• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ

অসহযোগ আন্দোলন (২-২৫ মার্চ, ১৯৭১)

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগ্রামের মহানায়ক। ১৯৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাঁর নেতৃত্ব ও নির্দেশে পরিচালিত বাঙালির সর্বাত্মক অসহযোগ অন্দোলন এবং ৭ মার্চ, ১৯৭১ প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালির জাতীয় মুক্তির চূড়ান্ত পর্বের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুত করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা হারাবার ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ অধিক আসনে জয়লাভ করবে- এ ধারণা কমবেশি সবাই পোষণ করেছিল কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জনগণের ম্যান্ডেট পাবে যদি বুঝতে পারত তাহলে হয়তো তারা ভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নিত। আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্যদিয়ে বাঙালিদের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব অর্জন এবং ৬ দফা ভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি নিশ্চিত হয়, যার কোনোটিই পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসকগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের অব্যবহিত পরে শুরু হয় নতুন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।

সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে এ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সহায়তা প্রদান করেন পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বিশেষত পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে আহ্বান করেছিলেন। নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু এসব ছিল লোক দেখানো। ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছিল কীভাবে নির্বাচনের রায় বানচাল করা যায়। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলীয় নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এক শপথ পাঠ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ ঐতিহাসিক ৬ দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার শপথ গ্রহণ করেন।

আওয়ামী লীগের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান যখন পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যথার্থ আশার সঞ্চার করছিল, তখন পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল (আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি) এ বক্তব্য জোরেসোরে তুলে ধরেন। সংবিধানের প্রশ্নে এ দুটি দলের মধ্যে একই সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার কথা তিনি ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার পেছনে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার যোগসাজসের বিষয়টি স্পষ্ট ে যাচ্ছিল। যা হোক, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার দুদিন পূর্বে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অধিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতকরণের খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় হরতালের ডাক দেন। ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ২ মার্চ রাতে কাফু জারি করা হয়। ছাত্র-জনতা কার্টু ভঙ্গ করে। সেনাবাহিনী গুলি চালায়। প্রতিদিন শত শত লোক হতাহত হয়। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। চারদিকে বিদ্রোহ আর গগনবিদারী শ্লোগান "বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।"

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রসমাজের স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ, স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠন, ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে পূর্ব বাংলার সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন বাঙালির জাতীয় উত্থানের স্বাক্ষর বহন করে।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন পালিত হয়। পূর্ব বাংলার সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, সেক্রেটারিয়েট, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক, বিমা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, পরিবহন পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশ অমান্য ও অগ্রাহ্য করে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি প্রশাসন সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে।

অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব: ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী সাংবিধানিক উপায়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সমগ্র বাঙালি জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এর পর অসহযোগ আন্দোলন স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ লাভ করে।

চারদিকে 'জয় বাংলা', 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা', 'জনগণের একদফা বাংলার স্বাধীনতা', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর' প্রভৃতি শ্লোগানে বাঙালি জনগণ মুখরিত করে তোলে। কিন্তু এ সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আলাপ-আলোচনার আড়ালে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে এবং ২৫ মার্চ 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর পৈশাচিক গণহত্যা শুরু করে। এ সময় বাঙালি আপামর জনসাধারণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সৃষ্টি হয় বাঙালির মননে দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। অনেক প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ তার যাত্রা আরম্ভ করে।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ