- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান ঘটনাগুলোকে বছর হিসাবে ভাগ করে বর্ণনা করা যুক্তিযুক্ত হবে। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষণার সময় জার্মানিই ছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। জার্মানির অগ্রগতি প্রতিহত করার মতো ক্ষমতা মিত্রশক্তির ছিল না। লিজের যুদ্ধে জার্মান বাহিনী বেলজিয়ামকে পরাজিত করে। ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনীর প্রতিরোধ সত্ত্বেও জার্মান বাহিনী ফ্রান্সের উপকণ্ঠে এসে পৌছে। এ সময় মিত্রপক্ষের সেনাপতি জেনারেল ফচের তৎপরতা ও দক্ষতায় জার্মান বাহিনী মার্ন নদীর তীর থেকে পিছু হটে। মিত্রপক্ষ মার্নের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পায়। অপরদিকে জার্মানি ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ দ্রুত অবসানের সুযোগ হারায়। এইসৃনি নদীর তীরে জার্মান বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করলে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।
এ বছর রুশ বাহিনী পূর্ব ইউরোপ আক্রমণ করতে এসে ট্যাটেনবার্গের যুদ্ধে পরাজিত হয়। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রগতি জার্মানির সহায়তায় রুদ্ধ হয়। রুশ বাহিনী অস্ট্রিয়া ত্যাগে বাধ্য হয়।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইতালি যুদ্ধে অংশ নিলে যুদ্ধের গতিপ্রবাহে পরিবর্তন ঘটে। তুরস্কও জার্মানির অনুরোধে মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তুরস্ক দার্দনিলিজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে মিত্রবাহিনীর যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে যায়। দাদনিলিজ উদ্ধারের জন্য রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স অর্থাৎ মিত্রবাহিনী আক্রমণ করে পরাজিত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইংল্যান্ড বাগদাদ দখলে সমর্থ হয়। এ বছরই জার্মানি ইংল্যান্ডের সামুদ্রিক প্রাধান্য ও বাণিজ্যিক স্বার্থ নষ্ট করার উদ্দেশ্যে সাবমেরিনের আক্রমণ দ্বারা ইংরেজদের যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করতে শুরু করে। এ বছর জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার আক্রমণে সার্বিয়া সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। এভাবে সব যুদ্ধেই মিত্রশক্তির পরাজয় ঘটে।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের নিকট ভার্দুনের যুদ্ধে জার্মান ও ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলে উভয় পক্ষে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। সোমের যুদ্ধে জার্মান বাহিনী ইঙ্গ-ফরাসি আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এ বছর পুনরায় রাশিয়া অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করলেও জার্মানির সামরিক সহযোগিতায় অস্ট্রিয়াকে পুরোপুরি পদানত করা সম্ভব হয়নি। রুমানিয়া অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিলে অস্ট্রিয়া-জার্মানির যৌথ আক্রমণে রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট যৌথ বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত হয়।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো জাটল্যান্ডের জলযুদ্ধ। যুদ্ধের প্রথম দিকে ইংরেজ বাহিনী জয়লাভ করলেও চূড়ান্ত জলযুদ্ধে তাঁরা পরাজিত হয়। উভয় পক্ষের ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি ছিল যে যুদ্ধে জয়লাভ করেও জার্মান বাহিনী ব্রিটিশ নৌশক্তির সাথে আর যুদ্ধে। অবতীর্ণ হতে সক্ষম হয়নি।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের দ্বারা বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে এর প্রভাব যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে। বলশেভিক যুদ্ধনীতির পক্ষপাতী ছিল না। ফলে রাশিয়া ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তি দ্বারা জার্মানির সাথে যুদ্ধ মিটিয়ে ফেলে। রাশিয়ার সাথে যুদ্ধাবসানের ফলে জার্মানি পূর্ব ইউরোপ থেকে সৈন্য বাহিনীকে পশ্চিম ইউরোপে নিয়োজিত করার সুযোগ পায়। এ সময় মিত্রশক্তির সামরিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়লে আমেরিকা মিত্রপক্ষের সহায়তায় যুদ্ধে অংশ নেয়। এতে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণে মার্কিন জাহাজ ও বাণিজ্যের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল। ফলে জার্মানিকে পরাজিত করা আমেরিকার স্বার্থের দিক দিয়ে যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল। আমেরিকার অংশগ্রহণে মিত্রপক্ষের সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ফলে যুদ্ধের চিত্র পাল্টাতে শুরু করে।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে জার্মানি মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে অ্যামিয়েন্সের যুদ্ধে প্রবল শক্তিতে আঘাত হানে। উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং বহু সৈন্য প্রাণ হারায়। জেনারেল ফচের সুদক্ষ পরিচালনায় ইউরোপ ও এশিয়ায় জার্মান বাহিনী পরাজিত হতে শুরু করে। তুরস্ক ও অস্ট্রিয়া মিত্রপক্ষের নিকট পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে জার্মানি একাই লড়তে থাকে। ইত্যবসরে জার্মানিতে রুশ বিপ্লবের অনুরূপ আন্দোলন শুরুর আশঙ্কা দেখা দেয়। জার্মান নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সর্বত্র সংকটাপন্ন : অবস্থার ফলে জার্মানি যুদ্ধাবসানের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর মিত্রপক্ষের সাথে জার্মানির অস্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়। দীর্ঘ চার বছর সাড়ে চার মাসের যুদ্ধের বীভৎস অভিজ্ঞতার পর ইউরোপে শাস্তি ফিরে এলো।
জার্মানির পরাজয়ের কারণ
জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সমরশক্তিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। শিল্পবিপ্লবের অর্জিত আয় দ্বারা অতিদ্রুত সফলতার সাথে সমরশক্তিতে সমৃদ্ধ হয়। জার্মান বুদ্ধিজীবী ও সমরনায়করা জার্মানদের মধ্যে এরকম এক জাতীয়তাবাদী ধারণা জন্ম দিতে সক্ষম হন যে, বিশ্বে জার্মানরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। এ বোধ থেকেই জার্মানি শ্রেষ্ঠ সমরশক্তি অর্জনে অনুপ্রাণিত হয়। এর পরও জার্মানি ১ম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় বরণ করে।
জার্মানির পরাজয়ের কারণ নিচে আলোচিত হলো:
ক. জার্মানির ভূরাজনৈতিক অবস্থা: ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জার্মানির ভৌগোলিক সীমা ছিল সীমিত। শুধু দক্ষিণে মিত্র দেশ ছিল ইতালি, বাকি তিনদিকেই শত্রু দ্বারা বেষ্টিত ছিল। আক্রমণে সিদ্ধহস্ত হলেও পাল্টা আক্রমণে আত্মরক্ষা করার মতো যথেষ্ট পশ্চাদ্ভূমি জার্মানির ছিল না। তাই সংগত কারণেই জার্মানিকে পরাজয় বরণ করতে হয়।
খ. দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধ যুদ্ধের দীর্ঘসূত্রতা জার্মানির পরাজয়ের অন্যতম কারণ। জার্মানির সমরশক্তি স্বল্পকালব্যাপী যুদ্ধের জন্য ছিল উপযুক্ত। কেননা, ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো উপনিবেশ জার্মানির ছিল না। উপনিবেশ না থাকায় জার্মানি ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো উপনিবেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করতে পারেনি। তাই জার্মানি সৈন্যসংখ্যা হতাহতের পর শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে অসমর্থ হওয়ায় জার্মানি পরাজিত হয়।।
গ. নৌশক্তির দুর্বলতা ইউরোপের নৌশক্তিতে সর্বদাই ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। ফ্রান্সের নৌশক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের নৌশক্তির সাথে যুক্ত হওয়ায় ঈঙ্গ-ফ্রাংকো নৌশক্তি অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে আবির্ভূত হয়। ভূমধ্যসাগরে জার্মান নৌশক্তির রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা ঈঙ্গ-ফ্রাংকো নৌশক্তি ভেঙে দিলে জার্মানির পক্ষে নৌ-যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, যা তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
ঘ. রণাঙ্গনের সংখ্যাধিক্য: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল একাধিক। জার্মানিকে একই সময়ে পূর্ব সীমান্তে রাশিয়া এবং পশ্চিম সীমান্তে ইঙ্গ-ফ্রাংকো বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়। ফলে কোনো এক রণাঙ্গনে জার্মানি পূর্ণ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেনি। আবার কূটনৈতিক ব্যর্থতার জন্য রাশিয়াকে ত্রিশক্তি আঁতাত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারা পরাজয়ের অন্যতম কারণ। যদিও ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করলে জার্মানির জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে মিত্রপক্ষে যোগদান করলে জার্মানির যুদ্ধে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ঙ. ফ্রান্সের যুদ্ধংদেহী মনোভাব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ফ্রান্স ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়। এ পরাজয়ের গ্লানি ফরাসিদের মনে প্রতিশোধের স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। কাজেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই ফরাসি সৈন্য ও জনতা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলে জার্মান সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
চ. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যদিও আমেরিকা তার নিরপেক্ষতার কথা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু বাস্তবে আমেরিকা কখনো নিরপেক্ষ ছিল না। তার সামরিক ও আর্থিক সমর্থন ছিল ব্রিটেন জোটের প্রতি। এছাড়া আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরে যায় এবং জার্মানির পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

