• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • নবম-দশম শ্রেণি
  • নবজীবনের সূচনা
নবজীবনের সূচনা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

নবজীবনের সূচনা

জীবনের আবির্ভাব কোথায়, কবে এবং কীভাবে ঘটেছে

পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বর্তমানে প্রচলিত আছে। তবে জীবনের উৎপত্তি যে প্রথমে সমুদ্রের পানিতে বা কোনো জলাশয়ে হয়েছিল এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যে যুক্তি রেখেছেন, সেগুলো এরকম: প্রথমত, অধিকাংশ জীবকোষ এবং দেহস্থ রক্ত ও অন্যান্য তরলে নানারকম লবণের উপস্থিতি, যার সঙ্গে সমুদ্রের পানির খনিজ লবণের সাদৃশ্য রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্রের পানিতে এখনো অনেক সরল এবং এককোষী জীব বসবাস করে।

পৃথিবীতে কীভাবে জীব সৃষ্টি হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের গবেষণানির্ভর অনুমান এরকম: প্রায় ২৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড এবং জলীয় বাষ্প, নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ছিল; কিন্তু অক্সিজেন গ্যাস ছিল না। অহরহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটত এবং বজ্রপাতের ফলে ও অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে এই যৌগ পদার্থগুলো মিলিত হয়ে অ্যামাইনো এসিড এবং নিউক্লিক এসিড উৎপন্ন করে। ল্যাবরেটরিতে এই প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করে প্রমাণ করা হয়েছে। পরে অ্যামাইনো এসিড এবং নিউক্লিক এসিড মিলিত হওয়ায় নিউক্লিওপ্রোটিন অণুর সৃষ্টি হয়। নিউক্লিওপ্রোটিন অণুগুলো ক্রমে নিজেদের প্রতিরূপ-গঠনের (replication) ক্ষমতা অর্জন করে এবং জীবনের সূত্রপাত ঘটায়। পৃথিবীর উৎপত্তি ও জীবনের উৎপত্তির ঘটনাপ্রবাহকে বলে রাসায়নিক বিবর্তন বা অভিব্যক্তি।
ধারণা করা হয়, প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড সহযোগে সৃষ্টি হয় নিউক্লিওপ্রোটিন। এই নিউক্লিওপ্রোটিন থেকেই সৃষ্টি হয় প্রোটোভাইরাস এবং তা থেকে সৃষ্টি হয় ভাইরাস। ভাইরাস এমন একটা অবস্থা নির্দেশ করে যেটি হচ্ছে জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী অবস্থা।

নিউক্লিওপ্রোটিন - প্রোটোভাইরাস - ভাইরাস

এরপর সম্ভবত উদ্ভব হয় ব্যাকটেরিয়া এবং আরও পরে সৃষ্টি হয় প্রোটোজোয়া। ব্যাকটেরিয়ার নিউক্লিয়াস আদি প্রকৃতির, তাই এদেরকে আদি কোষ বলা হয়। পরে প্রোটোজোয়ানদের দেহে দেখা গেল সুগঠিত নিউক্লিয়াস। কিছু এককোষী জীবদেহে সৃষ্টি হলো ক্লোরোফিল ফলে একদিকে যেমন খাদ্য সংশ্লেষ সম্ভব হলো, তেমনি খাদ্য সংশ্লেষের উপজাত (by product) হিসেবে অক্সিজেন সৃষ্টি হতে শুরু করল। তখন সবাত শ্বসনকারী জীবদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। উদ্ভব হলো এককোষী থেকে বহুকোষী জীব। এরপর একদিকে উদ্ভিদ ও অপরদিকে প্রাণী-দুটি ধারায় জীবের অভিব্যক্তি বা বিবর্তন শুরু হলো।

জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে প্রমাণ

জৈব অভিব্যক্তির আলোচনায় মূলত দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। একটি হলো, জৈব অভিব্যক্তি যে হয়েছে তার প্রমাণ, অপরটি হলো, জৈব অভিব্যক্তির পদ্ধতি অর্থাৎ কীভাবে জীবজগতে জৈব অভিব্যক্তি এসেছে তার বর্ণনা। প্রাণের উদ্ভবের পর থেকে কোটি কোটি বছর ধরে জীবজগতের যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার সপক্ষে একাধিক প্রমাণ আছে। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো।

১. অঙ্গসংস্থান সম্পর্কিত প্রমাণ

বিভিন্ন জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বাহ্যিক গঠনকে অঙ্গসংস্থান বলে। এদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের আলোচনাকে তুলনামূলক অঙ্গসংস্থান বলে। সমসংস্থ অঙ্গ, সমবৃত্তীয় অঙ্গ এবং লুপ্তপ্রায় অঙ্গের তুলনামূলক অঙ্গসংস্থান এখানে আলোচিত হলো।

(ক) সমসংস্থ অঙ্গ: পাখির ডানা, বাদুড়ের ডানা, তিমির ফ্লিপার, সিলের অগ্রপদ, ঘোড়ার অগ্রপদ, মানুষের হাত-এর সবগুলোই সমসংস্থ অঙ্গ। আপাতদৃষ্টিতে এদের আকৃতিগত পার্থক্য দেখা গেলেও অভ্যন্তরীণ কাঠামো পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে এদের অস্থিবিন্যাসের মৌলিক প্রকৃতি একই ধরনের (চিত্র ৪.১৫)। অর্থাৎ সকল প্রাণীর জন্যই এখানকার অস্থিগুলো উপর থেকে নিচের দিকে পরপর সাজানো রয়েছে। বাইরে থেকে দেখতে যে বৈসাদৃশ্য রয়েছে, সেটি ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হওয়ার জন্য ঘটেছে। পাখি ও বাদুড়ের "অগ্রপদ” ওড়ার জন্য, তিমির ফ্লিপার সাঁতারের জন্য, ঘোড়ার অগ্রপদ দৌড়ানোর জন্য ও মানুষের অগ্রপদ কোনো জিনিস ধরা ও অন্যান্য সৃজনশীল কাজের জন্য পরিবর্তিত হয়েছে। সমসংস্থ অঙ্গগুলো থেকে বোঝা যায় যে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ তথা জীবগুলো উৎপত্তিগতভাবে এক, যদিও সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার ফলে বর্তমানে তাদের গঠন বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে সমসংস্থ অঙ্গবিশিষ্ট জীবগুলোর উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে ঘটেছে। এই তথ্য জৈব অভিব্যক্তি সমর্থন করে।

(খ) সমবৃত্তি অঙ্গ: বিভিন্ন প্রাণীর যে অঙ্গগুলোর উৎপত্তি, বিকাশ এবং গঠন ভিন্ন হলেও তারা একই কাজ করে, সেই অঙ্গগুলোকে সমবৃত্তি অঙ্গ বলে। যেমন-পতঙ্গ কিংবা বাদুড়ের ডানা উড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এদের উৎপত্তি ও গঠন সম্পূর্ণ আলাদা হলেও একই পরিবেশের প্রভাবে তারা একই রকম কাজ করার জন্য অভিযোজিত হয়েছে অর্থাৎ বাদুড় এবং পতঙ্গ দুটিই প্রয়োজনের তাগিদে উড়তে সাহায্য করার উপযোগী অঙ্গ তৈরি করেছে। এরকম সমবৃত্তি অঙ্গগুলো জৈব অভিব্যক্তি সমর্থন করে।

(গ) লুপ্তপ্রায় অঙ্গ: জীবদেহে এমন কতকগুলো অঙ্গ দেখা যায়, যেগুলো কিছু জীবদেহে সক্রিয় থাকে কিন্তু অপর জীবদেহে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, এমন অঙ্গগুলোকে লুপ্তপ্রায় অঙ্গ বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে। প্রাণীদেহের মধ্যে বহু লুপ্তপ্রায় অঙ্গ রয়েছে। মানুষের সিকাম এবং সিকাম-সংলগ্ন ক্ষুদ্র অ্যাপেন্ডিক্সটি নিষ্ক্রিয়, কিন্তু স্তন্যপায়ীভুক্ত তৃণভোজী প্রাণীদের (যেমন- ঘোড়া কিংবা গিনিপিগের) দেহে এগুলো সক্রিয়। মানুষের দেহে লেজ নেই, তবু মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে ককসিক্স নামক লুপ্তপ্রায় অঙ্গ রয়েছে। এই ককসিক্স মানুষের পূর্বপুরুষে সুগঠিত ছিল। গরু, ঘোড়া, ছাগল, মানুষ এদের সবার কানের গঠনের বৈশিষ্ট্য একই ধরনের। এ ধরনের আলোচনা থেকে বলা যায় যে লুপ্তপ্রায় অঙ্গ বহনকারী প্রাণীটির উৎপত্তি ঘটেছে এমন উদবংশীয় প্রাণী থেকে, যার দেহে একসময় উক্ত অঙ্গটি সক্রিয় ছিল (চিত্র ৪.১৬)।

২. তুলনামূলক শারীরস্থানিক প্রমাণ

বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গের অন্তর্গঠনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য-সংক্রান্ত আলোচনাকে তুলনামূলক শারীরস্থান বলে। বিভিন্ন শ্রেণির মেরুদণ্ডী প্রাণীর কোনো কোনো অঙ্গের গঠনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে যে এদের গঠনে মৌলিক মিল রয়েছে। এই তথ্য জৈব অভিব্যক্তিকে সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ মেরুদণ্ডী প্রাণীদের হৃৎপিণ্ডের গঠনের উল্লেখ করা যায়। মাছের হৃৎপিণ্ড দুটি প্রকোষ্ঠযুক্ত; উভচরের (ব্যাঙের) হৃৎপিণ্ড তিনটি প্রকোষ্ঠযুক্ত। আবার সরীসৃপের হৃৎপিণ্ড দুটি অলিন্দ এবং অসম্পূর্ণভাবে বিভক্ত দুটি নিলয় থাকে। পাখি এবং স্তন্যপায়ীর হৃৎপিণ্ড চারটি প্রকোষ্ঠযুক্ত অর্থাৎ সেখানে রয়েছে দুটি অলিন্দ এবং দুটি নিলয়। উপরিউক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলোর হৃৎপিণ্ডের মৌলিক গঠন এক, যদিও ধীরে ধীরে সেটি জটিল হয়েছে। অর্থাৎ একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে জৈব অভিব্যক্তির ধারায় ক্রমশ বিভিন্ন জটিল জীবগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে।

৩. সংযোগকারী জীবন সম্পর্কিত প্রমাণ

জীবজগতে এমন জীবের অস্তিত্ব দেখা যায়, যাদের মধ্যে দুটি জীবগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। এ ধরনের জীবকে সংযোগকারী জীব বা কানেকটিং লিংক (Connecting link) বলে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য প্লাটিপাসের (চিত্র ৪.১৭) নাম উল্লেখ করা যায়। প্লাটিপাসের মধ্যে সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী দুই ধরনের প্রাণীরই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্লাটিপাস সরীসৃপের মতো ডিম পাড়ে। অপরদিকে স্তন্যপায়ীর মতো এদের শরীর লোমে ঢাকা, বুকে রয়েছে দুগ্ধগ্রন্থি। শুধু তা-ই নয়, এদের ডিম ফুটে শাবক জন্মালে এরা শাবককে স্তন্য পান করায়। সংযোগকারী প্রাণীদের অধিকাংশই পৃথিবীর পরিবর্তনের সাথে কার্যকরীভাবে অভিযোজিত হতে সক্ষম না হওয়ায় ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জীবাশ্মের পরীক্ষা থেকে অন্তর্বর্তী উদ্ভিদের অস্তিত্ব বিরল ঘটনা হলেও এমন কিছু কিছু উদ্ভিদের কথা জানা যায়, যাদের মধ্যে পাশাপাশি দুটি গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বর্তমান। Gnetum (নিটাম) নামক গুপ্তবীজী উদ্ভিদে ব্যক্তবীজী এবং গুপ্তবীজী দুই ধরনের উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যই দেখা যায়। জৈব অভিব্যক্তি তত্ত্ব অনুসারে এক গোষ্ঠীর জীব থেকে অপর গোষ্ঠীর জীবের আবির্ভাব ঘটে থাকলে দুই গোষ্ঠীর মাঝামাঝি অন্তর্বর্তী জীবের অস্তিত্ব থাকা উচিত। অর্থাৎ সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা জন্ম হলে মাঝামাঝি এমন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা উচিত যেটি সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাঝামাঝি। কাজেই প্রকৃতিতে এই সকল সংযোগকারী জীবের উপস্থিতি জৈব-অভিব্যক্তিকে সমর্থন করে।

৪. ভ্রূণতত্ত্বঘটিত প্রমাণ

ডিমের ভিতরে অথবা গর্ভের মধ্যে (স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে) অবস্থিত শিশু প্রাণীকে এবং উদ্ভিদের বীজের মধ্যে অবস্থিত শিশু উদ্ভিদকে ভ্রূণ বলে। বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের ভ্রূণের সৃষ্টি এবং তাদের ক্রমবৃদ্ধি পরীক্ষা করা হলে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেটি জৈব অভিব্যক্তি তত্ত্বকে সমর্থন করে। মৎস্য, উভচর, সরীসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ীর অন্তর্গত মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলোর ভ্রূণ পর্যবেক্ষণ করলে তাদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়। ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় কোনটি কোন প্রাণীর তা দেখে শনাক্ত করা অসম্ভব। প্রতিটি মেরুদণ্ডী প্রাণীর ভ্রূণে ফুলকা, ফুলকা ছিদ্র এবং লেজ থাকে। ভ্রূণের এরকম সাদৃশ্য লক্ষ করে বিজ্ঞানী হেকেল (Haeckel) এই সিদ্ধান্তে আসেন, যে প্রতিটি জীব তার ভ্রূণের বিকাশের সময় অতি অল্প সময়ের জন্য হলেও উদ্‌দ্বংশীয় জীব বা তার পূর্বপুরুষের অভিব্যক্তিক রূপের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। প্রকৃতির এই নিয়মকেই হেকেল পরে বলেছিলেন, 'অনটোজেনি রিপিটস্ ফাইলোজেনি' (Ontogeny repeats phylogeny), অর্থাৎ কোনো জীবের ভ্রূণের ক্রমপরিণতি পর্যবেক্ষণ করলে তার পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানা যাবে, যা জৈব অভিব্যক্তির স্বপক্ষে একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

৫. জীবাশ্মঘটিত প্রমাণ

বিজ্ঞানের যে শাখা বর্তমান পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জীব সম্পর্কে অনুসন্ধানে নিয়োজিত, তাকে প্রত্নজীববিদ্যা বলে। বিজ্ঞানের এই শাখা থেকে নানা প্রকারের জীবাশ্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন অবলুপ্ত জীব সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। জৈব অভিব্যক্তি সম্পর্কে যেসব প্রমাণ আছে, তাদের মধ্যে জীবাশ্মঘটিত প্রমাণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভূগর্ভের শিলাস্তরে দীর্ঘকাল চাপা পড়ে থাকা জীবের সামগ্রিক বা আংশিক প্রস্তরীভূত দেহ বা দেহছাপকে জীবাশ্ম বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত শিলার মধ্যে এগুলো সঞ্চিত রয়েছে। জীবাশ্মের সাহায্যে অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যায় যে জৈব অভিব্যক্তির মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এক রকম জীব থেকে অন্য রকম জীবের উৎপত্তি ঘটেছে। জীবাশ্ম আবিষ্কারের আগে ধারাবাহিক জৈব অভিব্যক্তির মধ্যে উপযুক্ত প্রমাণের অভাব থাকায় জৈব অভিব্যক্তির ইতিহাসে বেশ কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছিল। অনুমান করা হয় যে ঐ ফাঁকগুলোতে এমন কোনো ধরনের জীব ছিল, যাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই রকম খোঁজ না পাওয়া জীবদের মিসিং লিংক (missing link) বা হৃত-যোজক বলা হয়। জীবাশ্ম আবিষ্কারের মাধ্যমে ঐ সমস্ত মিসিং লিংকের সন্ধান পাওয়ায় আজকাল জৈব অভিব্যক্তির ধারাবাহিক ইতিহাসের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে জীবাশ্মকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের বা বিগত যুগের জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয়। শিলাস্তর থেকে জীবাশ্ম দেখে জীবটির জীবিতকালের তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া ঐ জীবাশ্মের বৈশিষ্ট্য দেখে বর্তমান এবং অতীতের যোগসূত্র খুঁজে বের করা সম্ভব হয়।

উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায় যে, লুপ্ত আর্কিওপটেরিক্স (Archaeopteryx) নামে একরকম প্রাণীর জীবাশ্ম (চিত্র ৪.১৮) পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এদের সরীসৃপের মতো পা ও দাঁত, পাখির মতো পালকবিশিষ্ট দুটি ডানা, একটি দীর্ঘ লেজ, লেজের শেষ প্রান্তে একগুচ্ছ পালক এবং চক্ষু ছিল। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে সরীসৃপজাতীয় প্রাণী থেকেই অভিব্যক্তির মাধ্যমে পাখিজাতীয় প্রাণীর উৎপত্তি ঘটেছে।

উদ্ভিদের ক্ষেত্রে বিলুপ্ত টেরিডোস্পর্ম (Pteridosperm) নামে এক ধরনের উদ্ভিদের জীবাশ্মে ফার্ন ও ব্যক্তবীজী (gymnosperm) উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়-এ কারণে ফার্নজাতীয় উদ্ভিদ থেকে জিমনোস্পার্ম অর্থাৎ ব্যক্তবীজী উদ্ভিদের আবির্ভাব ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

৬. জীবন্ত জীবাশ্ম

কতগুলো জীব সুদূর অতীতে উৎপত্তি লাভ করেও কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই এখনো পৃথিবীতে বেঁচে আছে, অথচ তাদের সমগোত্রীয় এবং সমসাময়িক অনেক জীবনের বিলুপ্তি ঘটেছে। এই জীবদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলে। লিমুলাস বা রাজকাঁকড়া (চিত্র ৪.১৯) নামক সন্ধিপদ প্রাণী, স্ফোনোডন নামক সরীসৃপ প্রাণী, প্লাটিপাস নামক স্তন্যপায়ী প্রাণী এর উদাহরণ। অন্যদিকে ইকুইজিটাম, নিটাম ও গিঙ্কো বাইলোবা নামের উদ্ভিদগুলো উদ্ভিদের জীবন্ত জীবাশ্মের উদাহরণ। প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগের লিমিউলাস জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে। এর সমসাময়িক অন্যান্য আর্থ্রোপোডাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এরা আজও বেঁচে আছে। তাই এদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলা হয়।

৭. আণবিক জীববিজ্ঞান

বর্তমানে বহু জীবের জিন সংকেত বা জীবন রহস্য উদ্‌ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। তাই এক জীবের ডিএনএ বা আরএনএ-এর নিউক্লিওটাইড বা প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড ক্রমের সঙ্গে আরেকটি জীবের অনুরূপ ক্রম মিলিয়ে দেখার কাজটি সহজ হয়ে গেছে। ইন্টারনেট সংযুক্ত কম্পিউটার থাকলে উপযুক্ত সফটওয়‍্যার ব্যবহার করে এটি করা যায়। এই পদ্ধতিতে নির্ণয় করা যায় যে জিনগতভাবে কোন জীবের সম্পর্ক অপর কোন জীবের সাথে কতটা কাছের বা দূরের। এর মাধ্যমে মিলিয়ে দেখা হয়েছে যে জীবাশ্মসহ অন্যান্য যত পদ্ধতি রয়েছে তার থেকে জৈব অভিব্যক্তির যে চিত্র পাওয়া যায় তা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। দেখা গেছে, এটা এতোটাই নিশ্চিতভাবে জৈব অভিব্যক্তির সত্যতা প্রমাণ করে যে বলা হয়ে থাকে, যদি একটিও ফসিল না পাওয়া যেত তবু স্রেফ জেনেটিক সংকেত ব্যবহার করে জৈব অভিব্যক্তির ইতিহাস নির্ণয় করতে কোনো অসুবিধা হতো না।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ