- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
দেশপ্রেম ও জাতীয়তা
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
দেশপ্রেম ও জাতীয়তা
জাতীয়তাবাদ কি আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি Is Nationalism Antithetical to Internationalism
জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাজনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে পরিগণিত। জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভবের সাথে সাথে জাতীয়তাবাদ বিশ্ব ইতিহাসকে নব খাতে প্রবাহিত করেছে। ছোট-বড় সকল দেশ ও রাষ্ট্রে জাতীয়তাবোধকে সামাজিক মানুষ ও নাগরিকের প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে নির্দেশ করা হয়। জাতীয়তাবাদ একটি জাতির মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকতা বিশ্ববাসীর মধ্যে একাত্মতা ও মিলনের চেতনাকে জাগ্রত করে বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করে। সুতরাং জাতীয়তাবাদই হলো আন্তর্জাতিকতাবাদের পথে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কিন্তু অনেকেই বলেন জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি। সুতরাং জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রশ্ন একটি বিতর্কিত প্রশ্ন।
জাতীয়তাবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ Nationalism (Nationality) ল্যাটিন শব্দ Natio and Natus থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। Natio and Natus অর্থ Birth বা জন্ম। জাতীয়তাবোধ থেকে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি। জাতীয়তাবোধ জাতীয় কৃষ্টির সাথে একাত্ম হয়ে জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদ মূলত মানসিক অবস্থা এবং এক ধরনের চেতনা। জাতীয় জনসমাজের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে জাতীয়তাবাদ মূর্তরূপ লাভ করে।
আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে বলা হয় যে, বর্তমান বিশ্বে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বৃহৎ শক্তিবর্গের কর্ণধারগণ পর্যন্ত সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে যে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সুসম্পর্ক গড়ে তোলাই প্রত্যেকের প্রধান দায়িত্ব। আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বের সকল জনগণকে ঐক্য ও মিলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে জাতীয়তাবাদের উর্ধ্বে সকল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে। গোল্ড স্মিথ (Gold smith) বলেন, "ব্যক্তি কেবল তার রাষ্ট্রের সদস্যই নয়; বরং বিশ্বের নাগরিক- এ অনুভূতিই আন্তর্জাতিকতাবাদ।"
বর্তমান বিশ্বের জাতিগুলো নিজেদের পৃথক পৃথক জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে বিশ্বের কল্যাণ ও শান্তির লক্ষ্যে অন্যান্য জাতির সাথে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
আপাতদৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে কোনো বিরোধ বা সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দার্শনিক মহলের অনেকেই এ দুটি আদর্শের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলে থাকেন। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির অন্তরায়। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি। এ প্রশ্নের জবাবে একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং উপযুক্ত যুক্তি দাঁড় করেছেন। আবার একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিপক্ষে। অবস্থান নিয়ে শক্তিশালী যুক্তি দেখিয়েছেন।
সপক্ষে যুক্তি:
প্রথমত, জাতীয়তাবাদ এমন একটি আদর্শ যা একটি জনসমষ্টিকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পরিমণ্ডলে আবদ্ধ করে এবং অন্যদের থেকে নিজেদের পৃথক মনে করে। জাতীয়তাবাদের প্রভাবে পৃথিবীর বিপুল জনসমষ্টি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে স্বতন্ত্র এলাকা গড়ে তোলে, যাকে বলা হয় জাতি। আর আন্তর্জাতিকতাবাদ কোনো স্বাধীন সার্বভৌম জনসমষ্টিকে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বের জনসমষ্টির সাথে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে বিশ্বশান্তি ও শৃঙ্খলা বিধানে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে উভয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদ সকল প্রকার আন্তর্জাতিক বিবাদের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার মাধ্যমে জাতিতে জাতিতে শান্তি ও সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রয়াসী। জাতীয়তাবাদ জাতীয় গৌরব গাঁথা ধরে রাখতে সচেষ্ট। আর আন্তর্জাতিকতাবাদ সকল জাতির আপন বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে। সুতরাং বলা যায় আন্তর্জাতিকতাবাদে জাতীয়তাবাদ লয় হয় না বরং সম্প্রসারণ ঘটে।
তৃতীয়ত, বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতার যুগ। বিশ্ববাসী আজ আঞ্চলিক জোটবদ্ধ যা আন্তর্জাতিক জোট। এ জোটবদ্ধতার উদ্দেশ্য হলো জাতীয়তাবাদকে সংরক্ষণ করে আন্তর্জাতিক হওয়া। মানুষের জীবন, সম্পত্তি, ধর্ম ইত্যাদির উন্নতির পূর্বশর্ত হলো শান্তি ও সুস্থিতি। তাই জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ শান্তির অন্বেষায় সহযাত্রী।
বিপক্ষে যুক্তি:
অনেকেই মনে করেন জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। যার দৃষ্টান্ত পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদের নগ্ন বহিঃপ্রকাশের কারণ। আগামী বিশ্ব হয়তো আরও একটি তৃতীয় মহাসমরের অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছে।
প্রথমত, জাতীয়তাবাদের চরম ধারণা আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী হিসেবে গণ্য। জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ ধারণা এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের বিভেদকে বাড়িয়ে তুলেছে। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহ পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের মধ্যে দুর্ভেদ্য ঐক্য গড়ে তুলছে, অন্যদিকে অপর রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিচ্ছে। শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব থেকে এ চরমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। ফলে জাতিতে জাতিতে অবিশ্বাস বেড়ে চলেছে।
দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটার ফলে বিশ্ব পর পর দুটি মহাযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যুদ্ধের ফলে বিশ্বশান্তি ধূলিসাৎ হওয়া সত্ত্বেও বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজেদের মধ্যে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। মাঝে মাঝে বৃহৎ শক্তিগুলো (Super-power) বিশ্বশান্তির বুলি আওড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রকে মারণাস্ত্রের উৎপাদন ও প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। অথচ নিজেরা সেগুলো অবলীলায় করে যাচ্ছে। সুতরাং এরূপ অবস্থায় জাতীয়তাবাদের আদর্শ কখনোই আন্তর্জাতিক শান্তি বয়ে আনতে পারে না।
উপর্যুক্ত বিশদ আলোচনার নিরিখে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ নিজ নিজ রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়। আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদের উর্ধ্বে উঠে সকল জাতির সাথে ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করে বিশ্বশান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ যখন চরম আকার ধারণ করে এবং সম্প্রসারণবাদী হয়ে ওঠে তখন আন্তর্জাতিকতাবাদের বিপরীতে চলে যায়- বিশ্ব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ