- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
ছাত্রসমাজের এগারো দফা
১৯৬৯ সালের পূর্ব বাংলার জাগ্রত ছাত্র সমাজের ১১ দফা কর্মসূচি জনগণের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে সমগ্র পূর্ব বাংলা যখন আইয়ুব-মোনায়েম বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল, সে সময়ে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে পেশ করা হয় ১১ দফা কর্মসূচি। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কার্যালয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া ও মেনন উভয় গ্রুপ) জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ (দোলন গ্রুপ) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইয়ুব বিরোধী মঞ্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ এ পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ডাকসু কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তোফায়েল আহমেদ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচি বা দাবি ছিল নিম্নরূপ:
১. (ক) সব প্রাদেশিক কলেজসমূহ (জগন্নাথ কলেজ ও ভিক্টোরিয়া কলেজ) পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া।
(খ) স্কুল ও কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
(গ) সরকারি কলেজগুলোতে নৈশ বিভাগ চালু করা।
(ঘ) ছাত্র বেতনের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ (৫০%) হ্রাস করা।
(ঙ) বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসগুলোতে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ (৫০%) সরকারি সাহায্য প্রদান করা।
(চ) শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ও সব অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন করা।
(ছ) শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা।
(জ) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।
(ঝ) চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা।
(ঞ) বহুমুখী কারিগরি ছাত্রদের হ্রাসকৃত পাঠ্যক্রমে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা অর্জনের সুযোগ প্রদান করা।
(ট) অল্প ভাড়ায় ট্রেন ও বাস ভ্রমণের সুযোগ প্রদান করা।
(ঠ) চাকুরিতে সুযোগের নিশ্চয়তা প্রদান করা।
(ড) ১৯৬১ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা।
(ঢ) জাতীয় শিক্ষা কমিশন ও হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল করা।
২. সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা।
৩. ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ সকল প্রদেশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে দেশের পশ্চিম অংশে একটি সাব-ফেডারেশন গঠন।
৫. ব্যাংক, বিমা, ইন্সুরেন্স ও বৃহৎ শিল্প-প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ
৬. কৃষকের ওপর হতে খাজনা ও ট্যাক্সের বোঝা হ্রাস, বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য প্রতি মণ ৪০ টাকা ও আখের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা।
৭. শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও বোনাস প্রদান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কালাকানুন, প্রত্যাহার ও শ্রমিক ধর্মঘটের অধিকার নিশ্চিত করা।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯.. জরুরি অবস্থা, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য বিতর্কমূলক আইন বাতিল।
১০. সিয়াটো, সেন্টো, পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ।
১১. সকল রাজবন্দীর মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলা বাতিল ঘোষণা।
১১ দফার গুরুত্ব (Importance of 11 point)
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র সমাজের ১১ দফা কর্মসূচি অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ কর্মসূচির তাৎপর্য ও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভ করে ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রসমাজের, সংবর্ধনার জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সাথে বলেন, বাঙালিদের সংগ্রাম ৬ দফা ও ১১ দফার মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে। তার এ ঘোষণার বলে বলীয়ান ছাত্রসমাজ ১১ দফা ও ৬ দফার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশব্যাপী প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের শুরু করে। নিম্নে ছাত্রসমাজের ১১ দফার গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো:
১. আইয়ুব বিরোধী দুর্বার আন্দোলনের সৃষ্টি সৃষ্টি: ১১ দফার ভিত্তিতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ক্ষমতাসীন আইয়ুব-মোনায়েম শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
২. গণঅভ্যুত্থান ত্বরান্বিত করে ১১ দফা দাবিতে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের স্বার্থ সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে। তাই সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন ১১ দফার আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়, যা আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থানকে ত্বরান্বিত করে।
৩. আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ: ১১ দফা কর্মসূচিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দাবি করা হয়, যা পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে নিজেদের ঐক্য ও সংহতি জোরদার করে।
৪. বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ ১১ দফা পাকিস্তান শাসক চক্রের বৈষম্যমূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ছিল জীবন্ত প্রতিবাদ। কৃষকের কর ভার লাঘব, মজুরদের অধিক মজুরি ইত্যাদি দাবি পূর্ব বাংলার জনগণকে আকৃষ্ট করে। ফলে ছাত্রসমাজের ১১ দফা শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফাভিত্তিক গণ-আন্দোলনকে আরও দুর্বার ও অজেয় করে তোলে।
৫. সংগ্রামী চেতনার স্ফুরণ ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচি পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগণের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি এবং সংগ্রামী চেতনার স্ফুরণ ঘটায়। জনতার এ জাগরণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বেগবান করে তোলে।
৬. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি: ১১ দফা কর্মসূচি আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে। ছাত্রসমাজের ঐক্যে সাড়া দিয়ে ৮টি রাজনৈতিক দল DAC (Democratic Action Committee) গঠন করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৭. স্বাধীনতার দিগন্ত উন্মোচিত করে ১১ দফা কর্মসূচি ৬৯ এর গণঅভ্যুথানকে তীব্র করে তোলে। এতে আইয়ুব খানের পতন হয়। ফলে এদেশের ছাত্র-জনতার ঐক্য সুদৃঢ় হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটে। ৭০ এর নির্বাচনের পথ বেয়ে আসে স্বাধীনতা। তাই বলা যায়, ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচি স্বাধীনতার দিগন্ত উন্মোচিত করে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ