• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ গণঅভ্যুত্থান পূর্ব বাংলার জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রুপ), জাতীয় ছাত্র-ফেডারেশনের দোলন গ্রুপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইয়ুব-বিরোধী মঞ্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এর সভাপতি নির্বাচিত হন ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও মাওলানা ভাসানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের কারণ

আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন দ্রুত গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এই গণআন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনায়েম খানের পতন ঘটে। তারা নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের অন্ধগলিতে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ছিল নিম্নরূপ:

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য: ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, চাকরি-বাকরি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এ বৈষম্যের হাত থেকে বাঁচতে এদেশের মানুষ গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়।

২. আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র: আইয়ুব খান পাকিস্তানের জনগণের সর্বজনীন ভোটাধিকারের পরিবর্তে ৮০,০০০ (আশি হাজার) মৌলিক গণতন্ত্রীর হাতে ভোটাধিকার অর্পণ করেন। এ আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী রাষ্ট্রপতি থেকে আইন পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করতেন। এছাড়াও তাদের হাতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো (ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা) পরিচালনার ক্ষমতাও প্রদান করা হয়। এসব মৌলিক গণতন্ত্রী অন্ধভাবে আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের দালালি করতেন। তাদের গণবিরোধী কার্যকলাপ জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

৩. সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাকিস্তানে আইয়ুব-মোনায়েম শাসনামলে 'সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এসব আমলাদের বিষাক্ত ছোবলে পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পর্যুদস্ত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা বিদ্রোহে ফেটে পড়ে, সূচিত হয় গণঅভ্যুত্থান।

৪. আগরতলা মামলার প্রভাব বাঙালিদের স্বার্থের আপোষহীন প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অপর ৩৪ জনের। বিরুদ্ধে আইয়ুব সরকারের, আগরতলা মামলা দায়ের এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার অনুষ্ঠান ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তোলে।

৫. সরকারে দমন নীতি: সমগ্র পাকিস্তানের জনগণ যখন গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার, পাকিস্তান সরকার তখন তা দমনের জন্য নৃশংস পুলিশী নির্যাতন চালাতে থাকে। নির্যাতন যতই বাড়তে থাকে সরকার বিরোধী আন্দোলন ততই তীব্র হতে থাকে।

৬. ব্যাপক দুর্নীতি: আইয়ুব খানের শাসনামলে সর্বত্রই দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। আমলা, সেনাবাহিনী ও মৌলিক গণতন্ত্রীদের এই দুর্নীতিতে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণ এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

৭. জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার প্রসার ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সৃষ্ট জাতীয়তাবাদী চেতনা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর আরও গতিশীল হয়ে ওঠে। ফলে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে বেগবান করে তোলে।

৮. ছয় দফা আন্দোলনের প্রভাব ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে অতি দ্রুত তা বাঙালির বাঁচার দাবি তথা মুক্তির সনদে পরিণত হয়। বাঙালি জনগণ স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তারই বিস্ফোরণ ঘটে।'

৯. স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি উপেক্ষা পাকিস্তানি শাসকচক্র পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ফলে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনকামী জনগণ ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকার বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

১০. ছাত্রসমাজের এগারো দফা ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এগারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে জনগণের ক্ষোভ গণবিক্ষোভে রূপান্তরিত হয়। এ বিক্ষোভ দমনে সরকার যতই নির্যাতন চালাতে থাকে, ততই আন্দোলনরত জনগণ মারমুখী হয়ে উঠতে থাকে। ফলে গণআন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল/গুরুত্ব

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ-

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিশেষ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ গণআন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুসংহত হয়ে ওঠে। বাঙালি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়।

২. স্বৈরাচার বিরোধী প্রবল মনোভাবের সৃষ্টি: এ গণআন্দোলনের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে স্বৈরাচার বিরোধী প্রবল মনোভাবের সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও স্বাধিকার প্রশ্নে জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

৩. গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান গণঅভ্যুত্থানের ফলে স্বৈরাচারী সরকার ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক ডাকতে বাধ্য হয়। এ গোলটেবিল বৈঠকে তিনটি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নেতৃবর্গ ঐকমত্যে পৌঁছেন। সেগুলো হলো- (১) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। (২) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হবে এবং (৩) মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রবর্তন করা হবে।

৪. আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও রাজবন্দিদের মুক্তি প্রদান: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

৫. আইয়ুব খানের পতন ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ জেনারেল আইয়ুব-মোনায়েম খানের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে। আইয়ুব খান উপায়ান্তর না দেখে ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

৬. অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু: ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। পূর্ব বাংলার জনগণ তার নেতৃত্বের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ও আস্থা জ্ঞাপন করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত শেখ মুজিবুর রহমানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তোফায়েল আহমেদ বাংলার জনগণের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করেন।

৭. মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে অভিন্ন জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রবলভাবে জাগ্রত হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনীতির প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

৮. আওয়ামী লীগের বিজয়: ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের বিজয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ