেলায় শোনা 'কাঁঠালগাছে দেখছি দুটি হলদে পাখির ছানা' -সে তো আজও উন্মনা করে, চোখ বুজলেই দেখি উড়ছে। উঁচু উঁচু গাছের পাতার গহনে আমার শিশুহৃদয় নিংড়ে, জানি কখনই ছুঁতে পারবো না বাস্তবে, ধরা দেবে শুধু স্বপ্নে। বাগানের টিলায় ছিলো বুনো জামের গাছ, তাতে ফুল ফুটলে ঝাঁক ঝাঁক পাখি পড়তো, গাছটাকে দেখাতো রথের মেলায় হকারের হাতে সোলার লাঠিতে গাঁথা রঙচঙে কাগুজে পাখির ঝলমলে ঝাড়ের মতোন। সে যে কতো রঙের- হলুদ, নীল, খয়েরি, কালো, সবুজ, লাল-রামধনুর কোনোটাই বাদ পড়তো না। টুকটুকে সিঁদুরে লাল আলতাপরী একবারই দেখেছিলাম পাহাড়ে, তারপর কতোদিন তাকে খুঁজেছি, বলতে পারি সেই ঘোর আজও কাটে নি, পেলে দু'চোখ ভরে দেখি।
পাহাড়ে আমাদের খেত-জমির কিনারে একটা প্রকাণ্ড মরা গাছ ছিলো। ডালপালা খসে গেছে অনেকদিন, ছালবাকলও, বাকি শুধু ধড়, সেও অনেক উঁচু লোকেদের নাগালের বাইরে। তারই এক খোঁড়লে বাসা বাঁধতো ময়না। ময়নার ছা পেড়ে দেওয়ার জন্য শোভা বুড়োর কাছে বায়না ধরতাম। বুড়ো মানুষ, অতোটা উঁচুতে ওঠার মই বানানো তার সাধ্য ছিলো না। তবু আশ্বাস দিতো। কিন্তু ফি বছরই কারা আগেভাগে বাচ্চাগুলো পেড়ে নিতো। একবার বড়দা গাছটা কেটে ফেলতে চাইলে শোভা বুড়ো অমত জানায়। গাছটায় নানা জাতের পাখপাখালির ঘরসংসার, তারা ফসলের পোকামাকড়, ইঁদুর, এমন কি সাপও খায়- তাতে মানুষের উপকার হয়। বুড়োর এই যুক্তি তিনি অগ্রাহ্য করেন নি।
পৌষের এক সকালে শোভা বুড়ো বললো: 'বাঘ ধরা পড়েছে। চ' এক নজর দেখে আসি। আমরা তো অবাক, জ্যান্ত বাঘ দেখা। চললাম তার সঙ্গে। অনেকটা দূর। যতো এগোই, ততোই লোক বাড়ে, শেষে জনস্রোত এসে মিললো এক মেলায়। হাজার হাজার মানুষ। এগিয়ে গিয়ে দেখি বেশ বড় একটা জায়গা মাথাসমান শক্ত দড়ির জাল দিয়ে ঘেরা। গায়ে গা লাগিয়ে শিকারীরা দাঁড়িয়ে, হাতের বর্শা জালের ফাঁকে মাটিতে গাঁথা। মাঠের মাঝখানে একটা ছোট ঘর, ঘাটা তোলা। ওই ফাঁদে ছাগল বেঁধে রেখে বাঘবাবাজীকে লোভ দেখিয়ে ধরা হয়েছে। এখন তিনি মাঠে একটা ঝোপের আড়ালে বসে আছেন। বিরক্ত ক্রুদ্ধ মুখ। তেমন বিশাল কিছু নয়। গরু মোষ মেরে ফেলে- বিশ্বাস হয় না। হঠাৎ সে ভয়ঙ্কর এক ডাক ছেড়ে গা ফুলিয়ে জালের ওপর লাফিয়ে পড়লো আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো বর্শার ধারালো ফলা তার পিঠে বিধলো। কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর বাঘ পিছু হটে ঝোপের আড়ালে পালালো। বড় ক্লান্ত, মুখ দিয়ে ফেনা ঝরছে। দৃশ্যটা আমার ভালো লাগলো না। বাঘের জন্য মায়া হলো। শোভা বুড়ার শার্ট টেনে ধরে বাড়ি ফেরার বাহানা ধরলাম। রোগা আর কল্পে নড়তে চায় না। শেষে বুড়ো তাদের শাসিয়ে পথে নামালো।
অনেক দূর আসার পর জিগ্যেস করলাম, 'ওরা বাঘটাকে মেরে ফেলবে?' বুড়ো একটু চুপ করে থেকে জবাব দিলো, 'না, মারবে না, দিন কয়েক খেলিয়ে ছেড়ে দেবে, ব্যাটা আর কুনোদিন ওদিক আসবে না।' পরে জেনেছি, সে সত্য কথা বলে নি। স্কুলে পড়ার সময় বাঘ শিকার দেখার জন্য আমরা ফি বছর ছুটি পেতাম। শিক্ষকসহ ছাত্ররা সবাই সেখানে যেতো। দিন কয়েক পর বাঘটাকে গুলি করে মেরে মাচায় তুলে গা-গঞ্জ ঘুরিয়ে যারা দেখে নি তাদের দেখিয়ে শেষে ছাল ছাড়ানো হতো। ছালের স্বত্ব নিয়ে অনেক সময় স্থানীয় জমিদারদের মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামাও বাধতো।
'বাঘ পোষ মানে?' বুড়োকে জিগ্যেস করি। কচে আগু বেড়ে জবাব দেয়, 'না, বহুৎ হারামি। মালিককেও খপ করে গিলে ফেলে।'
চৈত্রের এক বিকেলে আমি আর শোভা বুড়ো উঠোনে বসে গল্প করছিলাম। কল্পে আর রোগা নেই, গেছে চা-বাগানে বেড়াতে। চারদিক শুকনো ঠনঠনে। টিলার ঘাস মরে খড় হয়ে আছে। বহু গাছ পাতা ঝরিয়ে শরীর হালকা করেছে। বন ফাঁকা ফাঁকা। আকাশ মেঘহীন, তামাটে। উঠোনে শুকনো পাতা জমছে। মাঝে মাঝে উড়ে আসছে তুলো কিংবা আঁশের ঝুটি-বাঁধা নানা বীজ, প্যারাসুটের মতো ওঠে নামে, কখনও গায়ে এসে পড়ে। বুড়ো চিনতে পারে কোন্টা শিমুলের, আকন্দের, ছাতিমের কিংবা কোন্টা পারুলের।
একটা দমকা হাওয়ায় গোটা বন যেনো হঠাৎ তালি বাজিয়ে নেচে উঠলো, একটা। শনশন আওয়াজ ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়লো পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে। আমরা চুপ করে শুনি। কিছুতেই এই বনমর্মর থামে না. নানা লয়ে নানা তালে নতুন নতুন বোল তোলে। কখনো মিহি, কখনো উদাত্ত, এক আশ্চর্য ঐকতান সঙ্গীত। বুড়ো বলে, 'বন ভগবানের কাছে ভিখ মাংছে, বারিশ চাইছে।' ততোক্ষণে উঠোন ঝরাপাতায় ভরে গেছে। বুড়ো উঠে ঝাঁট দেয়, এক কোণে পাতার পাহাড় জমে।
শোভা বুড়ো বনের ভেতর আমাদের অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখাতো। তার সঙ্গে তখন চলতে হতো খালি পায়ে, সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, নিঃশব্দে। কোনো বড় গাছ দেখলে সে দাঁড়াতো, তারপর আমাদের সেগুলো জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে থাকতে বলতো, কোনো পোকা হাত বা গাল বেয়ে উঠলে সেটা তাড়াতে দিতো না, তার কথামতো আমরা নিজেদের গাছের অংশ ভাবতে থাকতাম, বাকলে গাল ঘষতাম, অদ্ভুত একটা গন্ধ মগজে ঢুকে আমাদের আবিষ্ট করতো, গাছের দোলন টের পেতাম, এমনকি ওর শরীরের ভেতরের শোঁ-শোঁ আওয়াজও।
বনে কোথায় ঝরাপাতার স্তূপ দেখলে বুড়ো আমাদের মাটিতে শুইয়ে পাতা দিয়ে গা ঢেকে দিতো। আমরা ওপরের দিকে চেয়ে থাকতাম, গাছের মাথার ফাঁকে ফাঁকে আকাশের নীল, ভাসন্ত শাদা মেঘ উকি দিতো। উঁচুতে, অনেক উঁচুতে উড়ন্ত চিল বা শকুন দেখলে আমাদের পাখি হওয়ার সাধ হতো- অনেক উঁচুতে গাছের ডালে ডালে পাতার সবুজে সবুজে উড়ে বেড়ানো, তারপর এক সময় বনের বাঁধন ছেড়ে বিস্তীর্ণ নীলাকাশে অবাধ বিচরণ। কিছুক্ষণ পর বুড়ো আমাদের মুখটাও পাতা দিয়ে ঢেকে দিতো। আমরা চোখ বুজতাম। সে আমাদের মাটিতে মিশে যেতে বলতো। আমরা তাই ভাবতাম এবং কোনো কোনো দিন ঘুমিয়েও পড়তাম।
একদিন আমি, কচে ও রোগা বনে ঘুরতে বেরিয়েছি, হঠাৎ কানে এলো অপূর্ব সুরেলা কাকলি, কোনো নিঃসঙ্গ পাখি আপন মনে উজাড় করে চলেছে কণ্ঠলহরী। রোগা বলে, 'শ্যামা।' কচে আপত্তি জানায়, ভিমরাজ। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এগিয়ে পাখিটি দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু যা-দেখি, সেটা কল্পনাতীত। পাখি নয়, আমাদের শোভা বুড়ো, দাঁড়িয়ে আছে গাছের মতো একঠায় নিথর, মাথায় শুকনো ডালপালা, শিস দিচ্ছে অবিরাম। ঈশ্বর জানে কেন। আমরা যে তাকে দেখছি, তাতে বুড়ো সম্পূর্ণ বেখেয়াল। হয়তো হুঁশই নেই।
এভাবে কিছুক্ষণ কাটে। তারপর দেখি একটা খয়েরি-হলুদ পাখি ওর আশপাশে উড়ছে। বুড়ো আরও জোরে শিস দিতে থাকে। শেষে পাখিটা প্রথমে ওর মাথায়, শেষে হাতে বসে। আমরা তো অবাক! শোভা বুড়ো কি শেষে সাধুসন্ত বনে গেলো। বুড়ো শিস দেওয়া থামায়। পাখিটা অবাক হয়ে তাকে দেখে, তারপর উড়ে গিয়ে একটু দূরে বসে, ইতিউতি তাকায়। বুড়ো আবার শিস দেয়, পাখিটা আবার তার মাথায় বসে। এই খেলা চলে অনেকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত বুড়ো থামে। পাখিটাও উড়ে যায়। সে উঠে পড়ে। আমাদের দেখে অবাক হয় এবং হাসে। তোমরা ভি পারবে, বুড়ো আমাদের আশ্বস্ত করে। লেকিন বহুৎ মেহনত আর মহব্বত লাগে। আমরা একসঙ্গে ঘরে ফিরি।
একবার আমাদের একটা দুধেল গাই বনে চরতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেলে বড়দা রেগে শঙ্খচূড়ের জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেন। শোভা বুড়োকে সাহায্যের জন্য ডেকেছিলেন, যান নি। কাজটা তার অপছন্দ। তখন চৈত্র মাস, ঠাঠা শুকনো বন, তাতে অঢেল ঝরাপাতা আর ঘাস। মুহূর্তে দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। ঠাস ঠাস শব্দে বাঁশ ফাটে। দু'তিন ঘণ্টার মধ্যেই গোটা এলাকাটা সাফ। খাড়া কিছু বড় বড় গাছ আর ছাইভস্ম ছাড়া ওখানে কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। ভয়ঙ্কর সাপের আস্তানা পুড়ে যাওয়ায় প্রথমে আমরা খুশি। ওতে কোনো দোষ দেখি নি। কিন্তু শোভা বুড়োর দুঃখী ভাব দেখে দমে যাই। তবে কি কাজটা ভালো হয় নি? হতে পারে সাপেরা ডিম পেড়েছিলো, কিংবা কচি কচি বাচ্চা আগলাচ্ছিলো। ওখানে পাখির বাসা, অন্য জীবজন্তুর ছানাপানো থাকার কথা। সবাই তবে পুড়ে মরেছে? আমাদেরও তখন মন খারাপ।
শোভা বুড়ো হপ্তাখানেক কোনো কথা বলে নি। শেষে যা বলেছিলো তখন ততোটা না বুঝলেও এখন বুঝি। তার কথা: বনজঙ্গল জন্তুজানায়োরের রাজ্য। ওতে মানুষের কোনো এখতিয়ার নেই, এখানে জঙ্গলের নিয়ম মেনে চলাই উচিত। সাপ তো ঘরে এসে গরুটাকে কামড়ায় নি, জঙ্গলে কেটেছে। ওটা তার দখলি এলাকা। দোষ আমাদের, সাপের নয়। মানুষ জঙ্গলের দেবতোক মান্য করে না, তার রাজ্য তারা দখল করে নিচ্ছে। ফল ভালো হবে না।
বছর শেষ হয়ে এলো। পাহাড় ছেড়ে বাড়ি এলাম, তারপর নিত্যদিন স্কুল। কল্পে ও রোগা চলে গেলো চা-বাগানে নতুন চাকরিতে শোভা বুড়ো রইলো বাগানে। আজো মনে পড়ে সেইদিনের কথা। স্কুল বন্ধ কিংবা স্কুলে যাই নি। শোভা বুড়ো এসে বসলো বারান্দায়। বাহানা ধরলো সে দেশে যাবে। দেশে, কোথায় দেশ? সবাইতো অবাক। কী একটা নাম বলে, কেউ কোনোদিন শোনে নি। মা তাকে বোঝান, বড়দা বোঝান। সে শোনে না, শুনতে চায় না। দেশে এতোদিনে কেউ বেঁচে নেই, আত্মীয় কেউ থাকলেও তারা তাকে চিনবে না-এসব কোনো যুক্তিই তার কানে যায় না। একটাই কথা- টিকিট কিনে দাও। বড়দা গেলেন স্টেশনে। স্টেশনমাস্টার বন্ধুলোক। ঢাউস এক পুথি খুঁজে বের করলেন ওই নামের এক রেলস্টেশন-মধ্যপ্রদেশের কোনো প্রত্যন্ত এলাকায়। শুনে বুড়ো দারুণ খুশি। দিন কয়েক পর এক বিকেলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ট্রেনে চাপলো। মা চোখ মুছলেন। কিন্তু শোভা বুড়োর মুখে উজ্জ্বল আনন্দ। সে জানলা গলিয়ে মাথা বাড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমরাও দাঁড়িয়ে। ট্রেন বাঁক ঘোরার আগে শোভা বুড়ো পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড বের করে নাড়তে লাগলো।
বড়দা আমাদের নাম-ঠিকানা লেখা কার্ডটা তাকে দিয়েছেন, যাতে পৌঁছনোর সংবাদ পাঠায়। ট্রেন চলে গেলেও আমরা অনেকক্ষণ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকলাম, কারও মুখে কথা নেই। কোথা থেকে সে এসেছিলো, আমরা কেউ জানি না। কোথায় সে চলেছে, তাও কোনোদিন জানা যাবে না। মানুষের জীবন, তার ভাগ্য-চির রহস্যঘেরা, দুর্জেয়। আশায় আশায় বহুদিন কাটলো। না, শোভা বুড়োর পৌঁছনোর সংবাদ এলো না। তারপর প্রায় বছর পঞ্চাশ কেটে গেছে। পাহাড়ের ওই এলাকাটা এখন আবাদ। চারদিকে লোকবসতি। সাপখোপ, জন্তুজানোয়ার, পাখপাখালি সবই লাপাত্তা। আমি গ্রামের স্কুল ছেড়ে শহরে পড়তে গেছি, তারপর চাকরি নিয়ে রাজধানী, সেখান থেকে আজ বিশ বছর বিদেশে। বয়স হয়েছে। তবু চরম মনখারাপের মুহূর্তে হঠাৎ দমকা হাওয়ায় শুকনো একটা পাতা ঘরে এসে পড়লে কিংবা কর্মস্থল থেকে ক্লান্ত পা টেনে টেনে বাড়ি ফেরার পথে কোনো কুকুরছানা ছুটে এসে লাফিয়ে কোলে উঠতে চাইলে অল্পক্ষণের জন্য হলেও খুশির জোয়ারে ভেসে যাই। তখনই ছেলেবেলায় গহন বনের ধারে টিলাবাড়িতে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। সামনে এসে দাঁড়ায় প্রকৃতির সন্তান শোভা বুড়ো, মাথায় মস্ত টাক, গায়ে ফতুয়া, পরনে হাফপ্যান্ট, যার কাছ থেকে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম, প্রকৃতিকে জানতে শিখেছিলাম, কেননা ভালো না বাসলে তো কাউকেই জানা যায় না।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ