- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- বলশেভিক বিপ্লব
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
বলশেভিক বিপ্লব
প্রাক-বিপ্লব রাশিয়া
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর পুরাতন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫শে অক্টোবর রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির বলশেভিক অংশের নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা। ক্ষয়িষ্ণু জারতন্ত্রের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অব্যবস্থা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান রাশিয়ার জাতীয় জীবনে যে গভীর সংকটের সৃষ্টি করে তার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে এই বিপ্লব, যা সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এককথায় রাশিয়ার সামগ্রিক জীবনে গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করে। এই বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত হয়েছিল বলে একে যেমন রুশ বিপ্লবী বলা হয়, তেমনি লক্ষ্য ও আদর্শে সমাজতান্ত্রিক ছিল বলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অক্টোবর মাসে সংঘটিত হয়েছিল বলে অক্টোবর বিপ্লব এবং বেলশেভিক অংশের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল বলে একে বলশেভিক বিপ্লর নামেও অভিহিত করা হয়।
রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণি, কৃষকসমাজ এবং সাধারণ মানুষ বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি তথা বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে, যার মূল নায়ক ছিলেন ভ. ই. লেনিন বা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। উনিশ শতকে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রথম দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োগ ঘটে রাশিয়ায়। বলশেভিক পার্টির প্রধান নেতা লেনিন মার্ক্সীয় তত্ত্বের অধিকতর বিকাশ ঘটিয়েই বিপ্লবের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন, একইভাবে বিপ্লবের রণকৌশলও নির্ধারণ করেন। রুশ বিপ্লব শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হলেও রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা বিপ্লব বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ ধারণ করে। এই বিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়, যা সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী, শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষকে পুরো বিশ শতক ধরে মুক্তির দিকনির্দেশনা দান করেছে।
রদেনটিন নামক ঐতিহাসিকের মতে, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ায় প্রকৃতপক্ষে তিনটি বিপ্লব ঘটে। তিনটি বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে বলশেভিক দল লেনিনের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ভূমি ও স্বাধীনতার দাবিতে প্রথম বিপ্লব সংঘটিত হয়। এর ফলে জারতন্ত্রের পতন সূচিত হয়। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের বিপ্লবে ডুমা বা রুশ পার্লামেন্টের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতা অধিকার করে। রাশিয়ায় প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। এটি ছিল বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপ। ১৯১৭খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে বলশেভিক দল বুর্জোয়াদের বিতাড়িত করে শ্রমিক শ্রেণির সাহায্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, যা ছিল বিপ্লবের শেষ ধাপ।
সামাজিক অবস্থা
আঠারো শতক থেকে ইউরোপের বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বহুমুখী পরিবর্তন সাধিত হয়। পশ্চিম ইউরোপ হয়ে দাঁড়ায় আধুনিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের কেন্দ্রস্থল। ইউরোপের এই সমাজ বিকাশের গতি থেকে রাশিয়া ছিল অনেক দূরে। বিপ্লবের পূর্বেও রাশিয়াকে আধুনিক ইউরোপ থেকে বিছিন্ন করে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালু ছিল। পুঁজিবাদের বিকাশের যুগেও রাশিয়ার গ্রামগুলোকে বর্বরদের আস্তানার সাথে তুলনা করা যেত। রাশিয়ার সকল ভূমিই ছিল রাজপরিবার ও অভিজাতদের দখলে। বিংশ শতকের শুরুতে রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৭৭% ছিল কৃষক। অথচ জমির উপর কৃষকের মালিকানা ছিল না।
পশ্চিম ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের পর সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটলে ভূমিদাসরা স্বাধীন কৃষকে পরিণত হয়। রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার ভূমিদাসপ্রথার বিলোপ সাধন করলেও কৃষকরা ভূমিদাস থেকে ভূমিহীন শ্রেণিতে পরিণত হয়। ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়ায় শিল্পবিপ্লবের পর এ ভূমিহীন শ্রেণিই আবার শহুরে শিল্প শ্রমিকে পরিণত হয়। শ্রমিকদের ১১-১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হলেও তাদের পারিশ্রমিক ছিল খুব কম। শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে শ্রমিক ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে শ্রমিক ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল মাত্র ৯৬, সেখানে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তা ৯,৪৩৩টিতে দাঁড়ায়। এর পরের বছরই ১৯ লাখ ৫ হাজার ১৭৬টি শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়।
বিপ্লবের পক্ষে রাশিয়ার জনগণের মানসিক প্রস্তুতি সৃষ্টি করেন রুশ সাহিত্যিক গোর্কি, টলস্টয়, দস্তোয়েভস্কি, তুগের্নিভ, আইভান প্যাডলব প্রমুখ। এ সমস্ত সাহিত্যসেবীর লেখায় জনগণের মানসিক চেতনা বেড়ে যায়। ফলে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার প্রতি তাদের দারুণ অবজ্ঞার সৃষ্টি হয়। বুকানন ও কার্ল মার্ক্সের লেখার প্রভাবেও রাশিয়ার অভিজাত ও মালিক শ্রেণির মধ্যে অত্যাচারী জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
অর্থনৈতিক অবস্থা
বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার অর্থনীতি ছিল শোচনীয় ও পশ্চাৎপদ। কৃষিতে ভূমিদাসপ্রথা ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার রহিত করলেও সামন্ততান্ত্রিক 'ব্যবস্থার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ হয়নি। সংস্কারের পরও গ্রামাঞ্চলে ভূস্বামীদের প্রাধান্য থেকে যায়। ১৯০৬-১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জার সরকারের কৃষি অর্থনীতিতে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন প্রদেশে বসতি ও চাষাবাদের জন্য যে সকল কৃষককে জোর করে পাঠানো হয়েছিল, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তাদের শতকরা ৬০ ভাগ নিজ নিজ স্থানে ফিরে আসে। কৃষকদের মুক্তির পরও তাদের অবস্থা রাশিয়ায় সবচেয়ে শোচনীয় থেকে যায়। একটি সজীব কৃষি অর্থনীতি গড়ে ওঠেনি রাশিয়ায়। সোভিয়েত লেখক ওফর লাইয়ের মতো অন্য অনেক পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, জার শাসিত রাশিয়া তার কৃষি সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দশক থেকে রাশিয়ায় শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। রাশিয়ায় রেলপথের দৈর্ঘ্য বাড়ে। দেশি-বিদেশি প্রচুর বিনিয়োগ ঘটে। ভারী শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রপ্তানি বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ, দানবাস, সোতফ, উরাল, দানিয়েস্ক প্রভৃতি শহর শিল্পসমৃদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। তবু রাশিয়ায় মাথাপিছু শিল্প উৎপাদন জার্মানি থেকে ১৩, ইংল্যান্ড থেকে ১৪ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২১.৪ গুণ কম ছিল। রুশ শিল্পপণ্যের বৈদেশিক বাজার খুব সীমিত হওয়ায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অর্থনীতিতে পুনরায় মন্দা শুরু হয়, যা রুশ জনজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে রুশ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন বা অবনমন যা-ই হোক না কেন দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, যা ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক অবস্থা
(ক) শ্রমিক অসন্তোষ ও শ্রমিক আন্দোলন: ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের মহাসংস্কারগুলো রাশিয়ায় শিল্পায়নের পথ প্রশস্ত করেছিল। ফলে রাশিয়ায় একটি শ্রমিক শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বিভিন্ন শ্রম আইন সত্ত্বেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে রুশ শ্রমিকদের দুর্দশা ছিল সীমাহীন। তাদের মজুরি ছিল সামান্য, তাদের শিক্ষা ছিল না, বাসগৃহের অভাব ছিল, অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। ফলে রাশিয়ায় ক্রমাগত শ্রমিক ধর্মঘট হতে থাকে। ধর্মঘটের আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ আন্দোলন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্লবে পরিণত হয়। কিছুকাল এ আন্দোলন স্তিমিত হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে তা পুনরুজ্জীবিত হয়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ৭,২৫,০০০ শ্রমিক এবং ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৮,৮৭,০০০ শ্রমিক বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য ধর্মঘট করে। বলশেভিক (সংখ্যাগরিষ্ঠ) ও মেনশেভিকরা (সংখ্যালঘিষ্ঠ) শ্রমিক অন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। কিন্তু ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমানভ বংশের পতনের পর গঠিত অস্থায়ী সরকার শ্রমিক শ্রেণির অসন্তোষ দমনের কোনো চেষ্টা করেনি, যার সুযোগ গ্রহণ করে বলশেভিকরা শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত করে।
(খ) সমাজতান্ত্রিক মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশ: ইউরোপে শিল্পোন্নয়নের ফলে সমাজে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়। শ্রমিক শোষণ, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকের বাসস্থানের সমস্যা, শ্রমিক শ্রেণির কাজের সময়, বেতন, ভাতা, ছুটি প্রভৃতি সমস্যার কারণে শিল্পায়িত সমাজে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে, যার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপত্তি হয় সমাজতান্ত্রিক মতবাদের। ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী চার্লস ওয়েন, ফরাসি সমাজতন্ত্রী সেন্ট সাইমন, রাশিয়ার সমাজতন্ত্রী মিখাইল বুকানন সামাজিক অসংগতি ও দুর্গতি অবসানের পথনির্দেশ করেন। তারা ইউরোপের সমাজ ও রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেও কীভাবে সমাজতন্ত্র আসবে সে সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি। এজন্য তাদের কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী বলা হতো। সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বাস্তব রূপরেখা, যৌক্তিক প্রয়োগ ও সমাজতন্ত্র অর্জনের রূপরেখা তুলে ধরেন কার্ল মার্ক্স। কার্ল মার্ক্সের আদর্শ ও নির্দেশিত পথকে সামনে রেখে উনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপের দেশে দেশে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক পার্টি গড়ে ওঠে। রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি কার্ল মার্ক্সের নির্দেশিত আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক দল। লেনিন মার্ক্সের নির্দেশিত পথ ও আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যান এবং রাশিয়ার বিপ্লব সম্পন্ন করেন।
(গ) জারতন্ত্রের অযোগ্যতা: রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পথকে এগিয়ে দিয়েছিল জারতন্ত্রের অযোগ্যতা। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে রাশিয়ায় স্বেচ্ছাচারী জারতন্ত্র নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়েও দেশকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিল না। ১৯০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের যুদ্ধে জাপানের কাছে পরাজয়ে দেশে জারতন্ত্রের মিথ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যান্য কারণের সাথে যুক্ত হয়ে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ায় বিপ্লব শুরু হয়, লেনিন যাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রিহার্সেল বলেছেন। বিপ্লবী শক্তির উত্থান, রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ ও বিকাশ জারতন্ত্রকে সংকটে নিক্ষেপ করে, যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়নি। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল বলশেভিক বিপ্লবের।
(ঘ) সাংবিধানিক ত্রুটি: রাশিয়ার সাংবিধানিক ব্যবস্থা ছিল আসলে মেকি নিয়মতান্ত্রিকতা। কারণ মৌলিক আইন অনুযায়ী সরকারি প্রশাসন ও মন্ত্রীরা ডুমার কাছে দায়িত্বশীল ছিলেন না। তাছাড়া প্রাথমিক অবস্থায় প্রকৃত চরিত্র যা হোক না কেন ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের স্বৈরাচারী নির্বাচনি আইন তাকে বিনষ্ট করেছিল। দ্বিতীয় নিকোলাসের কর্তৃত্বপরায়ণ নীতি তাকে অর্থহীন করে দেয়। দ্বিতীয় নিকোলাসের সিংহাসনে আরোহণের ফলে অনেকে মনে করেছিলেন, প্রতিক্রিয়া কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তিনি স্বৈরাচারের নীতিকে রক্ষা করতে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। আর এ ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি গোরেমেকিন ও সুখোমলিনভের মতো ব্যক্তিত্বহীন মন্ত্রী ও রাসপুতিনের মতো উদ্ভট মানুষ। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় অপ্রচুর ভূমি পুনর্বণ্টন ও কয়েকটি বৃহৎ কারখানা তৈরি করে মৌলিক অসাম্য ও ব্যাপক দুর্গতির অবসান করা সম্ভব ছিল না। পুরাতন রাশিয়া তাই বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যায়।
ঙ) নিহিলিজম ও নারোদনিক আন্দোলনের প্রভাব উনিশ শতকের রাশিয়ায় সমাজ পরিবর্তনের জন্য জারবিরোধী অনেক গুপ্ত আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, গড়ে উঠেছিল গুপ্ত সংগঠন। এই সংগঠনসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিহিলিজম ও নারোদনিক আন্দোলন। রুশ শব্দ নারোদ অর্থ জনগণ। এ দুটি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল জার শাসনের অত্যাচার ও শোষণ থেকে দেশাকে মুক্ত করা এবং সাধারণ মানুষের মুক্তিসাধন। এসব 'আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তাদের সংগ্রাম ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল।
(চ) রাজনৈতিক শক্তির উত্থান: রাশিয়ায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটতে থাকে। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (RSDLP) গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে উক্ত পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে আন্দোলনের রণকৌশল নিয়ে পার্টি দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নেতৃত্ব প্রদান করেন লেনিন। এটাকে বলশেভিক পার্টি বলা হয়। মার্তন্ড ও প্লেখানভের নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু অংশটিকে মেনশেভিক পার্টি বলা হয়। এই দল ছিল রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণির দল, যার কর্মসূচির মধ্যে ছিল জারতন্ত্রের পতন, শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা ও সমাজ পরিবর্তন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির এক সংগঠনে পরিণত হয় বলশেভিক পার্টি। বলশেভিক পার্টিকে গোপন অবস্থায় দেশে ও বিদেশে জারতন্ত্র উৎখাতের জন্য আন্দোলন করতে হয়। বলশেভিক পার্টি ইঞ্জা, ক্রদ, প্রলেতারি, প্রাভদা প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাপক মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে।
(ছ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রাশিয়ার সামগ্রিক সর্বনাশ ডেকে এনেছিল এবং বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। রুশ সাম্রাজ্যের কাঠামোকে শেষ ধাক্কা দিয়েছিল এ যুদ্ধ, যাতে দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এর কারণ যুদ্ধ গোটা রুশ জাতির উপর অসহনীয় বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছিল। সম্পত্তি ও বেসামরিক মানুষের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ব্যাপক। পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। প্রচণ্ড মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। ফলে চরম অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও দুর্ভিক্ষের দায় গিয়ে পড়ে জারতন্ত্র ও মিত্রদেশগুলোর উপর। বলশেভিকরা এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী, আগ্রাসী, আদর্শবিহীন ও জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া বলে অভিহিত করে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানায়। যুদ্ধ যতই দীয়স্থায়ী হতে লাগল, বলশেভিক পার্টির বক্তব্যের যথার্থতা ততই প্রমাণিত হতে লাগল এবং জনগণের অসন্তোষও বাড়তে লাগল; যার ফল হচ্ছে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের বিপ্লব।
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন ও প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের বুর্জোয়া বিপ্লব রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। ডুমা'র সদস্যদের দ্বারা অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। কেরোনেস্কির মতো মধ্যপন্থি থেকে রক্ষণশীল নেতারা এতে যোগ দেন। কিন্তু বলশেভিকদের এই সরকারের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। ফলে তারা শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি নিয়ে সোভিয়েত (পরামর্শসভা) গঠন করে।
সেভিয়েতগুলো রুশ সমাজতন্ত্রের পার্লামেন্টে পরিণত হতে থাকে। দেশে কার্যত একটি দ্বৈত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বলশেভিক পার্টি সোভিয়েতগুলোকে অধিকতর ক্ষমতাদানের দাবি জানাতে থাকে। তারা মনে করত, বুর্জোয়া শ্রেণির 'দ্বারা গঠিত সরকার বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করবে, শ্রমিকদের নয়। শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা সরকার গঠিত না হলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। এদিকে, বলশেভিক নেতা লেনিন ৩রা এপ্রিল সুইজারল্যান্ডের নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে এসে তার বিখ্যাত 'এপ্রিল থিসিস' ঘোষণা করে বলেন-
১। মার্চ বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণির বিজয় হয়েছে। এতে শ্রমিকদের সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই।
২। বুর্জোয়া বিপ্লব ও শ্রমিক বিপ্লব একসাথে চলতে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত শ্রমিকরা ক্ষমতা দখল করবে।
৩। শ্রমিকদের স্বার্থে এখনই ক্ষমতা দখল করতে হবে।
৪। যুদ্ধে রুশ জনগণ কোনো সাহায্য করবে না। সৈনিকরা সোভিয়েত সরকারের সাথে সহযোগিতা না করলে তাদের ফল ভোগ করতে হবে।
এদিকে, এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধ্যে দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে থাকে। অস্থায়ী সরকার জনগণকে আস্থায় না নিয়ে একের পর এক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে থাকে, যার সুযোগ গ্রহণ করেন লেনিন ও তার দল। বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার সংকট বাড়তে থাকে। মে মাসে কেরোনেস্কিকে সমরবিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত করেও যুদ্ধে রুশ বাহিনীর বিশৃঙ্খলা দূর করা সম্ভব হয়নি। দেশে গণবিক্ষোভ বাড়তে থাকে। জুলাই মাসে কঠোর বিক্ষোভের মুখে চরম দমননীতি পরিচালিত হয়। কেরোনেস্কিকে ২১শে জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। কৃষকরা জমিদারদের ভূসম্পত্তি দখল করতে শুরু করে। পেট্রোগ্রাডে নতুনভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
লেনিন শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। কেরোনেস্কি ১লা আগস্ট কার্নিলভকে সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। প্রথম দিকে উভয়ের মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকলেও কার্নিলভের বেসামরিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নীতি উভয়ের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত করে। কেরোনেস্কি কার্নিলভকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে 'বলশেভিক' ও 'সোভিয়েতদের' দেশরক্ষার 'জন্য আহ্বান করেন। এতে কার্নিলভকে প্রতিরোধ করার নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পার বলশেভিকরা। বলশেভিকদের প্রভাব ছিল সেনাবাহিনীতে। পেট্রোগ্রাডের কাছাকাছি কার্নিলভের বাহিনী সোভিয়েতের বিপ্লবী প্রতিনিধিদের মুখোমুখি হয়। এই বাহিনীর একদিকে যেমন বিশেষ মনোবল ছিল না, তেমনি নিজেদের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার স্পৃহাও ছিল না। সুতরাং তারা অস্থায়ী সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কার্নিলভকে বন্দি করা হয়।
১৪ই সেপ্টেম্বর কেরোনেস্কি রাশিয়াকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। লেনিন এই পরিস্থিতিতে কেরোনেস্কির সরকারকে যথার্থ বলে মনে করেননি। তার কোনো সন্দেহ ছিল না যে, তার একমাত্র কর্তব্য হলো সব বিরোধিতা চূর্ণ করে পার্টিকে বিজয়ের পথে নিয়ে যাওয়া। কার্নিলভের পরাজয় ও অস্থায়ী সরকারের নিঃশেষ অবস্থা তাকে সেই সুযোগ এনে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, ক্ষমতা দখলের সময় এসেছে। ফিনল্যান্ড থেকে চিঠি লিখে পার্টিকে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জরুরি নির্দেশ দেন। কিন্তু পার্টির নেতাদের মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য ছিল না। ট্রটস্কি লেনিনকে সমর্থন করেন এবং বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। বলশেভিক পার্টি গোপনে সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অক্টোবর মাসে ৬২টি শহরে প্রায় দুই লাখ 'লালফৌজ' প্রস্তুত হতে থাকে। পেট্রোগ্রাডে মূলশক্তির সমাবেশ ঘটানো হয়।
অস্থায়ী সরকার বলশেভিকদের সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেনি। ২৪শে অক্টোবর সরকার বলশেভিক পার্টির অফিস আক্রমণ করবে- এ খবরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে বলশেভিকদের ব্রিগেডগুলো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ দখল করে নেয়। কিন্তু তাদের বিশেষ কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। ২৫শে অক্টোবর সকালে রাশিয়ার ক্ষমতা সোভিয়েতদের হাতে চলে আসে। বলশেভিক পার্টি ক্ষমতা গ্রহণ করে। লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সরকার। মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে অস্থায়ী সোভিয়েত সংবিধান রচিত ও গৃহীত হয়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে অস্থায়ী সংবিধান বাতিল করে একটি স্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। স্থায়ী ও নতুন সংবিধানে দেশের শাসনক্ষমতা ৪টি সংস্থার উপর ন্যস্ত করা হয়। নতুন সংবিধানে রাশিয়ার নামকরণ করা হয় USSR (ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক)। সাম্রাজ্যের পরিবর্তে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হয়।
সমাজতন্ত্র ও বলশেভিক বিপ্লব
ঊনবিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের ন্যায় সমাজতন্ত্রের আন্দোলন শুরু হয়। রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক ছিল প্রথম সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিপ্লব'। রাশিয়ায় অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা ও অবহেলিত জনগণের উন্নতিসাধনের ইচ্ছা থেকে সমাজতন্ত্রের উদ্ভব। শিল্পবিপ্লবের ফলে নানা রকম শিল্পকারখানা নির্মিত হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক দেশের জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বণ্টনব্যবস্থার ত্রুটিজনিত কারণে সমাজে পুঁজিপতি তথা পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়। পুঁজিপতিরা ক্রমেই বিত্তশালী হতে থাকলে সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিকের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য দেখা দেয়।
শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করেও দরিদ্রভাবে জীবন যাপন করত। তাদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হতো। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। মুষ্টিমেয় ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক সামঞ্জস্যবিধানের প্রচেষ্টা থেকেই সমাজতন্ত্রের উদ্ভব। সমাজতন্ত্রবাদের অর্থ হলো গণতন্ত্রের ভিত্তিতে স্থাপিত সমাজ কর্তৃক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠুভাবে আয় বণ্টনব্যবস্থা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই সমাজতন্ত্রের উদ্ভব। সমাজতন্ত্র বলতে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা বোঝায় যেখানে সব জনসাধারণ ভূমি ও অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পত্তির মালিক থাকে এবং তাদের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্র সেসব সম্পত্তি পরিচালনা করে। উৎপাদন ও বিনিময়মাধ্যমগুলোর সমষ্টিগত মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণই সমাজতন্ত্রের মূলকথা।
সমাজতন্ত্রের প্রসার
সমাজতন্ত্রের নানা জটিলতা ও অনিশ্চয়তা মার্ক্স অনেকখানি পরিষ্কার করে তাকে ইউরোপে সমাদৃত করে তুলেছিলেন। মার্ক্সবাদ ইউরোপে একটি শক্তিশালী প্রভাবে পরিণত হয়। ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্র শান্তিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল। তাই মার্ক্সবাদের বৈপ্লবিক স্বরূপ ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হতে পারেনি। ফ্যাবিয়ান সোসাইটি ও ইনডিপেনডেন্ট লেবার পার্টির মাধ্যমে ইংল্যান্ডে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ফ্রান্সে সিন্ডিকেলিস্টরাই ছিল শক্তিশালী। তারা মার্ক্সবাদের বিরোধিতা করে, কারণ 'প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ' গণতন্ত্রবিরোধী ছিল। বেবেউফ-এর নেতৃত্বে ফ্রান্সে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে থাকে। সমাজতন্ত্র জার্মানিতে সর্বপ্রথম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মতো ইউরোপীয় অন্যান্য রাষ্ট্রেও মার্ক্সবাদ প্রচার করার জন্য ক্রমশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিসমার্কের মতো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদ সমাজতন্ত্রের প্রসার রোধে জার্মানিতে কয়েকটি আইন বিধিবদ্ধ করেন।
মোটকথা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই ৪০ বছরব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন ইউরোপের মূল ঘটনা ছিল এবং সমাজতন্ত্র প্রসারের ফলে সর্বত্র শ্রমিককল্যাণমূলক বহু আইনও রচিত হয়েছিল। পররাষ্ট্র ব্যাপারে অবশ্য সমাজতন্ত্র বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা সমাজতন্ত্র বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত সমাজতন্ত্র সকলের কাছে আদর্শস্বরূপ ছিল। কিন্তু রাশিয়ায় ১৯১৭খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেই শ্রেণিসংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠলে সাম্যবাদ বলশেভিকদের দ্বারা বিপ্লবের আকার ধারণ করে। ফলে সমাজতন্ত্রবাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকল না।
সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
প্রধান সমাজতান্ত্রিকদের মতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো:
- ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে সামাজিক স্বার্থের প্রাধান্য;
- পুঁজিবাদের বিলোপ;
- সকল ক্ষেত্রে সম-অধিকার;
- ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ;
- উৎপাদনব্যবস্থা দ্রুত রাষ্ট্রীয়করণ এবং
- সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন।
- বলশেভিক বিপ্লবের ফলে এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছিল মার্ক্সীয় মতবাদের দ্বারা লেনিনের মাধ্যমে।
মার্ক্স ও এঙ্গেলসের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ
আধুনিক সমাজতন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা হলেন কার্ল মার্ক্স। জার্মানির এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মে জার্মানির টিয়েরে কার্ল মার্ক্সের জনন্ম হয়। জার্মানির বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময় তিনি হেগেলের চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হন। যৌবনে তিনি জার্মানির গণতান্ত্রিক বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি উগ্রপন্থি সংবাদপত্রের সম্পাদনা করলে প্রুশিয়ার সরকারের বিরাগভাজন হন। ফলে তিনি জার্মানি ত্যাগ করে প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই তার ভবিষ্যৎ সহকর্মী ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের সাথে পরিচয় ঘটে। আধুনিক সমাজতন্ত্র বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক বলা হয় তাদের। তারা উভয়েই ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো প্রকাশ করলে পুঁজিপতিদের স্বার্থে প্রচণ্ড আঘাত লাগে এবং শ্রমিকদের মনোজগতে এক বিরাট পরিবর্তনের সৃষ্টি হয়।
মেনিফেস্টোতে (ইশতেহারে) বলা হয়, "শৃঙ্খল ছাড়া প্রলেতারিয়েতের হারানোর কিছু নেই। জয় করার জন্য তাদের রয়েছে একটি বিশ্ব।" ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তারা পৃথিবীর সকল সমাজতন্ত্রীকে একত্রিক করার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক সমিতি গঠন করেন। এটিকে পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন বলা হয়। এ সম্মেলন ছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান ও শক্তিশালী করার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্ক্স তার শ্রেষ্ঠ পুস্তক 'Das Capital' প্রকাশ করেন। সমাজতন্ত্রের নতুন রূপ অর্থাৎ সাম্যবাদ এ পুস্তিকায় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম কথাই হলো, "মনুষ্যসমাজের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের নামান্তর মাত্র।" তিনি এ পুস্তকে সমাজতন্ত্রের (Socialism) পরিবর্তে Communism নামটি ব্যবহার করেন। এ পুস্তক অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন মতবাদ ও দিকনির্দেশনা দিলে এর প্রভাবে বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদী দল গঠিত হতে থাকে। কে নতুন।
তার প্রবর্তিত সমাজতন্ত্রের বা সমাজতন্ত্রবাদের মূল সূত্র চারটি-
প্রথমত: তার মতে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানুষের জীবনের মূলভিত্তি হলো অর্থনীতি এবং ইতিহাস হলো মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের বিবরণমাত্র।
দ্বিতীয়ত: মার্ক্স সমাজকে বিত্তশালী পুঁজিবাদী শ্রেণি ও বিত্তহীন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এ দুই শ্রেণির মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য এবং সংঘর্ষের ফলে শ্রেণিহীন সমাজের অভ্যুদয় ঘটবে।
তৃতীয়ত: তিনি রিকার্ডোসহ ইংরেজ অর্থনীতিবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে 'উদ্বৃত্ত অর্থনীতি' নামক মতবাদ প্রচার করেন। এ মতবাদের মূলকথা হলো, অর্থ শ্রমিকের পরিশ্রম থেকে উদ্ভূত। কোনো দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের প্রকৃত মাপকাঠি হলো শ্রম। সুতরাং শ্রমের মাপকাঠি দ্বারাই অর্থের বণ্টন হওয়া উচিত।
চতুর্থত: তার মতবাদ অনুসারে শ্রমিকের কোনো দেশ নেই। সকল দেশের শ্রমিকরাই বঞ্চিত ও নির্যাতিত।
সুতরাং দেশ ও জাতি-নির্বিশেষে সকল শ্রমিকই সম্মিলিতভাবে শ্রেণি সংগ্রাম চালাবে। নানা সমালোচনা থাকলেও মার্ক্স ও এঙ্গেলসের আধুনিক সমাজতান্ত্রিক মতবাদের একটি আন্তর্জাতিক আবেদন আছে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

