• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি

জনসেবা ও আমলাতন্ত্র

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

জনসেবা ও আমলাতন্ত্র

 আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের উপায় বা পদ্ধতি Means to Control of Bureaucracy

আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) আধুনিক শাসন ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি অপরিহার্য সংগঠন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের বহুমুখী কার্যাবলির সিংহভাগ সম্পাদিত হয় আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার উৎপত্তির সাথে সাথে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে জেমস কোরি (J. Corry) বলেন, "This has led some observers to say that the civil servants are the real governors of the country." কিন্তু আমলাতন্ত্রের এ ব্যাপক ভূমিকা পালনের পশ্চাতে কিছু দোষত্রুটি গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। Richard Crossman বলেন, "অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ।" ("An uncontrolled Bureaucracy is a threat to democracy.")

আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা গণতন্ত্র বলতে দেশের আপামর জনসাধারণ কর্তৃক শাসিত সরকার ব্যবস্থাকে বোঝায়। তবে আধুনিককালে বিশাল আয়তন রাষ্ট্র আর বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত হওয়ার দরুন প্রত্যেকের পক্ষে সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এজন্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজেদেরকে শাসনকার্যে অংশগ্রহণের পথ সুগম করে। সে সূত্রে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জনগণ শাসিত হওয়ার কথা থাকলেও আমলাগণ তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সুবাদে জনপ্রতিনিধিদের উপর প্রভাব বিস্তার করে প্রকৃত শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাই আমলাতন্ত্রের

নিয়ন্ত্রণ একান্তই প্রয়োজন। আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে অ্যালান আর, বল (Alan R. Ball) বলেন, "The need for controlling bureaucratic discretion and power is apparent in every political system," জনৈক লেখক মন্তব্য করেন, "Bureaucracy is like fire invaluable as a servant, ruinous when it becomes it master."

আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি/উপায়সমূহ: অ্যালান আর, বল (Alan R. Ball) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "Modern Politics and Government"-এর মধ্যে আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের কতিপয় পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। নিচে এ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো:

১. অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ (Internal Control): আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হলো Internal Control তথা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ। একে Administrative self regulation বলেও গণ্য করা হয়। এ পদ্ধতি মূলত প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে কার্যকর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। আমলাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক অবস্থানের উপর এ পদ্ধতি সর্বোতভাবে। নির্ভরশীল। সমস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীদের সংখ্যা, পদোন্নতি, বেতন-ভাতা ইত্যাদি অর্থবিভাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া কর্মচারীদের কর্তব্যে অবহেলা, জনস্বার্থ বিরোধী কাজ প্রভৃতি কারণে তাদের যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থার মাধ্যমেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

২. রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ (Political control): রাজনৈতিকভাবেও আমলাদের অনিয়ন্ত্রিত কাজকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বলতে সরকারের আইনসভা, মন্ত্রিপরিষদ, রাজনৈতিক দল (Political party) এবং স্বার্থকামী গোষ্ঠীর (Pressure group or interest group) মাধ্যমে গৃহীত ব্যবস্থাকে বোঝায়। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আমলাদের নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আইনসভার উপর ন্যস্ত। এ ব্যবস্থায় নিয়োগ, অনুমোদনের ক্ষমতা আইনসভার হাতে থাকলে নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Congress আমলাদের সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে ভারত ও ব্রিটেনে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া আমলাদের আইন পরিষদের

মাধ্যমে নিম্নোক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়-
(i) প্রশ্ন, অতিরিক্ত প্রশ্ন, প্রস্তাব আনয়ন ও স্থগিত প্রস্তাবের মাধ্যমে।
(ii) বাজেট আলোচনার মাধ্যমে।
(iii) বিশেষ অনুমোদন কমিটির মাধ্যমে।
(iv) প্রস্তাবিত নতুন আইন শুনানির মাধ্যমে।
(v) প্রচলিত আইনের সংশোধন, বার্ষিক বাজেট শুনানীর মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মাধ্যমে।

৩. আইনগত নিয়ন্ত্রণ (Legal Control): অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আমলাতন্ত্রের আইনগত নিয়ন্ত্রণকে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ বলে অভিহিত করেছেন। প্রশাসনের দুর্নীতি রোধ এবং নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আইনগত পদ্ধতির প্রয়োগ করা যায়। Quowaranto. Haveas corpus, Certionary. Mandamus, Injunction ও Prohibition-এ ছয়টি পদ্ধতিতে আদালত একে নিয়ন্ত্রণ করে।

অ্যালান আর. বল (Prof. Alan R. Ball)-এর মতে, "অনেক সময় দুর্নীতি ও নৈপুণ্যতার মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করা সম্ভব হয় না বলে সাধারণ আদালতের মাধ্যমে আমলাদের কৃতকর্মের বিচার করা সমীচীন নয়।" বাংলাদেশেও প্রশাসনিক কার্যাবলি তদারকীর জন্য সংবিধানের ৭৭ নং অনুচ্ছেদে Ombudsman বা ন্যায়পাল নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এ বিধান কেবল তত্ত্বসর্বস্ব, বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

৪. নাগরিক নিয়ন্ত্রণ (Citizen control): সরকারি কাজে নাগরিকদের অংশগ্রহণও আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। নাগরিকগণ যদি বেশি বেশি সরকারি কাজে অংশগ্রহণ করে তাহলে আমলাগণ কতটুকু সৎ ও কর্মনিষ্ঠ তা অবগত হওয়া যায়। এ পদ্ধতি নিম্নোক্তভাবে কার্যকর করা যেতে পারে:
(ক) নাগরিক উপদেশ প্রদানকারী কমিটির মাধ্যমে।
(খ) গতিশীল নীতি ও সুযোগ্য বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে।
(গ) বিভিন্ন বোর্ড এবং কমিশনের মাধ্যমে।
(ঘ) বিভিন্ন স্বার্থকামী (Pressure group) গোষ্ঠীর মাধ্যমে।

ডি. ই. এন. গ্লাডেন (D. E. N. Gladden)-এর মতে, আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী ও ফলপ্রসূ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিম্নরূপ:
(i) কার্যকরী বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ।
(ii) সুনেতৃত্ব এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ।
(iii) ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ।
(iv) কার্যকরী ও অতীব নমনীয় সংগঠন রীতির প্রয়োগ।
(v) ন্যায়সঙ্গত ও যথার্থ দক্ষ কর্মী ব্যবস্থার বাস্তবায়ন।
(vi) প্রশাসনিক পদ্ধতির গবেষণা এবং প্রশাসন সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্যের প্রচার ও বিশ্লেষণ ইত্যাদি।

পরিশেষে বলা যায়, আমলাতন্ত্র প্রশাসন-যন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ। তবে অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র দেশের গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও জনগণের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য আমলাতন্ত্রকে আরও গণমুখী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমলাতন্ত্রের তথাকথিত বাড়াবাড়ি রোধপূর্বক জনস্বার্থে তাদেরকে উদারনৈতিক ভূমিকা নিতে হবে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ