• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি

জনসেবা ও আমলাতন্ত্র

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

জনসেবা ও আমলাতন্ত্র

আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ও কার্যাবলি Role and Functions of Bureaucracy

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ নির্বাচন শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের পর সরকারি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এককভাবে মন্ত্রিপরিষদের দ্বারা সম্ভব নয়। এজন্য আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে এইচ. ফাইনার (Prof. H. Finer)-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্র ব্যতীত রাষ্ট্রের বহুমুখী কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না বিধায় অনেকেই একে দেশের প্রকৃত শাসক বলে গণ্য করেছেন। এজন্য তত্ত্বসর্বস্ব হলেও আমলাগণ মন্ত্রীদের পরামর্শদাতা। যেমন- রবসন বলেন, "The civil service is entitle to advice, to warn, to encourage and to explain and no more." আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র জনকল্যাণমূলকসহ ল্যাণমূলকসহ বহুমুখী কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। নিম্নে এ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো:

১. সরকারি নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা: সহায়তা: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তত্ত্বগতভাবে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সার্বিক দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ, ক্যাবিনেট কিংবা শাসন বিভাগের। কিন্তু বাস্তবে মন্ত্রীদের অদক্ষতা ও কারিগরি প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে আমলাতন্ত্র সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। করেন।

২. গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন আমলাগণ সরকারি নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন এবং তার বাস্তবায়নও তাদের দ্বারা হয়ে থাকে। তবে আমলাদের বিভাগীয় মনোভাব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, লালফিতার দৌরাত্ম্য, রুটিনমাফিক কাজ, গণবিচ্ছিন্ন চরিত্র প্রভৃতি কারণে এ নীতির বাস্তবায়ন অনেকটা অসম্ভব হয়ে ওঠে।

৩. আইন প্রণয়নে সহায়তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাদের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত (Delegated legislation) আইন প্রণয়ন করেন। বর্তমানকালে জটিল সমাজ ব্যবস্থার ফলে আইন প্রণয়নগত, কৌশলগত জ্ঞান রাজনৈতিক প্রশাসকদের যথেষ্ট না থাকায় আমলাদের উপরই এ গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়।

৪. বিচার সংক্রান্ত ভূমিকা: বর্তমানকালে আমলাদেরকে বিচার সংক্রান্ত কাজও সম্পাদন করতে হয়। অনেক রাষ্ট্রেই এখন আদালতের পরিবর্তে কোনো কোনো বিবাদ বিসংবাদের মীমাংসা প্রশাসনিক সংস্থায় করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, Industrial Tribunal and Rent Controller India প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ সম্পর্কে এইচ. জে. লাস্কি (H. J. Laski) বলেন, "প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ যে কেবল বিচারকার্য সম্পাদন করেছেন তাই নয়, তাদের বিচারের রায় আদালতের পুনর্বিবেচনার এখতিয়ারের বাইরে।"

৫. প্রশাসনিক ভূমিকা: আমলাদের প্রধান কাজ হলো প্রশাসন পরিচালনা করা। একজন বিভাগীয় প্রধানের সাথে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সহকারী সচিব এবং আরও অসংখ্য কর্মচারী বিভাগের দায়িত্বে থাকেন। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আবির্ভাবের ফলে এসব কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

৬. পরামর্শদান সংক্রান্ত ভূমিকা: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভার সদস্যগণ আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ জ্ঞান ও কলাকৌশল সম্পর্কে অনভিজ্ঞ থাকার ফলে তারা আমলাদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। এছাড়া আইনসভায় মন্ত্রীদেরকে যে সমস্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তার সঠিক উত্তরও আমলাগণ পূর্ব থেকেই মন্ত্রীদেরকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেন।

৭. সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ আমলাগণ সংবাদ ও তথ্য সরবরাহের অন্যতম মাধ্যম। সাংবাদিক, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী এবং সাধারণ জনগণ সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ ও তথ্যের জন্য আমলাদের উপর, নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এছাড়া আইন ও শাসন বিভাগের বিভিন্ন আইন আমলাদের প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত হয়।

৮. অভ্যন্তরীণ প্রশাসন পরিচালনা: আমলাগণ অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের সুষ্ঠু পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উচ্চ পর্যায়ের আমলাগণ অধস্তন আমলাদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির মাধ্যমে শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। তাছাড়া ঊর্ধ্বতন আমলাগণ অধস্তনদের কার্যের অগ্রগতি সম্পর্কে সাময়িক বা বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন প্রেরণ করেন।

৯. প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা রক্ষা আমলাগণ সরকারের প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সরকারের পরিবর্তন হলেও আমলাগণ স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। এতে সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পন্ন হয় এবং প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

১০. শাসক-শাসিতের মধ্যে সংযোগ সাধন সামাজিক অগ্রগতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শাসক ও শাসিতের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা একান্তই অপরিহার্য। আমলাগণ সরকারের কার্যাবলির গুণাগুণ জনস গুণাগুণ। জনসম্মুখে তুলে ধরেন এবং তার মাধ্যমে রাজনীতিবিদগণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন।

১১. রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা দক্ষ, অভিজ্ঞ প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নিজ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ উপলক্ষে তারা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিলিত হন এবং উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়' সম্পর্কে সমঝোতা স্বাক্ষর করেন।

১২. উন্নয়নমূলক কার্য: আধুনিকীকরণের দিকে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে সকল সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, আমলাগণ সে সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ। সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য শিল্প, কৃষ্টি, যোগাযোগ, শিক্ষা প্রভৃতি প্রসারের ক্ষেত্রে বর্তমানে আমলাগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন।

১৩. সামাজিক পরিবর্তন কার্যকরণে আধুনিককালে গণতান্ত্রিক সরকারের (Democratic Government) সাফল্য পরিবর্তনশীল সামাজিক, অর্থনৈতিক চাহিদা উপলব্ধি ও তা মেটানোর উপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে আমলাগণ রাজনীতি নিরপেক্ষ ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা-অভিজ্ঞতার যোগান দিয়ে সামাজিক পরিবর্তন কার্যকর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৪. চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সংক্রান্ত ভূমিকা বর্তমানকালে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি অনেক স্বার্থকামী গোষ্ঠী তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। আমলাগণ তাদের দাবিদাওয়া শোনেন এবং তা সরকারের সামনে তুলে ধরে সমাধানের চেষ্টা করেন।

১৫. বিবিধ: এছাড়াও আমলাতন্ত্র যে সকল গুরুদায়িত্ব পালন করে সেগুলো হলো- স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ভূমিকা পালন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার দেখাশুনা ও তদারকি, উচ্চ পর্যায়ের আমলাগণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সভাপতি/প্রধান অতিথির পদ অলঙকৃত করেন ইত্যাদি। মোটকথা আমলাতন্ত্রের কার্যের পরিধি ব্যাপক ও সুবিস্তৃত। এ সম্পর্কে সি. জে. ফ্রেডারিক বলেন, "হাজার হাজার কর্মচারীসহ আধুনিক রাষ্ট্রের বিশাল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো তাদের আধুনিক সরকারের মূল অংশে পরিণত করেছে।"

পরিশেষে উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে প্রতীয়মান হয় যে, আধুনিককালে রাষ্ট্রিক কার্যাবলি ক্রমশ বৃদ্ধির সাথে সাথে আমলাতন্ত্রের ভূমিকাও অধিকতর গুরুত্ব বহন করছে। তবে আজকাল আমলাতন্ত্রের কতিপয় মারাত্মক ত্রুটি এ গুরুত্বকে ম্লান করে দিয়েছে। যেমন- জনস্বার্থ, সম্পর্কে উদাসীনতা, দীর্ঘসূত্রিতা বা লালফিতার দৌরাত্ম্য, বিভাগীয় মনোভাব, রুটিনমাফিক কাজ প্রভৃতি। প্রশাসনকে আরও গণমুখী করে তোলার জন্য আমলাতন্ত্রের এসব দোষত্রুটি পরিহার করতে হবে। আমলাতন্ত্রকে আরও দক্ষতা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ