- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনের এক অবিস্মরণীয় দিন। এ দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দশ লক্ষাধিক জনতার স্বতঃস্ফূর্ত এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন।
এ ভাষণই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নামে পরিচিত। এ ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসের যেমন এক অনন্য দলিল তেমনি বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ চলছিল। তৎকালীন পাকিস্তানি জনগণই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্ব অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে কী বলেন? পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য এ ছিল অন্তিম মুহূর্ত। অন্যদিকে স্বাধীনতার চেতনায় প্রদীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য এ ভাষণ ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা।
৭ই মার্চের ভাষণের মূল উপজীব্য কী হবে তা নির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে এর পূর্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটি একটানা ৩৬ ঘণ্টা বৈঠক করেও যখন কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌছতে সক্ষম হলো না, তখন উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় যা বলা আবশ্যক তাই বলবেন বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের ওপর দায়িত্ব তুলে নেন। ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন প্রত্যয়দীপ্ত অবিচল পদক্ষেপে নির্দেশের জন্য অপেক্ষারত উত্তাল জনগণকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানাতে। মাত্র ১৮ মিনিটের এক সংক্ষিপ্ত অথচ তেজস্বী ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনীতি ও বাঙালিদের বঞ্চনার ইতিহাস ব্যাখ্যা, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করলেন।
তিনি তার বজ্রকণ্ঠে সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিলেন। লক্ষ লক্ষ জনতার গগনবিদারী শ্লোগানের মধ্যে বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা প্রতিরোধ সংগ্রাম শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিলেন। শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোনো উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পরামর্শ ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরার পর দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন-
"ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর অসহযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, যানবাহন চলাচল সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার শ্লোগানে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন দেশের প্রকৃত সরকার প্রধান। তার নির্দেশিত পথে চলতে থাকে দেশ। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ
ভাইয়েরা আমার,
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসমরি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সাথে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল-ল জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন- গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সাথে দেখা করেছি।
'আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমরা অ্যাসেমব্লিতে বসব। আমি বললাম, অ্যাসেমব্লির মধ্যে আলোচনা করব- এমনকি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।
ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেমরি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা হবে, যদি কেউ অ্যাসেমরিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেমব্লি চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেমরি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেমরি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোয় দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করার পর এ দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কী পেলাম আমরা? আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সাথে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপর, আমার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে।
আমিতো অনেক আগেই বলে দিয়েছি কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সাথে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সাথে বসব? হঠাৎ আমার সাথে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টার গোপন বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন তাতে সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার,
২৫ তারিখে অ্যাসেমরি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে, আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেমরি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন 'মার্শাল-ল' Withdraw করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেমব্লিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেমব্লিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমার এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটি গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা-কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা-যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ৭কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।
আর যে-সমস্ত লোক শহিদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর তাদের পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই ৭ দিনের হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। শুনুন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়- হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনেপত্র নিতে পারে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সাথে দেয়ানেয়া চলবে না।
কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
[সূত্র: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান, এপ্রিল ২০১৬; পঞ্চম তফসিল ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ এর পৃষ্ঠা নং ৭৪-৭৬]
HISTORIC SPEECH OF THE FATHER OF THE NATION, BANGABANDHU
SHEIKH MUJIBUR RAHMAN OF THE 7TH MARCH, 1971
My brothers,
I have come before you today with a heart laden with sadness. You are aware of everything and know all. We have tried with our lives. And yet the sadness remains that today, in Dhaka, Chittagong, Khulna, Rajshahi and Rangpur the streets are soaked in the blood of my brothers. Today the people of Bengal desire emancipation, the people of Bengal wish to live, the people of Bengal demand that their rights be acknowledged. What wrong have we committed? Following the elections, the people of Bangladesh entrusted me and the Awami League with the totality of their electoral support.
It was our expectation that the Parliament would meet, there we would frame our Constitution, that we would develop this land, that the people of this country would achieve their economic, political and cultural freedom. But it is a matter of grief that today we are constrained to say in all sadness that the history of the past twenty three years has been the history of a persecution of the people of Bengal, a history of the blood of the people of Bengal. This history of the past twenty three years has been one of the agonising cries of men and women. The history of Bengal has been a history where the people of this land have made crimson the streets and highways of this land with their blood.
We gave blood in 1952; in 1954, we won the elections and yet were not permitted to exercise power. In 1958, Ayub Khan imposed 'Martial Law and kept the nation in a state of slavery for ten long years. On 7 June 1966, as they rose in support of the Six-Point movement, the sons of my land were mown down in gunfire. When Yahya Khan took over once Ayub Khan fell in the fury of the movement of 1969, he promised that he would give us a Constitution, give us democracy. We put our faith on him. And then history moved a long way, the elections took place. I have met President Yahya Khan.
I appealed to him, not just as the majority leader in Bengal but also as the majority leader in Pakistan, to convene the National Assembly on 15 February. He did not pay heed to my appeal. He paid heed to Mr. Bhutto. And he said that the assembly would be convened in the first week of March. I went along with him and said we would sit in the parliament. I said that we would discuss matters in the Assembly. I even went to the extent of suggesting that despite our being in a majority, if anyone proposes anything that is legitimate and right, we would accept his proposal.
Mr. Bhutto came here. He held negotiations with us, and when he left, he said that the door to talk had not closed, that more discussions would take place. After that, I spoke to other political leaders. I told them to join me in deliberations so that we could give shape to a Constitution for the country. But Mr. Bhutto said that if members elected from West Pakistan came here, the Assembly would turn into a slaughter house, an abattoir. He warned that anyone who went to the Assembly would end up losing his life. He issued dire warnings of closing down all the shop from Peshawar to Karachi if the Assembly Session went ahead. I said that the Assembly Session would go ahead. And then, suddenly, on the first of March the Assembly Session was put off.
Mr. Yahya Khan, in exercise of his powers as president, had called the National Assembly into Session; and I had said that I would go to the Assembly. Mr. Bhutto said, he would not go. Thirty five members came here from West Pakistan. And suddenly the Assembly was put off. The blame was placed squarely on the people of Bengal, the blame was put at my door. Once the Assembly meeting was postponed, the people of this land decided to put up resistance to the act.
I enjoined upon them to observe a peaceful general strike. I instructed them to close down all factories and industrial installations. The people responded positively to my directives. Through sheer spontaneity they emerged on to the streets. They were determined to pursue their struggle through peaceful means. What have we attained? The weapons we have bought with our money to defend the country against foreign aggression are being used against the poor and down-trodden of my country today. It is their hearts the bullets pierce today.
We are the majority in Pakistan. Whenever we Bengalis have attempted to ascend to the heights of power, they have swooped upon us.
I have spoken to him over telephone. I told him, "Mr. Yahya Khan, you are the President of Pakistan. Come, be witness to the inhuman manner in which the people of my Bengal are being murdered, to the way in which the mothers of my land are being deprived of their sons." I told him. "come, see and dispense justice". But he construously said that I had agreed to participate in a Round Table Conference to be held on 10 March.
I have already said a long time ago, what RTC? With whom do I sit down to talk? Do I fraternise with those who have taken the blood of my people? All of a sudden, without discussing matters with me and after a secret meeting lasting five hours, he has delivered a speech in which he has placed all responsibility for the impasse on me, on the people of Bengal.
My brothers,
They have called the Assembly for the twenty-fifth. The marks of blood have not yet dried up. I said on the tenth that Mujibur Rahman would not walk across that blood to take part in a Round Table Conference. You have called the Assembly. But my demands must be met first. Martial Law must be withdrawn. All military personnel must be taken back to the barracks. An inquiry must be conducted into the manner in which the killings have been caused. And power must be transferred to the elected representatives of the people. And only then shall we consider the question of whether or not to sit in the National Assembly. Prior to the fulfilment of our demands, we cannot take part in the Assembly.
I do not desire the office of Prime Minister. I wish to see the rights of the people of this country established. Let me make it clear, without ambiguity, that beginning today, in Bangladesh, all courts, magistracies, government offices and educational institutions will remain closed for an indefinite period. In order that the poor do not suffer, in order that my people do not go through pain, all other activities will continue, will not come within the ambit of the general strike from tomorrow. Rickshaws, horse carriages, trains and river vessels will ply.
The Supreme Court. High Court, Judge's Court, semi-government offices, WAPDA,- nothing will work. Employees will collect their salaries on the twenty-eighth. But if the salaries are not paid, if another bullet is fired, if any more of the people are murdered, it is my directive to all of you: turn every house into a fortress, resist the enemy with everything you have. And for the sake of life, even if I am not around to guide you, direct you. close off all roads and pathways. We will strive them into submission. We will submerge them in water. You are our brothers. Return to your barracks and no harm will come to you. But do not try to pour bullets into my heart again. You cannot keep seventy five million people in bondage. Now that we have learnt to die, no power on earth can keep us in subjugation.
For those who have embraced martyrdom, and for those who have sustained injuries we in the Awami League will do all we can to relieve their tragedy. Those among you who can please lend a helping hand through contributing to our relief committee. The owners of industries will make certain that the wages of workers who have taken part in the strike for the past week are duly paid to them. I shall tell employees of the government. my word must be heard, and my instructions followed. Until freedom comes to my land, all taxes will be held back from payment. No one will pay them. Bear in mind that the enemy has infiltrated our ranks to cause confusion and sow discord among us. In our Bengal, everyone, be he Hindu or Muslim, Bengali or non-Bengali. is our brother. It is our responsibility to ensure their security. Our good name must not be sullied.
And remember, employees at radio and television, if radio does not get our message across, no Bengali will go to the radio station. If television does not put forth our point of view, no Bengali will go to television. Banks will remain open for two hours to enable people to engage in transactions. But there will be no transfer of even a single penny from East Bengal to West Pakistan. Telephone and telegram services will continue in East Bengal and news can be despatched overseas.
But if moves are made to exterminate the people of this country, Bengalis must act with caution. In every village, every neighbourhood, set up Sangram Parishad under the leadership of the Awami League. And be prepared with whatever you have. Remember: Having mastered the lesson of sacrifice, we shall give more blood. God willing, we shall free the people of this land. The struggle this time is a struggle for emancipation. The struggle this time is a struggle for independence. Joi Bangla!
[সূত্র: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান, এপ্রিল ২০১৬; পঞ্চম তফসিল ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ এর পৃষ্ঠা নং ৭৪-৭৬]
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব (Importance of the Historics 7th March speech)
বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি। ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব যেমন রাজনৈতিক বিচারে অপরিসীম, তেমনি সময়ের বিবেচনায় কালোত্তীর্ণ। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:
১. স্বাধীনতার ঘোষণা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণে বস্তুত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি বলেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ ভাষণের পরই পূর্ব বাংলার জনগণের সামনে একটি গন্তব্য নির্ধারিত হয়ে যায়, তা হলো স্বাধীনতা।
২. মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা: ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে বাঙালি জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রেরণা ও মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা লাভ করে। সেই হিসেবে পূর্ব বাংলার জনগণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
৩. শত্রু মোকাবেলার কৌশল: ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রতিরোধ সংগ্রাম, যুদ্ধের কলা-কৌশল ও শত্রু মোকাবেলার উপায় সম্পর্কেও নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
৪. সংগ্রামের জন্য প্রত্যয়দীপ্ত আহ্বান বঙ্গবন্ধু তাঁর এ ভাষণে বাংলার জনগণকে সকল প্রকার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সাবধান থাকার পরামর্শ দেন এবং শত্রু মোকাবেলার যে আহ্বান জানান, তা বাঙালিদের জীবন বাজি রেখে মরণপণ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
৫. আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ার্চের প্রত্যয়দীপ্ত ভাষণ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন, উপস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলকে পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত উপস্থিতি আন্তর্জাতি দাবির প্রতি সমর্থন প্রদানে আগ্রহী করে তোলে।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে যে আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন, তাই সত্য হয়ে দেখা দেয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের ওপর আক্রমণ চালায় এবং নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। বাঙালিরা এ আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির ইতিহাসে একটি তাৎপর্যবহুল ঘটনা। ৭ই মার্চ ছিল স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খলা ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা। 'রাজনীতির কবি' (নিউজ উইক ম্যাগাজিনের ভাষায়) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে দক্ষ কৌশলীর মতো তাঁর সুনিপুণ উচ্চারণে স্বাধীনতার কথা এমনভাবে তুলে ধরলেন যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকল না। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। তবে তিনি সরাসরি তা ঘোষণা না করে কৌশলের আশ্রয় নেন। তার অবস্থান হলো, মেজরিটি (বাঙালি) মাইনরিটি (পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কেন? বরং মাইনরিটিই 'সিসিড' বা বিচ্ছিন্ন করেছে অথবা আক্রমণকারী- এটাই ঘটুক।
৭ই মার্চের ভাষণের সাংবিধানিক গুরুত্ব
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বাংলাদেশ সংবিধানে ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল হিসেবে গণ্য করা হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, (২) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখ হইতে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে এই সংবিধান প্রবর্তন হবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ষষ্ঠ তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম এবং সপ্তম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হইল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল, যাহা উক্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী বলিয়া গণ্য হইবে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ