- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
জনসেবা ও আমলাতন্ত্র
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
জনসেবা ও আমলাতন্ত্র
আমলাতন্ত্রের ত্রুটি/সমালোচনা Demerits of Bureaucracy/Criticism
আধুনিককালে প্রতিটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই আমলাতন্ত্র একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেম তেমনি এর কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। নিচে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
১. জনস্বার্থের প্রতি উদাসীনতা সরকারি প্রশাসনে আমলাতন্ত্র আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে একথা সত্য, কিন্তু আমলারা প্রশাসনকে নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে নিজেদেরকে স্বতন্ত্রভাবে এবং নিজের বৈষয়িক উন্নতির দিকে বেশি মনোনিবেশ করে। ফলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয়। জনগণের অভাব-অভিযোগ এবং তাদের মতামতের প্রতি উদাসীন থাকে।
২. লালফিতার দৌরাত্ম্য আমলাতন্ত্রের একটি মারাত্মক ত্রুটি হলো লালফিতার দৌরাত্ম্য। লালফিতার দৌরাত্ম্য বলতে আমলাতন্ত্রের অনাধুনিকতা, দীর্ঘসূত্রিতা, নিয়মকানুনের কড়াকড়ি বোঝানো হয়। আমলারা আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি বহির্ভূত কোনো কাজ করতে চান না। ফলে তাদের কাজকর্মের মধ্যে দীর্ঘসূত্রিতা প্রবল হয়ে ওঠে। যেকোনো কাজের ফাইলপত্র পর্যায়ক্রমিক অধস্তন থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টেবিল ঘুরে চূড়ান্ত পর্যায়ে কাজটি আলোর মুখ দেখে। তবে ততক্ষণে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। এরূপ অযথা বিলম্বিত হওয়ার কারণে অর্থাৎ লালফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে আমলাদের কাজকর্মে গতি আসে না।
৩. বিভাগীয় মনোভাব: আমলাতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক একটি ত্রুটি হলো বিভাগীয় মনোভাব। আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে সরকারের কর্মকাণ্ড বিভিন্ন বিভাগ বা দপ্তরের মধ্যে বণ্টন করা হয়। আন্তঃবিভাগীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে সামঞ্জস্যের ব্যাপারে বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে আন্তঃবিভাগীয় বিরোধ সৃষ্টি হয়। এতে আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতার পরিবর্তে আন্তঃবিভাগীয় প্রতিযোগিতাই প্রাধান্য পায়। সর্বোপরি স্ট্রাউস (Strauss)-এর মতে, "বিভাগীয় মনোভাব আমলাতন্ত্রের প্রধান ত্রুটি।"
৪. রক্ষণশীলতা: আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের অভিযোগ হচ্ছে এরা রক্ষণশীলতার ধারক ও বাহক। আমলাদের মধ্যে প্রথা বা রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। ফলে আমলাদের মধ্যে পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি তেমন প্রত্যক্ষ করা যায় না। তারা গতানুগতিক ধারায় রুটিন মাফিক কাজ করতে অভ্যস্ত। প্রচলিত ধারার বাইরে সৃজনশীল কাজকর্মের প্রতি তেমন আগ্রহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয় না।
৫. দায়িত্বহীনতা: আমলাদের মধ্যে দায়িত্বহীনতার প্রবণতাও লক্ষণীয়। সরকারি কর্মকাণ্ডের ত্রুটি-বিচ্যুতির দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য একজন অন্য জনের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। এতে আমলাদের মধ্যে কর্মপ্রচেষ্টার অবনতি দেখা দেয়।
৬. ক্ষমতালিপ্সা: আমলাতন্ত্রের আর একটি বড় ধরনের ত্রুটি হলো ক্ষমতালিপ্সা। আইন ও বিচারবিষয়ক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফলে আমলাদের প্রতি জনগণের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তাছাড়া আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে।
৭. বিচ্ছিন্নতা: স্ট্রাউস (Strauss) মনে করেন যে, আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে এমন অনেক পদাধিকারী আছেন যারা বহির্জগতের সাথে সম্পর্ক রহিত করে সাধারণ জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। বিশেষ করে উচ্চপদধারী আমলারা আদব-কায়দা, ভাব-ভঙ্গী ইত্যাদি স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেন। এভাবে তারা নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র জগৎ গড়ে তোলেন। এতে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কালক্রমে সরকার বিরোধী পরিস্থিতিতে পরিণত হয়।
৮. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি আজকাল আমলাতন্ত্রের বড় রকমের কুফল হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমলারা অনেক সময়ে মহল বিশেষের নিকট আর্থিকসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে জনস্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। আমলাগণ অনেক সময় তাদের আত্মীয়স্বজনদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন যা আদৌ ঠিক নয়।
৯. জনকল্যাণের পরিপন্থি: উন্নয়নশীল দেশসমূহে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনকল্যাণ সাধনের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভূত হলেও অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্রের জন্য তা বহুলাংশে ব্যাহত হয়। ক্ষমতার মোহ ও ক্ষমতার বিস্তার উচ্চপদস্থ আমলারা জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করেন। আর এসব কারণেই আমলাতন্ত্র জনকল্যাণবিমুখ হিসেবে বিবেচিত হয়।
১০. নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপ নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকলেও বাস্তবে আমলারা নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে আমলাদের হাতেই নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা বর্তায়।
জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস (Karl Marx) আমলাতন্ত্রের যেসব ত্রুটি উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে অন্যতম হলো-(১) আমলাতান্ত্রিক সমাজের প্রাধান্যকারী গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে (২) আমলাতন্ত্র হলো রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক শক্তি। এই শক্তি রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিকতায় পর্যবসিত হয় এবং আমলাতন্ত্র মূলত কাল্পনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলে।
পরিশেষে উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমলাতন্ত্র উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য হলেও উল্লিখিত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। আর এজন্যই প্রয়োজন দেখা দেয় অতিমাত্রায় বিকাশমান আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ