- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- বলশেভিক বিপ্লব
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
বলশেভিক বিপ্লব
লেনিন ও বলশেভিক বিপ্লব
সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে যেসব মনীষী মার্ক্স ও এঙ্গেলসের চিন্তাধারাকে ধর্মীয় বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন এবং যারা তাদের প্রতিটি চিন্তায় ও কর্মে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে মার্ক্সবাদের আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন, লেনিন তাদের অন্যতম। রুশ বিপ্লবের এ মহানায়ক ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ২২শে এপ্রিল কাজান প্রদেশের ভলগা নদীতীরবর্তী সিমবিস্ক নামক স্থানে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লেনিনের পরিবার বিপ্লবী হিসেবেই খ্যাত। তার ভাই আলেকজান্ডার রুশ জারকে হত্যা করার অপরাধে ফাঁসিমঞ্চে প্রাণ দিয়েছিলেন। তার অপর ভাই ও দুই বোন রাজনৈতিক কারণে পুলিশের নজরবন্দি ছিলেন। লেনিন ছাত্রাবস্থায় ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন।
পরবর্তীকালে বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার অপরাধে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দণ্ড ভোগ করেন। কাজেই সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজের নানা ঘটনা তার কিশোর মনকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। মার্ক্স ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তাকে ধারণ করে লেনিন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে তার দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিকের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয় এবং তিনি নব উদ্যমে সোভিয়েত রাষ্ট্র গঠন করে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের কাজে অগ্রসর হন। ধনতন্ত্র পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সর্বনাশা ব্যবস্থা বলে তার নিকট মনে হতো। বিপ্লবের দ্বারা ধনতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই ছিল তার স্বপ্ন। বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্বতন শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে তিনি বলশেভিক শাসনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
বলশেভিক শাসনে লেনিনের কৃতিত্ব
ক্ষমতা দখলের পর লেনিন ও তার সহযোগীরা রাশিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে হাত দেন। লেনিন শ্রমিকদের রুটি, কৃষকদের জমি ও সেনাদলের শান্তিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা নিয়েছিলেন এবং তা পূরণের জন্য তার সরকার আত্মত্মনিয়োগ করে। তিনি সর্বপ্রথম জার্মানির সাথে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনের কাজে হাত দেন। ট্রটস্কির প্রচেষ্টায় কাইজারের জার্মানির সাথে ব্রেস্ট-লিটভস্ক সন্ধি দ্বারা শান্তি স্থাপন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রুশ বিপ্লবকে স্থায়ী করতে হলে যুদ্ধ বন্ধ করে অবিলম্বে শাস্তি স্থাপন করা দরকার। এজন্য তিনি জার্মানির প্রস্তাবিত সন্ধির শর্তাবলি স্বীকার করেন। এ সন্ধি স্বাক্ষর ছিল লেনিনের দূরদর্শিতার পরিচায়ক। অতঃপর তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পুরাতন তন্ত্রের প্রশাসনিক কাঠামোগুলো ভেঙে ফেলেন। সরকারের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে বিশ্বস্ত বলশেভিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। রাশিয়ার জাতীয় গির্জাকে রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে গির্জার ভূসম্পত্তিগুলো জাতীয়করণ করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এদিকে বলশেভিক বিপ্লবকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ধনতান্ত্রিক দেশগুলো রুশ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে। রাশিয়ার কেরোনেস্কিও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ধ্বংসের চক্রান্ত শুরু করেন।
"ইউরোপে সাম্যবাদ প্রসারিত হওয়ার বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা আমি দেখতে পাচ্ছি"- লেনিনের এ উক্তিটি ইউরোপীয় ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে শঙ্কিত করে তোলে। রুশ বিপ্লবের বিশ্বজনীন আবেদন বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলোর বলশেভিকদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিতাড়নের চেষ্টা লেনিন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করতে পেরেছিলেন, যা ছিল নবপ্রতিষ্ঠিত বলশেভিক সরকারের অর্থাৎ লেনিনের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। সাম্যবাদী পরিভাষায় প্রতিবিপ্লবীদের শ্বেত প্রতিবিপ্লবী বলা হয়। এভাবে অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ ও বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কার ফলে বলশেভিক সরকার দারুণ সমস্যায় পড়ে। কিন্তু লেনিনের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও তার দুই সহযোগীর কর্মদক্ষতার ফলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিপদমুক্ত হয়।
লেনিনের আমলে রাশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। বলশেভিক সরকারের (১৯১৮-২১ খ্রিষ্টাব্দ) গৃহীত অর্থনীতিকে যুদ্ধকালীন জরুরি সমাজতন্ত্র বলা হয়। কেননা এই সময়ে কৃষি উৎপাদন ছিল খুবই কম এবং দেশের উন্নয়নের গতি ছিল ধীর ও মন্থর। ফলে তিনি শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কৃষি খামারগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার উন্নতিবিধানের জন্য তার সম্পত্তি জাতীয়করণ নীতি সমৃদ্ধির মূলে কাজ করেছিল। যদিও তার আর্থিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কারগুলো বিরোধীদের দ্বারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, তবে তার 'নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা' সাফল্যের মুখ দেখতে পেরেছিল। এ নতুন অর্থ পরিকল্পনায় (ক) কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে তাদের উপর একটি নির্দিষ্ট কর ধার্য করা হয়, (খ) খুচরা ও ব্যক্তি ব্যবসা চালনার সমস্যা দূর করা হয়, (গ) ব্যাংক ও অর্থসংক্রান্ত ব্যবস্থার উন্নতি বিধান করা হয়, (ঘ) সরকারি সমিতি গঠন করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, (ঙ) শ্রমিকদের ক্রমবর্ধিত হারে মজুরি বেঁধে দেওয়া হয়, (চ) শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়, (ছ) শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেওয়া হয়।
তার এ পরিকল্পিত নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে দেশের কৃষি, শিল্প প্রভৃতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে থাকে। সরকার জাতীয় উন্নয়নে জনসাধারণকে উৎসাহিত করে। করভার পুনর্বণ্টন করে সরকার কৃষকদের আর্থিক উন্নতি সাধন করে। ফলে দেশের উন্নয়নের গতি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকল। এরই ধারাবাহিকতায় লেনিন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। লেনিনের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি সংবিধান রচনা। এ সংবিধানে সোভিয়েতগুলোই শাসনব্যবস্থার বৈধ সংস্থা ছিল। কার্যত লেনিনের কমিউনিস্ট দলই ছিল প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী, যার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। তার সর্বশেষ কৃতিত্ব ছিল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে বলশেভিক সরকারের স্বীকৃতি লাভ। লেনিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিকেরিনের কূটনীতির ফলে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড সর্বপ্রথম রাশিয়াকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশ সোভিয়েত রাশিয়াকে স্বীকৃতি দেয়। পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরে সোভিয়েত রাশিয়াকে স্বীকৃতি দেয়।
দেশের জনগণকে অগ্রগতির ছোঁয়া দিয়ে কালজয়ী লেনিন ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী লেনিন পুরনো ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেন। বলশেভিক বিপ্লবের দ্বারা সমাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন ও রাশিয়ার উন্নতিসাধনে তার কৃতিত্ব ছিল অতুলনীয়। লেনিন তাই বিংশ শতাব্দীর স্মরণীয় মহাপুরুষ। তার মৃত্যুর পর বলশেভিক ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে ট্রটস্কি ও স্ট্যালিনের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ট্রটস্কি রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হলে স্ট্যালিন লেনিনের সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ধারণ করে রাশিয়াকে আরও উচ্চ শিখরে নিয়ে যান।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

