- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- বলশেভিক বিপ্লব
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
বলশেভিক বিপ্লব
বলশেভিক বিপ্লবে দার্শনিক
ফরাসি বিপ্লবে যে রকম দার্শনিকদের একটা ভূমিকা ছিল, বলশেভিক বিপ্লবেও রুশ সাহিত্যিকদের অবদান ছিল। তবে বলশেভিক বিপ্লবের দার্শনিক মূলত কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস, বুকানন প্রমুখ। তাদের লেখনী রাশিয়ার অবহেলিত ও বঞ্চিত শ্রমিকদের মধ্যে সকল ক্ষেত্রে অসাম্য দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা দেয়। সকল দিক দিয়ে বঞ্চিত, অবহেলিত শ্রমিকরা সুসংগঠিত হয়ে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনমুখী হয়। তবে শ্রমিকদের মধ্যে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পেছনে মার্ক্সের Das Capital-এর ভূমিকা খুব অল্প পরিমাণে ছিল। কেননা রাশিয়ার শ্রমিকরা ছিল অশিক্ষিত। তাই Das Capital-এর মর্মবাণী বোধগম্য করে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনমুখী হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো ধী-শক্তি বা সৃজনী শক্তি তাদের ছিল না।
টমাস ম্যুর (১৪৭৮-১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দ) [Thomas More (1478-1535)]: সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কাল্পনিক ধারণা প্রথম দেন ব্রিটিশ লেখক টমাস ম্যুর (১৪৭৮-১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দ) তার লেখা 'Utopia' গ্রন্থে। ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত 'ইউটোপিয়া' গ্রন্থে টমাস ম্যুর দুজন ব্যক্তির একটি কাল্পনিক দ্বীপে বসবাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, যে দ্বীপের সবকিছুর মালিক দ্বীপের অধিবাসীরা। ম্যুর একটি কাল্পনিক সমাজের বর্ণনা দেন, যেখানে সবাই শ্রম দেয় এবং কারও কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই। এ দ্বীপে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই, শ্রমশোষক ব্যক্তি নেই। এখানে সব মানুষের সুখ-শান্তির দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তার বিখ্যাত উক্তি "The King's good servant, but God's first." তার সমাজতান্ত্রিক চিন্তা আলোর মুখ না দেখলেও তার চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করেই পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তাই তাকে কাল্পনিক বা আদি সমাজতন্ত্রের জনক বলা হয়। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের যৌথ প্রচেষ্টায় 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো' প্রকাশিত হলে সমাজতন্ত্রের ইউটোপীয় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
মিখাইল বুকানন (১৮১৪-১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) [Mikhail Bakunin (1814-1876)]: মিখাইল বুকানন ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে রাশিয়ায় এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়সেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি The Reaction in Germany' নামের একটি প্রবন্ধ লিখে সমাজতান্ত্রিক যুবসমাজ ও আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ রচনার মূল বক্তব্য ছিল- 'ধ্বংসের মাধ্যমেই নতুন সৃষ্টির উদ্ভব।' দীর্ঘদিন তিনি ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের জন্য বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তাকে স্যাক্সনিতে গ্রেফতার করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অস্ট্রিয়ার অনুরোধে তার মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবনে রূপান্তর করে অস্ট্রিয়ায় হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ কারাভোগের পর তিনি সাইবেরিয়া হয়ে লন্ডনে আসেন। বুকানন্ন ছিলেন নৈরাজ্যবাদী। তার মতে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় লোক বৃহত্তর জনগণকে শোষণ করে, যা একটি বৈষম্যমূলক অন্যায়। গির্জা সম্পর্কে তার ধারণা হলো- গির্জা মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করে। গির্জা হলো একটি শোষণমূলক সংস্থা। তার ধারণা হলো, মানুষ মৌলিকভাবে সৎ হলেও বিভিন্ন সংস্থা দ্বারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। Official Power সর্বদাই দুর্নীতিপরায়ণ, এমনকি মহত্তম ব্যক্তিদের অফিসার পদে নিয়োগ করা হলেও। এজন্য তিনি সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলুপ্তি কামনা করেন। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা না রেখে একটি গোপন আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলার উপর মত দেন, যে সংস্থার জাতীয় শাখা থাকবে এবং জাতীয় সব বিষয় দেখভাল করবে। এটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অধস্তন হিসেবে কাজ করবে। তার নৈরাজ্যবাদী মতবাদ সেকালে তরুণসমাজের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) [Karl Marx (1818-1883)] ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দ) [Friedrich Engels (1820-1895)]: সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মানুষ যাদের অনুসরণ করে তাদের মধ্যে কার্ল মার্ক্স ও এঙ্গেলসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কার্ল মার্ক্স ও এঙ্গেলস একই সাথে ইতিহাস, অর্থনীতি ও দর্শনের উপর পর্যালোচনা করেন। তারা উভয়েই ইউরোপের বিপ্লবী উত্থানের ফলে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত করার মধ্য দিয়েই সংগ্রাম নিষ্পত্তি হতে পারে বলে অভিমত দেন। মার্ক্স ছিলেন জটিল তাত্ত্বিক বিষয়াবলির সমাধান সহজভাবে করতে পারদর্শী আর এঙ্গেলস ছিলেন ব্যাপক মানুষের নিকট তা উপযোগী করে লিখতে সিদ্ধহস্ত। পুঁজিবাদের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাদের ধ্যানধারণা একই রকম হওয়ায় তাদের বন্ধুত্ব আমৃত্যু টিকে ছিল। তারা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম একদিন বিপ্লবের মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিণতি অর্জন করবে বলে ধারণা প্রদান করেন। মার্ক্স তার 'Das Capital' সহ অসংখ্য গ্রন্থে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণে বিপ্লব অনিবার্য বলে মত দেন। এঙ্গেলস তার চিন্তাধারাকে আরও বিস্তৃত করেন। মার্ক্সের শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী তত্ত্ব সমগ্র ইউরোপের বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তাদের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক মতবাদের অনুপ্রেরণা রুশ বিপ্লব সংঘটনের অন্যতম কারণ।
১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তারা সম্মিলিতভাবে বিখ্যাত পুস্তক 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো' (Communist Menifesto) প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তারা এই প্রথম ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা হাজির করেন। তারা এ গ্রন্থে বলেন, শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে বুর্জোয়াতন্ত্রকে খতম করে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই কমিউনিস্ট আন্দোলনের লক্ষ্য। তাদের উদ্দেশ্য হলো এমন এক শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না।
তবে শ্রমিকরা ফরাসি বিপ্লবের মূল বাণী সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বলশেভিক বিপ্লব সৃষ্টি করেনি। মূলত শ্রমিকরা প্রেরণা পেয়েছিল কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো থেকে। মার্ক্সের আধুনিক সমাজতন্ত্রের মূলবাণী তাদের মনোজগতে বিপ্লবের মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্র তৈরি করতে সহায়ক হয়েছিল। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হলে বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ শ্রমিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিল। শ্রমিকরা মূলত সমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতামালা, গণসংযোগ দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে সংঘবদ্ধ হয়। ফলে স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বলশেভিকদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে। কাজেই মার্ক্সের লেখনীর প্রভাব শ্রমিকদের মধ্যে তেমন একটা ছিল না। মার্ক্সের লেখনীর প্রভাব শিক্ষিত শ্রেণির একাংশ ও অভিজাত-মালিক শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। শিক্ষিত শ্রেণির একাংশ মার্ক্সবাদের প্রভাবে সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নিলেও রাশিয়ার জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ নেয়নি।
'ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে ইউরোপে কতিপয় সমাজতন্ত্রী বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব হয়। যেমন- রবার্ট ওয়েন, টমাস হজস্কিন, ফেবিয়ার প্রমুখ সমাজতন্ত্রীর আদর্শ ছিল এমন এক সমাজ স্থাপন করা, যে সমাজে সকলেই যোগ্যতানুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম দ্বারা লব্ধ আয় সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টন করা হবে। এ সকল সমাজতন্ত্রী ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন। কিন্তু তাদের দর্শন বা আদর্শগত চিন্তাধারা রুশ বিপ্লবের শ্রমিকদের তেমন একটা প্রভাবিত করেনি। কেননা রুশ বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে অর্থাৎ জার আমলে রাশিয়ায় বাইরের লেখনীর অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তবে সমাজতন্ত্রকে রাজনৈতিক আদর্শে পরিণত করতে তাদের লেখনীর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সাহিত্যিকদের বিপ্লব সৃষ্টিতে উল্লেখ করার মতো অবদান ছিল। মেক্সিম গোর্কি, টলস্টয়, বুকানন, তুর্গেনিভ, পেভলভ, দস্তোয়েভস্কি প্রমুখের সাহিত্যকর্ম শিক্ষিত রাশিয়ানদের মধ্যে বিপ্লবপূর্ব সময়ে মানসিক প্রস্তুতির পটভূমি সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রামিত হয়। তাদের লেখার প্রভাবে স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের অসংগতিগুলো শিক্ষিত সমাজের মাধ্যমে সাধারণ শ্রমিকদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষের উদ্ভব হয়। মার্ক্সের প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক সংঘের প্রভাবে সংক্ষুব্ধ ও ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে, যার চূড়ান্ত প্রতিফলন বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। কাজেই বলশেভিক বিপ্লবের দার্শনিক বলতে মার্ক্স, বুকানন এবং রাশিয়ার সেই সাহিত্যিকদের বোঝায় যাদের লেখনী অনাচারপূর্ণ সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণের মনে জারবিরোধী ক্ষোভের সঞ্চার করতে সহায়ক হয়েছিল।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

