- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- অষ্টম শ্রেণি
- কৃষি উপকরণ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
কৃষি উপকরণ
জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচের ব্যবহার
ফসল উৎপাদনে পানির চাহিদা পূরণে কৃত্রিম উপায়ে পানি প্রয়োগকে পানি সেচ বলে। সেচের পানির মূল উৎস বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিপাতের পানি নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, হ্রদ, পুকুর ইত্যাদিতে জমা হয় বা চলাচল করে। এ সব পানির অংশবিশেষ ভূগর্ভে জমা হয়। সেচের জন্য অবস্থান অনুসারে পানির উৎস দুই প্রকার; ক) ভূউপরিস্থ পানি; যেমন-নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদির পানি ও খ) ভূগর্ভস্থ পানি। বিভিন্ন ধরনের সেচ প্রযুক্তি যেমন-গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, শক্তিচালিত পাম্প, ভাসমান পাম্প ইত্যাদি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচ দেওয়া হয়। পানি উত্তোলনের পর কাঁচা বা পাকা সেচ নালার মাধ্যমে জমিতে দেওয়া হয়। দেশের মোট কৃষি জমির ৫২ শতাংশ সেচের আওতাভুক্ত। ১৪.৩৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে ভূউপরিস্থ সেচ এবং ৩৩.৭৩ লক্ষ হেক্টর জমি ভূগর্ভস্থ সেচের আওতাভুক্ত। আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউট (IWMI-International Water Management Institute)-এর এক জরিপে দেখা যায় আমাদের দেশে সেচ দক্ষতা ৩০-৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ সেচের জন্য দেওয়া পানির ৬৫-৭০ ভাগই অপচয় হয়। সেচপাম্প ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ, সেচনালা নির্মাণ ও মেরামত এবং সেচপাম্প পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎ, ডিজেল, পেট্রোলের জন্য প্রতি বছর অনেক টাকা খরচ হয়। বোরো ধানের মোট উৎপাদন খরচের ২৮-৩০ শতাংশ সেচের জন্য খরচ হয়। আবার অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ সেচ পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে যা পরিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং মূল্যবান সেচের পানির অপচয় হ্রাস করে জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
ফসলের চাহিদা অনুসারে জমি থেকে পানি প্রাপ্তি ভালো ফলনের পূর্বশর্ত। জমিতে পানির ঘাটতি দেখা দিলে সেচের মাধ্যমে ফসলের চাহিদা অনুসারে পানি সরবরাহ করতে হয়। প্রয়োজনের বেশি বা কম পানি উভয়ই ফসলের ফলন বৃদ্ধির অন্তরায়। বেশি পানি দিলে অনেক ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ফসল সেচ প্রয়োগের আগে সেচের সঠিক সময় ও প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বিভিন্ন ফসলের পানির চাহিদা বিভিন্ন। ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়েও পানির চাহিদার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শস্যে কখন সেচ দিতে হবে তা নানাভাবে নির্ধারণ করা যায়। সব পদ্ধতিই আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। জমিতে সাশ্রয়ীরূপে সেচের ব্যবহারের জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে-
ক) সেচ নালার ধরন সেচ নালার বা ক্যানালের মাধ্যমে জমিতে সেচের পানি সরবরাহ করা হয়। মাটির সেচ নালায় পানি পরিবহনে বেশি অপচয় হয়। আবার যদি মাটির সেচ নালা সঠিকভাবে তৈরি করা না হয় তাহলে অপচয় আরও বেশি হয়। জমি থেকে উঁচু করে সেচ নালা তৈরি, নালার দুই পাশ ও তলা পিটিয়ে মজবুত করলে সরবরাহের সময় সেচের পানির অপচয় হ্রাস পায়।
খ) সেচ পদ্ধতি: ফসলের প্রকার, ভূমির বন্ধুরতা, মাটির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের সেচ পদ্ধতি রয়েছে। নিচে পানি সাশ্রয়ী কয়েকটি সেচ পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. চেক বেসিন পদ্ধতি: প্লাবন সেচপদ্ধতিতে জমিতে পানি নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে পানির অপচয় বেশি হয়। এ অসুবিধা দূর করার জন্য চেক বেসিনপদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। চেক বেসিন বা আইল সেচপদ্ধতিতে সমস্ত জমিকে ঢাল অনুসারে কয়েকটি খণ্ডে উঁচু আইল দ্বারা বিভক্ত করে পানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেচ দেওয়া যায়।
২. রিং বেসিনপদ্ধতি: ফল বাগানে রিং বেসিন বা বৃত্তাকার পদ্ধতিতে সেচ দিলে পানির অপচয় কম হয়। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেকটি ফল গাছের গোড়ায় বৃত্তাকার নালা তৈরি করে প্রধান সেচ নালার সাথে সংযোগ দেওয়া হয়।
৩. নালা পদ্ধতি: নালা সেচ পদ্ধতিতে জমির আয়তন অনুসারে পর্যাপ্ত সংখ্যক নালা তৈরি করে প্রধান সেচ নালার সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। সারি ফসলে এ পদ্ধতি বেশি উপযোগী। এ পদ্ধতিতে পানিনিয়ন্ত্রণ সহজ বলে অপচয় কম হয়।
৪. বর্ষণ সেচপদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে নজলের মাধ্যমে পানি গাছের উপর বৃষ্টির মতো ছিটিয়ে দেওয়া হয়। পানি সাশ্রয়ী এ পদ্ধতিতে প্রাথমিক খরচ বেশি। চা বাগানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
৫. ড্রিপ সেচপদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পানি পাইপের মাধ্যমে গাছের মূলাঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া হয়। এটা সবচেয়ে পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি। যেখানে সেচের পানির খুব অভাব সেখানে এ পদ্ধতি বেশি কার্যকর।
গ) সেচের পানির পরিমাণ: গাছ মূলাঞ্চল হতে পানি গ্রহণ করে। গাছের বৃদ্ধির সাথে মূল বৃদ্ধি পায় ও মাটির গভীরে প্রবেশ করে। তাই সেচের মাধ্যমে গাছের মুলাঞ্চল ভিজাতে হয়। বেশির ভাগ ফসলের ৮০-৯০ শতাংশ মূল উপরের প্রথম এক থেকে দেড় ফুট মাটির গভীরে থাকে। গাছের মোট পানির ৭০ শতাংশ মূলাঞ্চলের প্রথমার্ধ থেকে গ্রহণ করে। তাই মাটির প্রথম এক থেকে দেড় ফুট গভীরতা পর্যন্ত ভিজিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।
ঘ) সেচ দেওয়ার সময় সেচের পানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের জন্য সঠিক সময়ে সেচ দিতে হবে। সঠিক সময়ে সেচ দেওয়ার জন্য দুটি বিষয় বিবেচনা করতে হয়-
১. মাটিতে রসের অবস্থা মাটিতে রসের অবস্থা বুঝে জমিতে সেচ দিতে হবে। জমিতে রসের পরিমাণ জানার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। সহজ একটি পদ্ধতি হলো হাতের সাহায্যে অনুভব করে মাটির রসের অবস্থা বুঝে সেচ দেওয়া। যে জমিতে সেচ দিতে হবে ঐ জমির একটি স্থানে গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের গভীরতা ফসলের শিকড়ের গভীরতার তিন ভাগের দুই ভাগের সমপরিমাণ হবে। এবার গর্তের তলা থেকে মাটি তুলে হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিয়ে গোলাকার বল তৈরি করতে হবে। যদি মাটি শুকনা ও ধুলা হয়, বল তৈরির সময় আঙুলের ফাঁক দিয়ে গুঁড়ো হয়ে বের হয়ে যায় বা বল তৈরি হলেও তা ফেলে দিলে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়, তাহলে জমিতে অতি সত্বর সেচ দিতে হবে। মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিলে দলা হবে কিন্তু ফেলে দিলে দলা ভাঙবে না, এমন অবস্থায় ১-২ দিন পর জমিতে সেচ দিতে হবে। মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিলে ভিজা দলা তৈরি হবে, হাতের তালু ভিজে যাবে এবং দলা ফেলে দিলে ভাঙবে না, এ অবস্থায় ৩-৪ দিন পর পুনরায় মাটির রস পরীক্ষা করতে হবে। আর যদি মাটি কাদাময় হয়, হাতে চাপ দিলে কাদা মাটি আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে, তালু ভিজে যায় কিন্তু পানি বেরিয়ে আসে না, এমতাবস্থায় সেচ দিতে হবে না। ৭ দিন পর জমি আবার পরীক্ষা করতে হবে।
২. ফসলের বৃদ্ধি পর্যায়: ফসলের শারীরতাত্ত্বিক বৃদ্ধির সকল পর্যায়ে সমানভাবে পানির প্রয়োজন হয় না। যে সকল পর্যায়ে মাটিতে পানি স্বল্পতায় ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তাকে সেচের প্রতি সংবেদনশীল পর্যায় বলে। আর যেসব পর্যায়ে পানির অভাবে ফসলের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় তাকে সংকটময় পর্যায় বলে।
নিচের ছকে প্রধান প্রধান ফসলের সেচের প্রতি সংবেদনশীল ও সংকটময় পর্যায়সমূহ দেখানো হলো-
ফসলের নাম | সেচের প্রতি সংবেদনশীল পর্যায় | সেচের প্রতি সংকটময় পর্যায় |
|---|---|---|
ধান | প্রাথমিক কুশি গজানো, শীষ গজানো, পুষ্পায়ন, দুধ পর্যায় | প্রাথমিক কুশি গজানো, পুষ্পায়ন |
গম | মুকুট মূল গজানো, কুশি গজানোর শেষ দিকে, পুষ্পায়ন | পুষ্পায়ন, মুকুট মূল গজানো |
সরিষা | দৈহিক বৃদ্ধি ও পুষ্পায়ন | পুষ্পায়ন |
ছোলা | পুষ্পায়ন-পূর্ব ও বীজ গঠন | পুষ্পায়ন-পূর্ব |
আলু | চারা গজানো, স্টোলন তৈরি, প্রাথমিক কন্দ গঠন, কন্দের ওজন অর্জন পর্যায় | চারা গজানো, প্রাথমিক কন্দ |
ফসলের সেচের প্রতি সংবেদনশীল ও সংকটময় পর্যায়ে জমিতে রসের ঘাটতি হলে সেচ দিতে হবে। এভাবে সেচ দিলে অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হবে না।
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। দেশের মোট জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হয়। বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হয়। আর এ মৌসুম বৃষ্টিহীন থাকায় সবচেয়ে বেশি পানি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রচলিত সেচ পদ্ধতিতে ধানের জমিতে ১০-১৫ সে.মি. দাঁড়ানো পানি রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ৩০০০-৫০০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয় যা প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে ধান চাষে পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হিসেবে পর্যায়ক্রমিক ভেজানো ও শুকানো (Alternate Wetting and Drying) পদ্ধতি জনপ্রিয় করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে সব সময় জমিতে দাঁড়ানো পানির প্রয়োজন নেই। জমিতে একটি পর্যবেক্ষণ নল স্থাপন করে সেচের সময় নির্ধারণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে পানি, জ্বালানি, ও শ্রমিক খরচ সাশ্রয় হয়। ৩০-৩৭ ভাগ সেচের পানি কম লাগে, ২৯ ভাগ ডিজেল কম লাগে এবং ধানের ফলন ১২ ভাগ বেশি হয়। সর্বোপরি এটি একটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

