- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তি, ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাহতের সংখ্যা অতীতের সকল যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণকে অতিক্রম করে গেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইউরোপের প্রায় সব দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি আটলান্টিকের ওপারের যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার কিছু দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিস্তৃতি ঘটে। প্রকৃতপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূলে ছিল একাধিক কারণ।
পরোক্ষ কারণসমূহ
(ক) উগ্র জাতীয়তাবাদ: প্রথম মহাযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত ইউরোপীয় জাতিসমূহের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের উনোষ। ইতালি ও জার্মানিতে জাতীয়তাবাদের সাফল্যের ফলে রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব শক্তির সঞ্চার করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ হয়ে দাঁড়ায় একটি জাতির গৌরবের প্রতীক এবং প্রতিটি জাতি অপর জাতির তুলনায় অনেক সম্মান ও গৌরব দাবি করতে থাকে। ফলে জার্মানি ও ইংল্যান্ডের মধ্যে তীব্র নৌ ও সামরিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। তাছাড়া এর ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও বলকান অঞ্চলে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে রাজ্যলাভের জন্য তীব্র সংগ্রামের সূত্রপাত হয়। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রাংকো-প্রুশিয়া যুদ্ধে ফ্রান্সের আলসেস ও লোরেন প্রদেশদ্বয় জার্মানি দখল করে নিলে ফ্রান্সের যে জাতীয় সম্মান ক্ষুণ্ণ হয় তা ফরাসিরা ভুলতে পারেনি। এ কারণেই তারা জার্মানদের চরম শত্রুতে পরিণত হয়। অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে টিয়েস্ট ও টেন্টিনো অঞ্চলের ইতালীয় ভাষাভাষী জনগণকে ইতালির সাথে সংযুক্ত করার ব্যাপারে ইতালির জনগণ আকুল হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউরোপের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল জাতীয়তাবাদের বাড়াবাড়ি, যা শেষ পর্যন্ত মহাযুদ্ধে পরিণত হয়।
(খ) পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের উগ্র সমরবাদ ও পরস্পরবিরোধী সামরিক জোটও প্রথম মহাযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। এর মূলে ছিল বিসমার্কের ফ্রান্সবিরোধী মনোভাব। বিসমার্ক উপলব্ধি করেন, ফ্রাংকো-প্রুশিয়া যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি ফ্রান্স কখনো বিস্মৃত হতে পারেনি; এ কারণে ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ আক্রমণ থেকে জার্মানির নিরাপত্তার জন্য বিসমার্ক সামরিক শক্তিজোটের সূত্রপাত করেন। ডেভিড টমসন বলেছেন, "প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, এই যুদ্ধ ছিল অযাচিত ও অভাবিত। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যে ঘটনাবলির সূচনা হয়, এই যুদ্ধ ছিল তার চূড়ান্ত পরিণাম।" (The most important thing about the first world war is that it was unsought, un-intended end product of a long sequence of events which began in 1871.) ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার সম্রাটরা ত্রিশক্তি সম্রাট জোট গঠন করেন। বলকান অঞ্চলে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে স্বার্থ-সংঘাতের দ্বন্দ্বে জার্মানি অস্ট্রিয়ার পক্ষাবলম্বন করায় রাশিয়া ত্রিশক্তি সম্রাট জোট থেকে বেরিয়ে যায়। ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে ইতালি ফ্রান্স-ভীতি থেকে মুক্ত হতে জার্মানি-অস্ট্রিয়ার জোটভুক্ত হয়। ফলে এ তিন শক্তির সম্মিলিত সামরিক জোটই ত্রিশক্তি চুক্তি (Triple Alliance) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা ও সামরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার নাম হয় ত্রিশক্তি আঁতাত। এসব শক্তিজোটের শর্তগুলো ছিল গোপন। শান্তিরক্ষার পরিবর্তে এ শক্তিজোটগুলো অবিশ্বাস ও ভীতির সঞ্চার করে এবং প্রতিটি রাষ্ট্র এক ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কায় সময় কাটাতে থাকে। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৪ খ্রিষ্টান্দের মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকটের সময়ে এ দুই শক্তিজোট পরস্পরের সম্মুখীন হয়। মরকোর ব্যাপারে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিকট অপদস্থ হয় জার্মানি ও তার মিত্ররা, অস্ট্রিয়া ও ইতালি তা বিস্তৃত হয়নি। কিন্তু ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বলকান সংকটে অস্ট্রো-জার্মান গোষ্ঠী জয়লাভ করে এবং রাশিয়া অপদস্থ হয়। এ রকম ঘাত-প্রতিঘাত বৃহত্তর যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে।
(গ) সামরিক শক্তির প্রতিযোগিতা এ যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক শক্তির প্রতিযোগিতা। তখন ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ-সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে সকল রাষ্ট্রই সমরাস্ত্রে সজ্জিত হতে থাকে। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির সৈন্যসংখ্যা ছিল ৮,৭০,০০০। তখন ফ্রান্স বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরির মেয়াদ ৩ বছর করে। রাশিয়াও নিজ দেশে সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে। ব্রিটেনও তখন নৌবাহিনীর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে। এ রকম সামরিক পটভূমিকায় ইঙ্গ-জার্মান নৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা মহাযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
(ঘ) পুঁজিবাদের বিকাশ ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়। যার ফলে সমগ্র ইউরোপে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ লাভঘটে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্রিটেন আরেক পুঁজিবাদী আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ইউরোপের প্রায় সকল পুঁজিবাদী দেশই পণ্যের বাজার দখলের জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। পুঁজিবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে ত্বরান্বিত করে।
(ঙ) উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের চরম বিকাশের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের প্রসার ও উপনিবেশ বিস্তার নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটেন ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ঔপনিবেশিক শক্তি। উপনিবেশগুলো ছিল তার শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রধান উৎস। জার্মানি নব্য পুঁজিবাদী দেশ হওয়ায় তার কোনো উপনিবেশ ছিল না। ফলে নতুন উপনিবেশ স্থাপনের জন্য জার্মানি উদগ্রীব হয়ে ওঠে। উপনিবেশের সম্প্রসারণ ও নতুন উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা নেয়।
চ) বিভিন্ন শক্তির উদ্দেশ্য সিদ্ধি: বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপীয় শক্তি বিভিন্ন উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছিল এবং যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছিল।
জার্মানির উদ্দেশ্য ছিল:
১। পোল্যান্ডের কিছু অংশ দখল করা।
২। মরক্কোসহ আফ্রিকায় কিছু উপনিবেশ দখলের ইচ্ছা তার ছিল। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে জার্মানি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে মরক্কোর আগাদিতে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। ফ্রান্সের প্রতিরোধের মুখে ইউরোপ যুদ্ধ থেকে রক্ষা পায়।
ব্রিটেনের উদ্দেশ্য ছিল:
১। তার ঔপনিবেশিক আধিপত্য ধরে রাখা।
২। জার্মানির উঠতি নৌবাহিনী, যা ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য সৃষ্ট, তাকে আর বাড়তে না দেওয়া।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরির উদ্দেশ্য ছিল:
১। স্লাভ জাতিগত এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যার ফলস্বরূপ অস্ট্রো-হাঙ্গেরি তুরস্কের বসনিয়া-হার্জেগোভিনা নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে।
২। বলকান এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাও তার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তার প্রধান বাধা ছিল সার্বিয়া। কারণ বসনিয়ার জনসংখ্যার অধিকাংশ ছিল স্লাভ এবং সার্বিয়া আগে থেকেই বসনিয়াকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে চেয়েছিল। অস্ট্রিয়ার জন্য উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় সার্বিয়া অস্ট্রিয়ার বিরোধী হয়ে ওঠে।
রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল:
১। কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ। মে ভূমধ্যস
২। তুরস্ক ও মেসোপটেমীয় অঞ্চলে জার্মানি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরি যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সে উদ্দেশ্য রাশিয়ার ছিল।
এজন্য স্লাভ জাতির সাথে সুসম্পর্ক থাকায় সার্বিয়ার সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠে।
ফ্রান্সের উদ্দেশ্য ছিল:
১। তার উপনিবেশগুলোতে জার্মানির প্রবেশ ঠেকানো।
২। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধে হারানো আলসে ও লোরেন জার্মানির কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা।
ইতালির উদ্দেশ্য ছিল: ইতালি একটি দুর্বল পুঁজিবাদী দেশ হলেও তারও উদ্দেশ্য ছিল বলকান এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
জাপানের উদ্দেশ্য ছিল: এশিয়ায় তার প্রভাব বৃদ্ধি করা।
আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল:
১। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্র ব্যবসা।
২। নীতিগতভাবে আমেরিকা জার্মানবিরোধী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল।
অতএব, বিভিন্ন দেশের পরস্পরবিরোধী উদ্দেশ্য ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
প্রত্যক্ষ কারণসমূহ
অস্ট্রিয়ার যুবরাজের হত্যা: ইউরোপে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন উত্তেজনা বিরাজমান, তখন ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ ও তার স্ত্রী সোফিয়া বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে প্রকাশ্য দিবালোকে এক সার্ব আততায়ীর হাতে নিহত হন। ইতিপূর্বে অস্ট্রিয়া-সার্বিয়ার পারস্পরিক শত্রুতা চরম আকার ধারণ করে। এ হত্যাকাণ্ডের ফলে ইউরোপে এক প্রচণ্ড উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যা ক্রমে সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্বকে গ্রাস করে। এ হত্যাকাণ্ড অস্ট্রিয়ার অভ্যন্তরে ভীষণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং সে সর্বতোভাবে সার্বিয়াকে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে ২৩শে জুলাই একটি চরমপত্র প্রদান করে। এর দাবিগুলো ছিল- সার্বিয়াকে অস্ট্রিয়াবিরোধী সকল প্রচারণা বন্ধ করতে হবে, সকল গোপন সমিতি দমন করতে হবে এবং অস্ট্রিয়ার যুবরাজের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার বিষয়ে অস্ট্রীয় অফিসারদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সার্বিয়া শেষ দাবিটা ছাড়া সব দাবি মেনে নিতে স্বীকৃত হয়। কিন্তু অস্ট্রিয়া এতে সন্তুষ্ট হয়নি। তারা সার্বিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং সৈন্য সমাবেশের নির্দেশ দেয়। জার্মানি এ কাজে অস্ট্রিয়াকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানায়।" ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে ২৮০০ জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সার্বিয়ার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও জার্মান সীমান্তে তার সৈন্য সমাবেশ ১ম বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়। এটাই হলো বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কার করতে থাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের যোগদানের কারণ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধপূর্ব সময়ে বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ উপনিবেশের অধিকারী ছিল ইংল্যান্ড। নৌশক্তিতে বলীয়ান হওয়ায় বিশ্বের সবগুলো সমুদ্র ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে উপনিবেশসমূহে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারে তার কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ইউরোপের নতুন পরাশক্তি জার্মানি নৌশক্তি অর্জনের আশায় বিশাল বিশাল নৌবহর গঠন করতে শুরু করলে ইংল্যান্ডের সমুদ্র বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তুরস্কের সাথে জার্মানির বন্ধুত্ব স্থাপিত হলে নিকট প্রাচ্যে ইংল্যান্ডের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের লন্ডন চুক্তির দ্বারা জার্মানি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল যে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বেলজিয়ামকে রক্ষা করা হবে। কিন্তু লন্ডন চুক্তি ও আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি উপেক্ষা করে জার্মানি বেলজিয়ামের উপর দিয়ে ফ্রান্স আক্রমণ করায় ইংল্যান্ড আতঙ্কবোধ করে। এছাড়া ফ্রান্স ও রাশিয়ার সাথে ইংল্যান্ড ত্রিশক্তি আঁতাত জোটে চুক্তিবদ্ধ ছিল। ফলে ৫ই আগস্ট, ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
তুরস্কের যোগদানের কারণ তুরস্ককে কেন্দ্র করে পূর্ব ইউরোপের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল উসমানীয় খিলাফত তথা অটোমান সাম্রাজ্য। রাশিয়া ছিল খিলাফতের চিরশত্রু। বলকান অঞ্চলে রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করলে তুরস্ক নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের যোগদানের কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেয়। আটলান্টিকের পশ্চিম তীরের দেশটি ছিল সব দিক থেকেই নিরাপদ। মার্কিনিদের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড। যুদ্ধসামগ্রী বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে থাকে। জার্মানি মার্কিন রসদ ও অস্ত্রবোঝাই জাহাজগুলো যাতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে যেতে না পারে সেজন্য সাবমেরিন আক্রমণ দ্বারা জাহাজগুলোকে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবিয়ে দিতে থাকে। বিশেষ করে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে লুসিটানিয়া নামক মার্কিন যাত্রীবাহী জাহাজ জার্মানির নৌবাহিনী ধ্বংস করলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না- এ মর্মে জার্মানি প্রতিশ্রুতি দিলেও ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে জার্মানি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের চারদিকে সাবমেরিন বলয় তৈরি করে এবং ঘোষণা দেয় যে, এ বলয় ভেদ করে কোনো মার্কিন জাহাজ ঢুকলে এর ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার জার্মানি নেবে না। এরূপ ঘটনায় মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেটরগণ জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট উইলসনের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ নীতি ত্যাগ করে ৬ই এপ্রিল, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
যুদ্ধের বিস্তৃতি: ৩০শে জুলাই জার্মানি রাশিয়াকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে সৈন্য সমাবেশ বন্ধ করার জন্য চরমপত্র প্রদান করে। রাশিয়া এর কোনো উত্তর না দিলে জার্মানি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৩রা আগস্ট জার্মানি বেলজিয়ামের সীমান্ত লঙ্ঘন করে সৈন্য পাঠালে ইংল্যান্ড ফ্রান্স ও রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করে ৪ঠা আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে সারা বিশ্বে শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ।
ত্রিশক্তি চুক্তি ও ত্রিশক্তি আঁতাত
ত্রিশক্তি চুক্তি ও ত্রিশক্তি আঁতাত হলো ইউরোপের দুটি বিরোধী শিবিরের পরস্পরবিরোধী মৈত্রী চুক্তি। জাতীয়তাবাদকে অবহেলা ও জাতীয়তাবাদ দমনের মধ্যে যেমন যুদ্ধের বীজ নিহিত থাকে, তেমনি উগ্র জাতীয়তাবোধও যুদ্ধের মনোবৃত্তি সৃষ্টিতে সহায়তা করে। উনবিংশ শতকের শেষভাগে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নানাবিধ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ-দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দেখা দিয়েছিল, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসকারী রূপ রচনার পটভূমি তৈরি করেছিল। উগ্র জাতীয়তাবোধ জার্মানিতে বেশি আত্মপ্রকাশ করেছিল।
জার্মানির নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিসমার্ক অস্ট্রিয়া ও ইতালির সঙ্গে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে যে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন, তা ত্রিশক্তি চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তি অনুসারে জার্মানি,। ইতালি ও অস্ট্রিয়া। পরস্পর পরস্পরের আত্মরক্ষার জন্য সামরিক সাহায্যদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এ তিনটি দেশ হয় অক্ষশক্তিভুক্ত দেশ্য ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্ক ও রুমানিয়া এবং পরবর্তী সময়ে বুলগেরিয়া এ 'ত্রিশক্তি চুক্তির' জোটে যোগ দেয়।
জার্মানির এ যুদ্ধ প্রস্তুতি ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রগুলোকে আতঙ্কিত করে তোলে। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে বিসমার্কের পদত্যাগের পর রাশিয়া জার্মানির সাথে সম্পাদিত রি-ইন্স্যুরেন্স চুক্তি ভঙ্গ করে ফ্রান্সের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হলো। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাদের ঔপনিবেশিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলে 'আঁতাত কার্ডিয়াল' নামে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করল। এ সময় ইংল্যান্ড জাপানের সাথেও একটি মিত্রতা চুক্তি করল। ১৯০৭খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও ফ্রান্স এ তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক আত্মরক্ষা ও সামরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে
যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তা ত্রিশক্তি আঁতাত বা ট্রিপল আঁতাত নামে পরিচিত। ট্রিপল আঁতাত ছিল ট্রিপল অ্যালায়েন্স বা ত্রিশক্তি চুক্তির প্রত্যুত্তর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এ তিনটি দেশ হয় মিত্রশক্তিভুক্ত দেশ।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

