- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় (২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর)
১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের প্রথম দেশ। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা একদিকে সংকট নিরসনের নামে ঢাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল অন্যদিকে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আনা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়কে তারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। ৬ দফার প্রশ্নে মুজিবের অনড়-অনমনীয় অবস্থান তাদের বিচলিত করে। তখনই তারা উদ্ভূত সংকটের সামরিক সমাধানে মনস্থির করে ফেলে। আর আলাপ আলোচনার কথা বলে তারা ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময় নেয় এবং ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নির্বিচার আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করলে মধ্যরাতের কিছু পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরের শুরুতে (২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এজন্য ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে যাতে বিশ্ববাসী ঘোষণাটি বুঝতে পারেন।' বাণীটি নিম্নরূপ:
"This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have. to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on untill the last soldier of Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved."
expelled
স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ
"ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদারবাহিনীকে প্রতিরোধ কর। পাকিস্তানি দখলদারবাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।"
স্বাধীনতার এ ঘোষণা টিএন্ডটি ও ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) এর ওয়্যারলেস যোগে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে তিনি পৌঁছে দেন। ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটার সময় শ্রমিক নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে (আগ্রাবাদ) বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যাবেলা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার এই ঘোষণা পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর পরই বাংলার আপামর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে স্বাধীনতা ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্বতঃস্ফূর্ত প্রাথমিক প্রতিরোধ ও সংগঠিত প্রতিরোধ (The Spontaneous Early Resistance and Organized Resistance)
-১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে বাঙালি জনগণের ওপর আক্রমণ চালায়। পাশাপাশি তারা সামরিক বাহিনীর বাঙালি সেনা ও ই.পি.আর এবং পুলিশকেও নিরস্ত্র করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। এরূপ অবস্থায় : নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে পড়ে। রাজনৈতিকভাবে বাঙালি সৈনিকদের প্রতি সুস্পষ্ট পূর্ব নির্দেশনার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সামরিক, আধা-সামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা পক্ষ ত্যাগ করে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের সহযোগিতায় স্থানীয়ভাবে নিজ নিজ মতো করে সারা বাংলাদেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় বেসরকারি প্রশাসন এ ব্যাপারে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। এভাবে প্রতিরোধের ধারাবাহিকতায় সমগ্র জাতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথা অবাঙালিদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয় এবং ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী উপজাতিরাও এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। স্বতঃস্ফূর্ত প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল অসংগঠিত; উপস্থিত স্থানীয় নেতৃত্ব নির্ভর এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত একটি প্রবল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র জনতার আত্মরক্ষায় মরিয়া প্রয়াসজাত এক অসম লড়াই। অনিবার্যরূপে এ ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের এক খণ্ডিত পর্যায়। মূলত মুক্তিযুদ্ধে এ পর্যায়ের যুদ্ধগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন ও অপ্রস্তুত। অস্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ- এই দুই কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পরিকল্পিত রূপ পেতে জুন মাস পার হয়ে যায়। তারপরও এ স্বতঃস্ফূর্ত প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রতিরোধী শক্তির ত্যাগ, বীরত্ব ও অসমসাহসিকতার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শনাবলি গভীর প্রেরণার উৎস ছিল।
মুজিবনগর সরকার (Mujib Nagar Government)
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা "বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আদেশ" জারি করা হয়। এই ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর ওপর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিবৃন্দ, দেশি-বিদেশি বহুসংখ্যক সাংবাদিক, বিপুল সংখ্যক স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলী শপথ বাক্য পাঠ করান। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এ ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই ঘোষণা অনুযায়ী সরকারের নামকরণ করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় 'মুজিবনগর' এবং প্রতীকী অর্থে মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী রাজধানী। যদিও সরকারের প্রকৃত কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ সরকার মুজিবনগর সরকার নামেই পরিচিতি লাভ করে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের গঠন ছিল নিম্নরূপ-
রাষ্ট্রপতি | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান |
উপরাষ্ট্রপতি/অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি | সৈয়দ নজরুল ইসলাম |
প্রধানমন্ত্রী | তাজউদ্দিন আহমেদ |
পররাষ্ট্রমন্ত্রী | খন্দকার মোশতাক আহমদ |
অর্থমন্ত্রী | ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী |
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী | এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান |
প্রধান সেনাপতি | কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী |
চিফ অব স্টাফ | লে. কর্নেল (অব.) আব্দুর রব |
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ | গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার |
মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা কমিটি
মুজিবনগর সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয় (৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। কমিটিটি নিম্নরূপ:
আহ্বায়ক | তাজউদ্দীন আহমদ (মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি) |
সদস্য | মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী |
সদস্য | অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ (মস্কোপন্থি ন্যাপ-এর প্রতিনিধি) |
সদস্য | মনিসিংহ (কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি) |
সদস্য | মনোরঞ্জন ধর (কংগ্রেস দলের নেতা) |
সদস্য | ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (আওয়ামী লীগ দলের প্রতিনিধি) |
সদস্য | এএইচএম কামারুজ্জামান (আওয়ামী লীগ দলের প্রতিনিধি) |
সদস্য | খন্দকার মোশতাক আহমেদ (মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি) |
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আদেশ
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে অবস্থানরত ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য (এম.এন.এ.) ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যগণ (এম.পি.এ) এ সময়ে 'স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার' অর্থাৎ 'প্রবাসী সরকার (Government-in-Exile) গঠনের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর সেদিনই ঘোষণা করা হয় 'বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আদেশ' ও 'আইনের ধারাবাহিকতা বলবতকরণের আদেশ'।
১৯৭১ সালে ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (অনূদিত)
যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়,
এবং
যেহেতু, এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন,
এবং
যেহেতু, সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ তারিখে মিলিত হওয়ার জন্য আহ্বান করেন,
এবং
যেহেতু, এই আহূত পরিষদ সভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়,
এবং
যেহেতু, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সাথে আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে,
এবং
যেহেতু, এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জনগরে আতানিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান,
এবং
যেহেতু, একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনার পরিচালনা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ, অন্যান্যের মধ্যে, বাংলাদেশের বেসামরিকও নিরস্ত্র জনগণের উপর নজিরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অসংখ্য অপরাধ সংঘটন করিয়াছে এবং এখনও অনবরত করিয়া চলিতেছে,
এবং
যেহেতু, পাকিস্তান সরকার একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়া, গণহত্যা করিয়া এবং অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের পক্ষে একত্রিত হয়ে একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং নিজেদের মধ্যে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে,
এবং
যেতেহু, বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকত্ব ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদের প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা করে, এবং
বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানসিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতঃপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করলাম, এবং এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপ্রতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং তাঁর বিবেচনায় প্রয়োজনীয় অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী হবেন, কর আরোপ ও অর্থ ব্যয় ক্ষমতার অধিকারী হবেন, গণপরিষদ আহ্বান ও মূলতবীকরণ ক্ষমতার অধিকারী হবেন, এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সকল কার্য করতে পারবেন।
আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাঁর কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতির থাকবে এবং তিনি তা প্রয়োগ ও পালন করবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, জাতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আমাদের উপর যে দায় ও দায়িত্ব বর্তাবে তা পালন ও বাস্তবায়ন করার এবং জাতিসংঘের সনদ মানিয়া চলার প্রতিশ্রুতি আমরা দিচ্ছি।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হয়েছে বলিয়া গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, এই দলিল কার্যকর করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে আমাদের যথাযথ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করলাম।
অধ্যাপক ইউসুফ আলী
বাংলাদেশের গণপরিষদের ক্ষমতাবলে ও
তদধীনে যথাযথভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি।
আইনের ধারাবাহিকতা বলব বলবৎকরণের আদে
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে 'আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ' নামে একটি আদেশ জারি করেন। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে সমস্ত আইন চালু ছিল, তা রক্ষার্থে এ আদেশ জারি করা হয়। তবে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মূলত এ আদেশ কার্যকরী ও বলবৎ হয়। নিম্নে 'আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণের আদেশ' হুবহু তুলে ধরা হলো:
"আমি বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে আদেশ জারি করছি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে সমস্ত আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে। এ রাষ্ট্র গঠন বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায় হয়েছে। এক্ষণে সমস্ত সরকারি, সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়োগবিধির আওতায় যে শর্তে চাকরিতে বহাল ছিলেন সেই শর্তে তারা চাকরিতে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত সমস্ত জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সমস্ত কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা যারা অন্যত্র অবস্থান করছেন, তারা সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের স্ব স্ব এলাকায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।
এ আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।"
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
স্বাক্ষর
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
(এম. এন. এ.)
মুক্তিবাহিনী গঠন ও কার্যক্রম
সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে এবং প্রত্যেক সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশারফ এবং মেজর কে এম শফিউল্লাহ্ যথাক্রমে এক, দুই ও তিন নম্বর সেক্টর কমান্ডার এবং জেড, কে ও এস ফোর্স এর প্রধান ছিলেন। মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনীর সদস্যদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে স্থাপিত প্রশিক্ষণ শিবিরে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
মুক্তিবাহিনীর সেক্টরসমূহ ও সেক্টর প্রধানগণ:
সেক্টর | সেক্টর এলাকা | সেক্টর কমান্ডার |
১ | চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনী নদী পর্যন্ত | মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল-জুন) মেজর মোহাম্মদ রফিক (জুন-ডিসেম্বর) |
২ | নোয়াখালী, কুমিল্লার আখাউড়া হতে ভৈরব রেল লাইন পর্যন্ত এবং ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ। | মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) মেজর এ টি এম হায়দার (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) |
৩ | আখাউড়া, ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্ব দিকের কুমিল্লা জেলা, সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমা এবং ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমা ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ। | মেজর কে. এম সফিউল্লাহ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) মেজর নুরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) |
৪ | সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল, পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি রোড পর্যন্ত। | মেজর সি. আর দত্ত |
৫ | সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল, পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট-ডাউকি রোড হতে সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ রোড পর্যন্ত। | মেজর মীর শওকত আলী |
৬ | রংপুর জেলা এবং দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমা। | উইং কমান্ডার এম কে বাশার |
৭ | ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছাড়া দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা। | মেজর নাজমুল হক মেজর কাজী নুরুজ্জামান |
৮ | কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুরের অধিকাংশ ও খুলনার উত্তরাঞ্চল। | মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত) মেজর এম এ মঞ্জুর (আগস্ট-ডিসেম্বর) |
৯ | খুলনার দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা | মেজর এম এ জলিল (ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত) মেজর এম এ মঞ্জুর (ডিসেম্বরের শেষ কিছুদিন) |
১০ | অভ্যন্তরীণ নৌপথ, সমুদ্র উপকূল এবং চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর | হেডকোয়ার্টারের পরিচালনায় নৌ কমান্ডারবৃন্দ |
১১ | কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাড়া সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা ও টাঙ্গাইল | মেজর আবু তাহের (এপ্রিল-নভেম্বর) ফ্লাইট লে. এম হামিদুল্লাহ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) |
সূত্র: এম আর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি, অষ্টম মুদ্রণ, ঢাকা, বাংলা ১৩৯১, পৃ. পৃ. ২২-২৩
নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী মুক্তিবাহিনী সরকারি পর্যায়ে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ১. নিয়মিত বাহিনী ও ২. অনিয়মিত বাহিনী।
১. নিয়মিত বাহিনী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলোর বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গঠিত হয়। সরকারিভাবে এদের নামকরণ করা হয় এমএফ (মুক্তিফৌজ)। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার নিয়মিত বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী গড়ে তোলে।
২. অনিয়মিত বাহিনী ছাত্র, যুবক, কৃষক ও শ্রমিক সকল স্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে অনিয়মিত বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর সরকারি নামকরণ ছিল 'গণবাহিনী' বা 'এফ এফ' (ফ্রিডম ফাইটার বা মুক্তিযোদ্ধা)। তাদের নিজ নিজ এলাকায় গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য প্রেরণ করা হতো। এছাড়া ছাত্রলীগের বাছাইকৃত কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় 'মুজিব বাহিনী'। কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী) ও ছাত্র ইউনিয়নের আলাদা গেরিলা দল ছিল।
৩. আঞ্চলিক বাহিনী: সেক্টর এলাকার বাইরে অঞ্চলিক পর্যায়ে যেসব বাহিনী গড়ে ওঠে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাদেরিয়া বাহিনী (টাঙ্গাইল), আফসার ব্যাটালিয়ন (ভালুকা, ময়মনসিংহ), বাতেন বাহিনী (টাঙ্গাইল), হেমায়েত বাহিনী (গোপালগঞ্জ, বরিশাল), হালিম বাহিনী (মানিকগঞ্জ), আকবর বাহিনী (মাগুরা), আব্দুল লতিফ মীর্জা বাহিনী (সিরাজগঞ্জ, পাবনা) ও জিয়া বাহিনী (সুন্দরবন)। এছাড়া ছিল ঢাকার গেরিলা দল, যা 'ক্র্যাক প্লাটুন' নামে পরিচিত। ঢাকা শহরের বড় বড় স্থাপনা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হোটেল শেরাটন (বর্তমানে রূপসী বাংলা), ব্যাংক ও টেলিভিশন ভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ঢাকার গেরিলারা। এভাবে তারা পাকিস্তানি সেনা ও সরকারের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করে।
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী শক্তির তৎপরতা ও ভূমিকা |
এ সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে শান্তিকমিটি ও রাজাকার, আলবদর, আল শামস নামে কয়েকটি বিশেষ বাহিনী গড়ে ওঠে। এদের সীমাহীন অত্যাচারে বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও ডাক্তারকে ধরে নিয়ে যায় ও নৃশংসভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দখলদার পাকিস্তানিবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা করেছিল। দুই লাখের অধিক মা-বোন পাকিস্তানিদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে এ দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য পাকবাহিনী বরেণ্য সাহিত্যিক, শিল্পী, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। নির্যাতন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ইত্যাদি অপরাধ কর্মে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তথাকথিত শান্তিকমিটি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী এদেশীয় ব্যক্তিবর্গ এক কথায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত। প্রধানত জামায়াতে ইসলামি, মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলামি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) প্রভৃতি দলের সমর্থকরা মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করে। এই দলগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধেও অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছে। |
মুজিবনগর সরকারের পরিচালনায় চূড়ান্ত জয়ের লক্ষ্যে এমএ জি ওসমানীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাগণ মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালালে স্থানীয় জনসাধারণের সমর্থন না পাওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী এসময় নিরীহ জনগণের ওপর তাদের প্রতিহিংসা আরও বাড়িয়ে তোলে। সমগ্র বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার নেশায় তারা পাগল হয়ে ওঠে। ফলে প্রায় ১ কোটি মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। লক্ষ লক্ষ কিশোর-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এমনকি বাংলাদেশের ভেতরে এবং ঢাকা শহরেই শুরু হয় গেরিলা অপারেশন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জাতীয় সংগীত, সংবাদ বুলেটিন এবং চরমপত্র অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে আরও উদ্দীপ্ত করে তোলে।
এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানবাহিনী ও তাদের দোসরদের নিধনে তৎপর হয়ে ওঠে। গেরিলা যোদ্ধারা ঢাকায় আইয়ুব খানের বহু কুকর্মের দোসর মোনায়েম খানকে তার বাসভবনে হত্যা করে। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় দেশের অভ্যন্তরে নিরীহ জনগণকে বাঁচাতেও মুক্তিযোদ্ধারা সাহসী ভূমিকা পালন করে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বাঙালি জনগণের আস্থা ও সমর্থন ক্রমে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। ক্রমেই মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যন্ত এলাকাগুলো দখল করতে শুরু করে। উপায়ান্তর না দেখে পাকিস্তান সরকার এই মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্তে মেতে ওঠে।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাকিস্তান একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তা পারে নি। এর অনেক কারণও ছিল।
প্রথমত, বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বিপ্লবের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পেছনে ছিল জনগণের ম্যান্ডেট। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অথচ তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংকটের সামরিক সমাধানের পথ বেছে নেয়।
তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এরূপ অভিযোগ আনা সহজ ছিল না। তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন এ ধরনের একটি ধারণা পর্যবেক্ষক মহলে সঙ্গত কারণেই সৃষ্টি হয়। ২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লে কেবল তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
চতুর্থত, বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যায়। ভীত সন্ত্রস্ত ১ কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এই শরণার্থী সমস্যা শুধু ভারত নয়, বিশ্বের জন্যও একটি বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেশে-বিদেশে একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরূপ সাধারণ ধারণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খুবই সহায়ক হয়। সে কারণে বিশ্ব জনমত বিশেষ করে পশ্চিমের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের জনগণ, প্রচার মাধ্যম এবং অনেক সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। যুক্তরাজ্য বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রচারণায় হেড-কোয়াটার্স এ পরিণত হয়েছিল।
চূড়ান্ত বিজয় অর্জন
বাংলাদেশ ও ভারত সরকার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী বা 'যৌথকমান্ড' গঠন করলে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে যায়। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর এ যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে, জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে 'যৌথ কমান্ডের' অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়। যৌথ কমান্ডের প্রধান হন ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম ম্যানেকশ। ২১ নভেম্বর বয়রা এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর সাথে যৌথবাহিনীর যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৩টি ট্যাঙ্ক ও ৩টি স্যাবর জেট বিমান ধ্বংস হয়। এতে পাকিস্তান সরকার ২৩ নভেম্বর সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পর্যুদস্ত হতে থাকে।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান অতর্কিতে ভাতের বিমানঘাঁটি অমৃতসর, পাঠানকোট, আগ্রা ও শ্রীনগরের উপর বিমান হামলা চালায়। বাংলাদেশের অকুতোভয় বিমান সেনারা এদিন রাতেই চট্টগ্রামস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারি ডিপো এবং নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলস্থ জ্বালানি ডিপোতে সফল বিমান আক্রমণ চালায়। ভারতীয় জঙ্গি বিমান যৌথ বাহিনীকে পূর্ণ সহায়তা প্রদান শুরু করে। শুরু হয় জল-স্থল ও আকাশ পথে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের উপর যৌথ বাহিনীর ষাঁড়াশি আক্রমণ। এদিকে ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য পুনরায় ভারতকে আহ্বান জানান। এদিন ভুটান সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি প্রদান করে। এতে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরো বেড়ে যায়।
৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবকটি বিমান যৌথ বাহিনীর আক্রমণে বিশেষ করে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এদিন থেকে বাংলাদেশের আকাশ শত্রুমুক্ত হয়। এদিন ১২ ঘণ্টায় ভারতীয় বিমান বাহিনী ২৩২ বার বিমান অভিযানে ঢাকার তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে ৫০ টনের মতো বোমা নিক্ষেপ করে। এ দুটি বিমান ঘাঁটিতে রানওয়েতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয় এবং বিমান ঘাঁটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনীর ৯০টি গাড়ি, সেনা বোঝাই কয়েকটি লঞ্চ ও স্টিমারও ভারতীয় বিমান হামলায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নোঙর করা নিরপেক্ষ বিদেশি জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের আহ্বান জানায়। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ধারে পাওয়া পাকিস্তানের সাবমেরিন 'গাজী' যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে বঙ্গোপসাগরে ধ্বংস হয়ে যায়।
৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরো একটি কারণে স্মরণীয় দিন। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায় এবং অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরো বেড়ে যায়।
৭ ডিসেম্বর যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলের সবকটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হতে থাকে। ফলে পাকিস্তানি সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে তাদের ট্যাংক, কামান এবং ট্যাঙ্ক-জিপ, অন্যান্য যানবাহন ও যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে খুলনায় পালিয়ে যায়। এদিন মিত্র বাহিনীর ছত্রী সেনারা সিলেটের শালুটিকর বিমান বন্দরে অবতরণ করে। একই সাথে চতুর্দিক থেকে মিত্র বাহিনী সিলেটের পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়ে বিধ্বস্ত করে ফেলে। দুপুরের মধ্যেই সিলেট এলাকার পাকিস্তানি সেনা অধিনায়ক তাঁর অধীনস্থ সেনাদের নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
৮ ডিসেম্বর, যৌথবাহিনী কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট চারদিক থেকে অবরোধ করে ফেলে। ফলে তারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে ঢাকা বা চট্টগ্রাম কোনো দিকেই পালাতে পারছিল না। এ সময় 'যৌথ কমান্ডের' প্রধান জেনারেল ম্যানেকশ পাকিস্তানি সেনাদেরকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের আশ্বস্ত করেন যে, আত্মসমর্পণ করলে 'জেনেভা কনভেনশনের' নীতি অনুযায়ী তাঁদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা হবে।
৯ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাংলাদেশের সকল রণাঙ্গন থেকে যৌথবাহিনীর বিজয় ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় ও পশ্চাদপসারণের সংবাদ আসতে থাকে।
১০ ডিসেম্বর বিদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার বা দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়ার জন্য বিমান আক্রমণ বন্ধ রাখা হয়। এদিন ঢাকার কাছাকাছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় অবস্থান ভৈরব শহর যৌথবাহিনীর দখলে আসে।
১১ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরপুর পাকিস্তানি সেনাদের কবলমুক্ত করে। এদিন গভর্নর এ.এম. মালিক ও তার মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ প্রাণ ভয়ে ভীত হয়ে পদত্যাগ করেন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
১২ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানি শত্রু সেনাদের দখলমুক্ত হয়। ঢাকায়। অবস্থানরত বিদেশিরা তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানে কলকাতায় চলে যান। এদিন নব উদ্যমে মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো ঢাকার পাকিস্তানি সেনা অবস্থানগুলোর উপর মুহুর্মুহ বিমান হামলা চালাতে থাকে।
১৩ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল পাকিস্তানি সেনাদের দখলমুক্ত হয়। মিত্র বাহিনী দ্রুত বেগে ঢাকা শহরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এদিনও ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান লক্ষ করে মিত্র বাহিনীর বিমানগুলো সারাদিন বোমা বর্ষণ চালিয়ে যেতে থাকে। জেনারেল নিয়াজী ও অন্যান্য পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট সেনা ও অন্যান্য সাহায্য চেয়ে বারবার নিষ্ফল আবেদন জানাতে থাকে। ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তানি জেনারেলরা তখনও শেষ চেষ্টা চালিয়ে যান মার্কিন সপ্তম নৌবহর যেন বাংলাদেশে এসে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাদের মুক্ত করেন। কিন্তু মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানি সেনাদেরকে রক্ষা বা উদ্ধার করার জন্য আসেনি। ১৩ ডিসেম্বর 'এক দিকে চলছে কামানে-বিমানে তীব্র আক্রমণ, আর একদিকে বেতারে প্রচারিত হচ্ছে আত্মসমর্পণের আবেদন।
১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি দোসর আলবদর ও আলশামস নামক দুটি ঘাতক বাহিনী এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক-চিকিৎসক-লেখক-সাহিত্যিক-দেশপ্রেমিক-বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে নির্যাতন শেষে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে শুরু করে। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যেন মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী এদিন সব আশা ছেড়ে দিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এদিন ঢাকা শহরের মাত্র ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পৌছায় যৌথবাহিনী।
১৪ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক ও বাঙালি গভর্নর ডা. মালেক তাঁর মন্ত্রিসভা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পদত্যাগ করে রেডক্রসের নিয়ন্ত্রণাধীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উপায়ান্তর না দেখে ১৫ ডিসেম্বর লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ বাংলাদেশে যুদ্ধরত ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তা মিত্রবাহিনীকে জানিয়ে দেয়। ১৫ ডিসেম্বর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস মারফত লে. জেনারেল নিয়াজী প্রস্তাব পাঠান যে, তিনি শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণ করতে চান। তার দেওয়া প্রধান শর্ত হলো 'পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবাইকে নিজ দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং কাউকে গ্রেপ্তার করা চলবে না।' ভারত সরকার এবং সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিক সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে জানায় যে, 'বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তবে আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধবন্দীরা জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী ব্যবহার পাবে'। দিল্লির আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস মারফত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেনাধ্যক্ষ লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজীকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, 'আমাদের প্রস্তাব ভেবে দেখার জন্য আপনাকে ১৬ তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়।
১৬ ডিসেম্বর সকাল দশটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে অপেক্ষমাণ ভারতীয় মেজর জেনারেল গন্ধব নাগরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সকাল ১০.৪০ মিনিটে ঢাকা নগরীতে প্রবেশ করেন। মেজর জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভারতীয় লে. জেনারেল জ্যাকব হেলিকপ্টারে ঢাকায় পৌছান। জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী তাঁকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানান। আত্মসমর্পণের দলিল তৈরি হয়। বিকেল ৪টা নাগাদ সদলবলে ঢাকা পৌঁছান মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চল প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এদিন বিকেল ৪.২১ মিনিটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রসহ ঢাকার রমনার রেসকোর্স বা ঘোড়দৌড় ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন জোনেব তথা যৌথ বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। এভাবে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত, ২ লক্ষ ৭৫ হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম, দেশ বরেণ্য অনেক বুদ্ধিজীবীর নির্মম হত্যা এবং দেশের অবকাঠামোর এক ধ্বংসস্তূপের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত হয় জয় বাংলা, বাংলার জয়।
আত্মসমর্পণের দলিলটি ছিল নিম্নরূপ (অনূদিত):
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড পূর্ব রণক্ষেত্রে ভারতীয় এবং বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণে সম্মতি প্রদান করেছেন। এ আত্মসমর্পণে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সকল সদস্য, সকল আধাসামরিক এবং অসামরিক অস্ত্রধারী সৈনিক অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ সকল সৈন্যরা যে যেখানে যেভাবে আছেন সেভাবে অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন এবং তাদের নিকটস্থ জেনারেল অরোরার অধীনস্থ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করবেন। এ দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড জেনারেল অরোরার আদেশাধীনে ন্যস্ত হবে। তার আদেশের বরখেলাপ আত্মসমর্পণ চুক্তি ভঙ্গের সামিল হবে এবং যুদ্ধের সর্বগ্রাহ্য নিয়মাবলি ও বিধি অনুযায়ী অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ আত্মসমর্পণ চুক্তির ব্যাখ্যা সম্পর্কিত কোনো সন্দেহের উদ্ভব হলে লে. জেনারেল অরোরা এ মর্মে পবিত্র আশ্বাস প্রদান করেন যে, যাঁরা আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রতি জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী যোগ্য সম্মান ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। লে. জেনারেল অরোরার অধীনে সেনাবাহিনীর সাহায্যে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে।
স্বাক্ষর জগজিৎ সিং অরোরা লে. জেনারেল জি ও সি এবং পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ১৬.১২.১৯৭১ | স্বাক্ষর আবদুল্লা খান নিয়াজী লে. জেনারেল সামরিক আইন প্রশাসক, জোন-বি এবং পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের সর্বাধিনায়ক ১৬.১২.১৯৭১ |
আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন পরাজিত সেনানায়ক লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী এবং বিজয়ী সেনানায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর নায়ক কাদের সিদ্দিকী (বাঘা সিদ্দিকী)।
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা (Role of Mujib Nagar Government)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে। মুজিবনগর সরকার ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালের কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদেরকে নিয়ে গঠিত হয়। এ সরকার তার সকল স্তরের সদস্য নিয়ে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে মাত্র নয় মাসের মধ্যে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ।.
১. যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও ট্রেনিং প্রদান পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন দেশের অভ্যন্তরে ছাত্র যুবকদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছিল তখন 'মুজিবনগর সরকার' গঠিত হওয়ায় তারা আশার আলো দেখতে পায়। দলে দলে তারা ভারতে এবং বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। মুজিবনগর সরকার মুক্তাঞ্চলে এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থান করে। এখানে তাদেরকে সামরিক ট্রেনিং দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
২. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচার জনগণের মনোবল ঠিক রাখার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য 'মুজিবনগর সরকার' স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও পত্র-পত্রিকায় মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালায়। স্বাধীন বাংলা বেতারের দেশাত্মাবোধক গানগুলো এবং 'চরমপত্র' অনুষ্ঠানটি মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল।
৩. মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা: মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (মুক্তিবাহিনী) কয়েকটি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ঠিক রাখা এবং বিভিন্ন সেক্টর ও গেরিলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব মুজিবনগর সরকার নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিল।
৪. স্বাধীনতা বিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রান্ত প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধকে ন্যাসৎ করে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চালানো হয়েছিল। কিন্তু মুজিবনগর সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সুযোগ্য নেতৃত্ব সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়।
৫. বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা: 'মুজিবনগর সরকার' নানা প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও একটি বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তুলেছিল। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়।
৬. বহির্বিশ্বে প্রচার: মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, লক্ষ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হিংস্রতা ও গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর সাফল্য ইত্যাদি বহির্বিশ্বে প্রচার করে জনমত সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছিল।
'মুজিবনগর সরকার' মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ছাড়াও বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বহির্বিশ্বের সমর্থন ও জনমত আদারের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তদানীন্তন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে 'বিশেষ দূত' নিয়োগ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশে নাগরিক ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য দেশের সমর্থন আদায়ের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায়। আর এ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণেই কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপিত হয়। এরপর এসব মিশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিধি নিয়োগ করে প্রবাসী সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থণ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে প্রায় ৩৮ জন উচ্চপদস্থ বাঙঙ্গীল কর্মকর্তা পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। এসব কূটনীতিকদের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং বাংলাদেশ মিশনে যোগদান বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের তাৎপর্য (Significance of gaining independence of Bangladesh)
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শাসন ও শোষণের বেড়াজাল ছিন্ন করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ বাঙালিদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ অর্জন। তাই এ স্বাধীনতা লাভের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো:
১. বাংলাদেশের অভ্যুদয় লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা লালন করে আসছিল, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
২. শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণের অবসান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যাবতীয় শাসন-শোষণ, নির্যাতনের অবসান ঘটে। স্বাধীন ভূখণ্ডের নাগরিক হিসেবে বাঙালি জাতি নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অজর্নের পথে যাত্রা শুরু করে।
৩. মাথা উচু করে দাঁড়াবার গৌরব: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন ৫৫ হাজার বর্গমাইলের জনগোষ্ঠীকে আত্মপরিচয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি ও গৌরব এনে দিয়েছে। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পতাকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উড়ছে আপন মহিমায়।
৪. স্ব-শাসনের দিগন্ত উন্মোচন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দীর্ঘ ২৪ বছর স্বায়ত্তশাসনের জন্য, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বারবার সামরিক শাসনের বেড়াজালে পকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের সে দাবিকে উপেক্ষা করেছে। তাই স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে শাসকের নির্বাচনে, সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের সুযোগ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।
৫. বাঙালি নেতৃত্ব ও বীরত্ব গাঁথার স্বীকৃতি: মহান স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, সম্মান ও মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত হয়েছেন। বাঙালিদের দেশপ্রেম, বীরত্ব স্বীকৃত হয়েছে সর্বত্র।
৬. শহিদদের আত্মদানের মর্যাদা ও সফলতা লাভ: ত্রিশ লাখ শহিদ ও ২ লাখের অধিক মা-বোনের পবিত্র সম্ভ্রম এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ধ্বংস হয় বাড়িঘর, জনপদ, কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন শহিদদের আত্মদানকে যেমন অপরিসীম সম্মান, মর্যাদায় জাতিকে চিরঋণী করে রেখেছে; তেমনি মা-বোনের হারানো সম্ভ্রমকে দিয়েছে মর্যাদার এক পবিত্র আবরণ। জাতি চিরকাল তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।
৭. বিশ্ব শান্তি ও সংহতির বিজয় স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী, শান্তিপ্রিয় মানুষকে দিয়েছে। চিরকালের অনুপ্রেরণা। কোনো জাতির ঐক্যবদ্ধ ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম যে ব্যর্থ হয় না এ শিক্ষা বিশ্ব শান্তি ও সংহতিকেও জোরদার ও' বিজয়ী করেছে।।
সর্বশেষ আমরা বলতে পারি, বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা কোনোদিন ব্যর্থ হতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সে সত্যকে আরেকবার প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কাজে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নিরন্তর যেতে হবে বহুদূর।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ