- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- নবম-দশম শ্রেণি
- নবজীবনের সূচনা
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
নবজীবনের সূচনা
ডারউইনবাদ বা ডারউইনের তত্ত্ব
ল্যামার্ক জৈব অভিব্যক্তির যে মতবাদ দেন, তার ৫০ বছর পর ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (চিত্র ৪.২১) একটি বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সৃষ্টি করেন। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (Charles Darwin, ১৮০৯-১৮৮২) ইংল্যান্ডের সাসবেরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জ পরিভ্রমণকালে তিনি ঐ অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য দেখে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন এবং সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের প্রায় ২০ বছর পরে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে 'প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা প্রজাতির উদ্ভব' (Origin of species by means of natural selection) নামে একটি বইয়ে তাঁর মতবাদটি প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য যে, আরেক প্রকৃতিবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩) প্রায় একই সময়ে স্বাধীনভাবে গবেষণা করে ডারউনের মতো একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
ডারউইনের দৃষ্টিতে প্রকৃতিতে সংঘটিত সাধারণ সত্যগুলো এরকম:
১. অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি
ডারউইনের মতে, অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি করাই জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এর ফলে জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি সরিষা গাছ থেকে বছরে প্রায় ৭৩০,০০০টি বীজ জন্মায়। এই ৭৩০,০০০ বীজ থেকে ৭৩০,০০০ সরিষা গাছের জন্ম হওয়া সম্ভব। আবার একটি স্ত্রী স্যামন মাছ প্রজনন ঋতুতে প্রায় ৩ কোটি ডিম পাড়ে। ডারউইনের মতে, এক জোড়া হাতি থেকে উদ্ভূত সবগুলো হাতি বেঁচে থাকলে ৭৫০ বছরে হাতির সংখ্যা হবে এক কোটি নব্বই লাখ।
২. সীমিত খাদ্য ও বাসস্থান
ভূপৃষ্ঠের আয়তন সীমাবদ্ধ হওয়ায় জীবের বাসস্থান এবং খাদ্য সীমিত।
৩. অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম
জীবেরা জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় এবং খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ডারউইন এ ধরনের সংগ্রামকে 'অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম' বলে অভিহিত করেন। ডারউইন লক্ষ করেন যে জীবকে তিনটি পর্যায়ে এই সংগ্রাম করতে হয়। সেগুলো হচ্ছে
(ক) আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম: উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যাঙ কীটপতঙ্গ খায়, অন্যদিকে সাপ ব্যাঙদের খায়। আবার ময়ূর সাপ এবং ব্যাঙ দুটোকেই খায়-এভাবে নিতান্ত জৈবিক কারণেই বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের একটি নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
(খ) অন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম: একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের খাদ্য ও বাসস্থান একই রকমের হওয়ায়, এদের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এরা নিজেদের মধ্যেই বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা শুরু করে; উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে একটি দ্বীপে তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে গেলে খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সংগ্রাম শুরু করে। সবল প্রাণীগুলো দুর্বল প্রাণীদের প্রতিহত করে গ্রাসাচ্ছাদন করে। ফলে দুর্বল প্রাণীগুলো কিছুদিনের মধ্যেই অনাহারে মারা পড়ে।
(গ) পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম: বন্যা, খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বালিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত-এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ জীবের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। সুতরাং জীবকে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য প্রতিনিয়ত এসব প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। যে প্রাণীগুলো এই পরিবেশে টিকে থাকতে পারে তারা বেঁচে থাকে অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে উত্তর ও মধ্য আমেরিকার কোয়েল পাখি প্রচণ্ড ঠান্ডা ও তুষারপাতের ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
৪. প্রকরণ বা জীবদেহে পরিবর্তন
চার্লস ডারউইনের মতে, পৃথিবীতে দুটি জীব কখনোই অবিকল একই ধরনের হয় না। যত কমই হোক এদের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য থাকে। জীব দুটির মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায়, তাকে প্রকরণ বা পরিবৃত্তি বলে। অস্তিত্বের জন্য জীবনসংগ্রামে অনুকূল প্রকরণ একটি জীবকে সাহায্য করে।
৫. যোগ্যতমের জয়
ডারউইনের মতে, যেসব প্রকরণ জীবের জীবনসংগ্রামের পক্ষে সহায়ক এবং পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনমূলক, তারাই কেবল বেঁচে থাকে; অন্যরা কালক্রমে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। মেরু অঞ্চলের ভল্লুক বা বাঘ বা উদ্ভিদ গ্রীষ্মপ্রধান পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে না।
৬. প্রাকৃতিক নির্বাচন
ডারউইন তত্ত্বের এই প্রতিপাদ্যটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 'অনুকূল (বা অভিযোজনমূলক) প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে-এই প্রক্রিয়াকে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।' অনুকূল প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকে এবং অত্যধিক হারে বংশবিস্তার করে। অপরদিকে, প্রতিকূল প্রকরণসম্পন্ন জীবেরা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে তারা অবলুপ্ত হয় (চিত্র ৪.২২)। ডারউইনের তত্ত্ব অনুসারে পরিবেশে যে জীবটি খাপ খাইয়ে নিবে, সে হবে যোগ্য এবং যোগ্য জীবটি পরিবেশে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য বংশবৃদ্ধি করবে এবং টিকে থাকবে।
৭. নতুন প্রজাতির উৎপত্তি
যেসব প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে সুবিধাজনক প্রকরণ দেখা যায়, প্রকৃতি তাদের নির্বাচন করে এবং তাদের লালন করে। সুবিধাজনক প্রকরণযুক্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদ পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং অযোগ্যদের তুলনায় বেশি হারে বংশবিস্তার করতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে এদের বংশধরদের মধ্যে প্রকরণগুলো সঞ্চারিত হয়। এই বংশধরদের মধ্যে আবার যাদের সুবিধাজনক প্রকরণ বেশি থাকে, প্রকৃতি আবার তাদের নির্বাচন করে। এভাবে যুগ-যুগান্তর ধরে নির্বাচিত করে করে প্রকৃতি প্রাণী ও উদ্ভিদের নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে। বর্তমানে বংশগতিবিদ, কোষতত্ত্ববিদ ও শ্রেণিবিদগণ নতুন প্রজাতির উৎপত্তির বিষয়ে মেন্ডেলের বংশগতি তত্ত্ব এবং ডারউইনের তত্ত্বের ভিত্তিতে বলেন, তিনটি ভিন্ন উপায়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হতে পারে:
(ক) মূল প্রজাতির পপুলেশন থেকে পৃথক হয়ে (isolation) যাওয়ার ফলে
(খ) সংকরায়ণের (hybridization) ফলে এবং
(গ) সংকরায়ণ প্রজাতিতে কোষ বিভাজনের সময় ঘটনাক্রমে কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যার বৃদ্ধির (Polyploidy) ফলে। এর ফলে নতুন জীবটির অভিযোজন ঘটবে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা একটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হবে।
উল্লেখ্য যে, কোনো প্রজাতি থেকে নতুন কোনো প্রজাতির উদ্ভব ঘটলে আদি প্রজাতিটি বিলুপ্ত হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে।
জীববিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে জৈব অভিব্যক্তি তত্ত্বের মূলনীতিগুলো ব্যবহৃত হয় না। এখন পর্যন্ত ডারউইনীয় অভিব্যক্তিই জীববিজ্ঞানের একমাত্র তত্ত্ব যেটি শুধু পৃথিবীতে উদ্ভূত প্রাণের জন্য নয়, বরং মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে প্রাণের উদ্ভব ঘটলে সেখানেও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। জৈব অভিব্যক্তি যে শুধু প্রকৃতির কোলে ঘটে, তা নয়। গবেষণাগারে পরীক্ষামূলকভাবে জৈব অভিব্যক্তি ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এটিও জৈব অভিব্যক্তির বাস্তবতার প্রমাণ। জৈব অভিব্যক্তির বিপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখননোও খুঁজে পাওয়া যায়নি। জীবজগৎ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান যতই সমৃদ্ধ হচ্ছে, জৈব অভিব্যক্তিকে অস্বীকার করা ততই অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ