• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি

দেশপ্রেম ও জাতীয়তা

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

দেশপ্রেম ও জাতীয়তা

জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদের উপাদান Elements of Nationality or Nationalism

জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই জাতি-রাষ্ট্রের (Nation-state) উদ্ভব এবং এ জাতি-রাষ্ট্রই বিশ্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। যে সকল উপাদান একটি জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত করে সে সকল উপাদানকে জাতীয়তার উপাদান বলে। আর এ উপাদানগুলো জাতীয় জনসমাজকে জাতি গঠনে সহায়তা করে। যে কোনো সমাজে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে দ্বিবিধ উপাদানের সংমিশ্রণে। যেমন- ভাবগত উপাদান ও বাহ্যিক উপাদান। এ সম্পর্কে নিচে সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো:

১. ভৌগোলিক ঐক্য (Geographical unity): জাতীয়তাবাদের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো ভৌগোলিক ঐক্য। কোনো একটি সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডে একটি জনসমষ্টি যদি দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করে তবে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ভাবের আদান-প্রদান চলতে থাকে। এর ফলে ঐ জনসমাজের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঐক্যানুভূতি গড়ে ওঠে। জাতি গঠনের জন্য সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করা বাঞ্ছনীয়। কেননা, একই সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করার ফলে একটি জনসমাজ তার নিজস্ব অভ্যাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে; যা তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও প্রতিষ্ঠানের ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।

২. বংশগত ঐক্য (Racial unity): জাতি গঠনের একটি শক্তিশালী উপাদান হলো বংশগত ঐক্য। কোনো জনসমাজ যখন বিশ্বাস করে যে, তাদের শিরা-উপশিরায় একই রক্ত প্রবাহিত এবং তাদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অভিন্ন তখন স্বভাবতই তাদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি দেখা দেয়। রক্তের সম্পর্ক মানুষের মধ্যে একাত্মতার ভাব গড়ে তোলে যা গভীর জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করে। তবে জাতি গঠনের জন্য এ উপাদানটি একান্ত আবশ্যক নয় বলে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেছেন। তাদের যুক্তি হলো একই বংশোদ্ভূত হয়েও অনেকেই জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। যেমন-আরবের লোকেরা একই বংশোদ্ভূত। কিন্তু তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। আবার জার্মান, ইংরেজ একই বংশোদ্ভূত হয়েও তারা স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধের অনুসারী।

৩. ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য (Unity of language, literature & culture): মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। তাই ভাষার মাধ্যমে একটি জনসমাজের মধ্যে একাত্মবোধ গড়ে ওঠে। ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য বিভিন্ন বংশোদ্ভূত জনগণের মধ্যে একাত্মতার ভাব জাগ্রত করে। যেমন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অত্যধিক। তবে ভাষাগত ভিন্নতা জাতি গঠনের প্রতিবন্ধক নয়। কারণ, সুইজারল্যান্ডের জনগণ তিনটি ভাষায় কথা বলে, রাশিয়ার জনগণ পাঁচটি এবং চীনে বহুভাষা প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পেরেছে। অপরদিকে, আরবীয়দের ভাষা আরবি হওয়া সত্ত্বেও তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারেনি।'

৪. ঐতিহ্যগত ঐক্য (Cultural unity): প্রচলিত রীতিনীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত ঐক্যও জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘদিন একটি ভূখণ্ডে বসবাস করলে জনসমাজের মধ্যে ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের ফলে ঐতিহ্যগত ঐক্য গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নস (Burns)-এর মতে, "রক্তের অভিন্নতা অপেক্ষা একটি যৌথ স্মৃতি একটি যৌথ আদর্শ জাতি গঠনে অধিকতর সহায়তা করে।" তবে রামজে মুর (Ramsay Muir) এবং রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জে. এস. মিল (J. S. Mill) ঐতিহ্যগত উপাদানকে জাতি গঠনের জন্য অনাবশ্যক বলে মনে করেন।

৫ . ধর্মীয় ঐক্য (Religious unity): অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাতি গঠনে ধর্মের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। কারণ দেখা গেছে সমধর্মাবলম্বীদের মাঝে সহজেই ভাবগত বা মানবিক ঐক্য গড়ে ওঠে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজনীতি বিশ্লেষণে এর নজির পাওয়া যায়। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট মনে করেন, "ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য যেখানে প্রবল, সেখানে জাতিগত ঐক্য ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য।" তবে এ ধরনের ঐক্য সবসময় সফল হয় না। যেমন- ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম জাতি হিসেবে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে তা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে।

৬. রাষ্ট্রীয় সংগঠন (Political organisation): দীর্ঘদিন ধরে কোনো জনসমষ্টি একই শাসনব্যবস্থার অধীনে বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে ভিন্নতা ক্রমান্বয়ে লোপ পায় এবং ঐক্যবোধ সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৩টি কলোনি তাদের প্রাচীন সত্তা জার্মান, ইংরেজ, পোলিশ ইত্যাদি হারিয়ে আজ আমেরিকান জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করেছে।

৭. অর্থনৈতিক ঐক্য (Economic unity): অর্থনৈতিক বন্ধনও জাতীয়তাবাদের একটি অন্যতম উপাদান। অর্থনৈতিক, সমস্বার্থ জনসমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক সমস্বার্থের মাধ্যমেই কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ঐক্যের পরিবেশ গড়ে ওঠে। যেমন- বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তির শাসনাধীনে থাকা উপনিবেশগুলো অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে। মানুষ সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনে লিপ্ত হয় এবং সাম্যভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজে বসবাসে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

৮. মানসিক ভাবগত ঐক্য (Spiritual unity): ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনান (Renan)-এর মতে, "জাতীয়তার ধারণা মূলত ভাবগত। জনসমাজের মধ্যে মনোগত একাত্মবোধের অস্তিত্ব জাতীয়তার অপরিহার্য উপাদান।" একই ধরনের ভাবধারা, প্রবৃত্তি, সংস্কৃতি, ধর্ম, কামনা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক প্রবল মানসিক ঐক্যের সৃষ্টি করে। এই একাত্মতাবোধ, মানসিক বন্ধন জনগোষ্ঠীকে অপরাপর জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের আলাদা করে ভাবতে শেখায়। যেমন- অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) মন্তব্য করেন, "ব্যাপক অর্থে জাতীয়তার ধারণা এক প্রকার মানসিক ব্যাপার।"

৯. অভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা (Homogenate aspiration): কোনো জনসমষ্টির মধ্যে যখন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ে অভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার ভাব প্রবলভাবে নাড়া দেয়, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবাদ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।

জাতি গঠনে ওপরে বর্ণিত উপাদানগুলোর অবদান রয়েছে সত্য, কিন্তু এককভাবে কোনো উপাদানই জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য নয়। তবে মানসিক ভাবগত উপাদানই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। জাতি গঠনের জন্য মানসিক ভাবগত ঐক্য একান্তভাবে প্রয়োজন। ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, অর্থনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে এই ভাবগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ভাবগত ঐক্য কোনো জনগোষ্ঠীর মানসিক অবস্থাকে প্রতিফলিত করে।

পরিশেষে, উপর্যুক্ত আলোচনার সারবত্তা হিসেবে বলা যায় যে, জাতি বা জাতীয়তার উপাদান একক নয় বরং বহুবিধ। একটি পরিপূর্ণ, অর্থবহ, সমৃদ্ধশীল এবং সুশৃঙ্খল জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন সকল উপাদানের সমন্বয় সাধন।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ