• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি

লীগ অব নেশনস গঠনের পটভূমি

জাতিপুঞ্জ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতা ও বীভৎসতা মানুষের মনে স্বভাবতই শান্তির স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। যুগে যুগে সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এ কথা সত্য যে যুদ্ধের মাধ্যমে বহু আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসম্বাদের সমাধান হয়েছে। সাথে সাথে এ কথাও সত্য, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা মানুষকে ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভবিষ্যতে এরূপ হত্যাযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি আর যেন না ঘটে এবং মানুষের কল্যাণ ও শাস্তি আর যেন বিঘ্নিত না হয়, সেজন্য ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে পোপ পঞ্চাশ বেনেডিক্ট আপস ও আলোচনার দ্বারা আন্তর্জাতিক বিরোধ মেটানোর জন্য আবেদন করেন। ফলে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রেরণা নতুন করে দেখা দেয়। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে League of Nations বা জাতিপুঞ্জ স্থাপিত হয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয়। ফ্রান্সে নেপোলিয়নের পতনের পর ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে 'পবিত্র চুক্তি' ও 'ইউরোপীয় সংঘ' স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যুদ্ধ পরিহার করা সম্ভব হয়নি। তথাপি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে ভবিষ্যতে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আরও বেশি উপলব্ধি হতে থাকে; যার প্রথম ও প্রধান উদ্যোক্তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসন। উইলসন তার ঘোষিত ১৪ দফার শেষ দফায় পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের উপর জোর দেন। সে মতে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে যে শান্তি সম্মেলন হয়, তাতে ১৯ সদস্যের এক কমিটিকে এ সংস্থার গঠনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।। এর নাম হয় লীগ কভেনেন্ট (League Covenent)। এ গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুন জাতিপুঞ্জ গঠন করা হয় এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি লীগের সাধারণ পরিষদের প্রথম সভায় তা অনুমোদন পায়। পূর্বগামী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে লীগের মূলনীতি ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। সেগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের শক্তিসাম্য বজায় রাখা। কিন্তু জাতিপুঞ্জের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং মানুষের কল্যাণ সাধন করা। জনমানুষের প্রত্যাশা ছিল, লীগ শুধু আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসম্বাদের নিষ্পত্তি করবে না, বরং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সহযোগিতা দিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করবে।

জাতিপুঞ্জের গঠন

লীগের চুক্তিপত্র মূলত একটি দলিলবিশেষ। এতে মোট ২৬টি ধারা সন্নিবেশিত ছিল। প্রধানতা ৪টি সাংগঠনিক সংস্থা বা বিভাগ নিয়ে এটি গঠিত ছিল। একটি সাধারণ পরিষদ (Assembly), একটি কার্যকরী কাউন্সিল, একটি আন্তর্জাতিক স্থায়ী আদালত্ব এবং একটি সেক্রেটারিয়েট বা কার্যসংসদ। প্রত্যেক বিভাগের কার্য নির্ধারিত ছিল। লীগের সাধারণ সভায় লীগের সকল সদস্য যোগ দিতে পারত। বছরে অন্তত একবার অধিবেশন বা সভা আহ্বানের নিয়ম ছিল। প্রতি সদস্যের একটি করে ভোট ছিল। সাধারণ পরিষদের কোনো কার্যকরী ক্ষমতা ছিল না, শুধু আলোচনা করতে ও পরামর্শ দিতে পারত। এর ৫ জন স্থায়ী এবং ৪ জন অস্থায়ী সদস্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপান ছিল স্থায়ী সদস্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র লীগে যোগদান না করায় স্থায়ী সদস্যসংখ্যা হয় ৪। লীগের এখতিয়ারভুক্ত যাবতীয় বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার্যকরী কাউন্সিলকে দেওয়া হয়েছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। লীগের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য একটি সচিবালয় ছিল, যার প্রধান ছিলেন একজন মহাসচিব বা সেক্রেটারি জেনারেল। প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন এরিক ড্রামন। এ পদে তার নিয়োগের বিষয়ে লীগের গঠনতন্ত্রেই উল্লেখ করা হয়েছিল। নিয়ম করা হয়, কাউন্সিল সাধারণ সভার মতামত নিয়ে পরবর্তী সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ দেবে। জেনেভা শহরে জাতিপুঞ্জের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়।

নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে আন্তর্জাতিক স্থায়ী আদালত স্থাপন করা হয়। আদালতের বিচারপতিদের ৯ বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়ার বিধান করা হয়। লীগ গঠনের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রম ও শ্রমিক সম্পর্কিত নানাবিধ সমস্যার উদ্ভব হলে একটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংঘ স্থাপন করা হয়। এর সদর দপ্তর হয় জেনেভায়। শ্রম সংঘও (ILO) জাতিপুঞ্জের একটি সাংগঠনিক বিভাগ। প্রত্যেক সদস্য দেশ এ সংস্থার সদস্য হতে পারত।

লীগের উদ্দেশ্য

জাতিপুঞ্জের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ বন্ধ করে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা। গঠনতন্ত্রের ১০-১৬ নং ধারায় এ সম্পর্কে বিধান রাখা হয়েছিল।

ক. ১০ নং ধারায় বলা হয়, লীগের সদস্যদের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা হবে।

খ. ১১ নং ধারায় যৌথ নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করা হয়। এতে বলা হয়, লীগের কোনো সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে আক্রমণের বিরুদ্ধে লীগের অন্যান্য সদস্য যৌথভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

গ. ১২ নং ধারায় আন্তর্জাতিক বিরোধের নিষ্পত্তি লীগ কাউন্সিল বা আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের কথা বলা হয়। ১৩ নং ধারায় আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত সকলকে মেনে নিতে অনুরোধ জানানো হয়।

ঘ. ১৪ নং ধারায় আন্তর্জাতিক আলাদত গঠনপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হয়।

ঙ. ১৫ নং ধারায় লীগ কাউন্সিলের সকল সদস্যের সম্মতিক্রমে রাজনৈতিক বিরোধের সমাধানের কথা বলা হয়।

চ. ১৬ নং ধারায় বলা হয়, যেকোনো সদস্য রাষ্ট্র লীগের আদর্শ অগ্রাহ্য করলে তাকে আক্রমণকারী ঘোষণা করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে অপর সদস্যরা অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করতে বাধ্য থাকবে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক শাস্তির স্বার্থে জাতিপুঞ্জের গঠনতন্ত্রে নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়।।

আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় জাতিপুঞ্জের কার্যাবলি

জাতিপুঞ্জ আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান ও শান্তিরক্ষার ব্যাপারে সব সময়ই নীতিনিষ্ঠা ও আদর্শবাদিতার পরিচয় দিয়েছিল এমন কথা স্বীকার করা যায় না, বরং এ সময় জাতিপুঞ্জ অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব ও নীতি বিরোধিতার পরিচয় দিয়েছিল। যেমন: মেক্সিকোর বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ার অভিযোগ, ব্রিটেন কর্তৃক বলপূর্বক চীনের উপর চুক্তির প্রশ্নের মীমাংসা, ইঙ্গ-মিশরীয় বিবাদের মীমাংসা প্রভৃতি বহু ক্ষেত্রেই জাতিপুঞ্জ পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। তবু জাতিপুঞ্জ আন্তর্জাতিক অশান্তি সৃষ্টিকারী বহু বিবাদ মীমাংসা করে অবশ্যম্ভাবী বহু যুদ্ধের আশঙ্কা নিবারণ করতে সমর্থ হয়েছিল।

সীমানা নির্ধারণ নিয়ে ইরাক-তুরস্ক বিবাদ উপস্থিত হলে জাতিপুঞ্জ কর্তৃক নিযুক্ত 'সীমানা নির্ধারণ কমিশন' কার্যরত থাকলে সে সময় তুরস্কের কুর্দিরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। জাতিপুঞ্জ কর্তৃক দ্বিতীয় কমিশন শান্তিপূর্ণ উপায়ে সীমানা নির্ধারণ করে। গ্রিস-বুলগেরিয়ার মধ্যে পারস্পরিক আক্রমণ ও সীমানা লঙ্ঘনজনিত বিবাদ চলতে থাকলে জাতিপুঞ্জ কর্তৃক কমিশন সুষ্ঠু তদন্তের পর শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিবাদের মীমাংসা করে। তাছাড়া পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরুর উপক্রম হলে জাতিপুঞ্জের চেষ্টায় আপস-মীমাংসা হয়।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতিপুঞ্জ 'জেনেভা চুক্তি' নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রস্তুত করেছিল, যার মূলকথা ছিল, কোনো সামরিক সংঘাত শুরু হলে চার দিনের মধ্যে লীগের কাউন্সিল কে আক্রমণকারী তা স্থির করবে এবং অপরাপর সদস্য আক্রান্ত দেশকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু ইংল্যান্ড এটা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। জেনেভা চুক্তি ব্যর্থ হলেও শান্তি রক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে এর যথেষ্ট মূল্য রয়েছে। তাছাড়া ভার্সাই সন্ধি কর্তৃক নির্ধারিত জার্মানি ও বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যবর্তী সীমারেখার নিরাপত্তা ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে 'লোকার্নো চুক্তি' দ্বারা স্বীকৃত হয়। এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর জাতিপুঞ্জের স্থায়ী সদস্য হিসেবে জার্মানিকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। তাছাড়া জার্মানির সাথে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, চেকোশ্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ডের উদ্ভুত বিবাদের নিষ্পত্তি করার শর্তও এ চুক্তিতে স্বীকৃত হয়েছিল। জাতিপুঞ্জ বিবদমান পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার মধ্যে স্বার্থ সংঘাত নির্মূল করতে না পারলেও যুদ্ধ পরিস্থিতি জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপের জন্য প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করতে পারেনি।

পরিশেষে, জাতিপুঞ্জের মাধ্যমেই শ্রম সমস্যার সমাধান, মহামারি থেকে রক্ষা ও আফিম ব্যবহার রোধ প্রভৃতি ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা সম্ভব হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বৈঠকের আহ্বান, দাস ব্যবসা, আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত অস্ট্রিয়াকে উদ্ধারের ব্যাপারেও জাতিপুঞ্জের সফল প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করা যায় না।

১৯৩২-৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতিপুঞ্জ বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন আহ্বান করে। এ সম্মেলনে জার্মানি ফ্রান্সের সমপর্যায়ের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দাবি জানালে প্রতিনিধিবর্গের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ফলে জার্মানি সম্মেলন পরিত্যাগ করে শক্তি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়। এ সময় থেকেই জাতিপুঞ্জের পতনের সূত্রপাত হয়।

বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জাতিপুঞ্জের অবদান, সাফল্য ও গুরুত্ব

জাতিপুঞ্জ গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। গঠনের পর প্রথম দশকে জাতিপুঞ্জ শান্তিপূর্ণ উপায়ে অনেক বিরোধের নিষ্পত্তি করে এক নবযুগের সূচনা করেছিল। এ জন্য প্রথম দশককে জাতিপুঞ্জের স্বর্ণযুগ বলা হয়। নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ নিয়ে দীর্ঘ এক দশক পৃথিবীকে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা করেছিল; যা ছিল এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পৃথিবীর জনসমাজকে আন্তর্জাতিক সমবায়, সৌহার্দ ও সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল। আন্তর্জাতিক সমস্যা ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী মনোবৃত্তি আন্তর্জাতিকতার প্রয়োজনে কতটুকু দমন করা উচিত, সে শিক্ষা দিয়েছিল। জাতিপুঞ্জ তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবতার কার্যাদির দ্বারা বিশ্বের কাছে এক চমৎকার ও অভিনব দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক নির্ধারণে সাধারণ মানুষই যে মূলভিত্তি, সে শিক্ষা পরবর্তী যুগের বিশ্বমানবতার কাছে লীগ রেখে গিয়েছিল।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশে প্রচুর ঋণ দান করে অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করা ছিল লীগের একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। নারীসমাজের ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এবং দাসপ্রথা নিবারণে জাতিপুঞ্জের সাফল্য ছিল অনেক। লীগ যদিও বিশ্বকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখতে ব্যর্থ হয়, তথাপি বিশ্বমানবতার কল্যাণে তার অবদান ও গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। লীগ ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বত্র রোগ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী স্বাস্থ্য সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেছিল। লীগ পূর্বাঞ্চলের কলেরা ও প্লেগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ম্যালেরিয়া কমিশন নামে অপর একটি স্বাস্থ্য সংস্থা গঠন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

যেসব সমস্যা সমাধান করে লীগ সাফল্য অর্জন করেছিল তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

ক. আলেন্ড দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে সুইডেন-ফিনল্যান্ড বিরোধ নিষ্পত্তি,

খ. সাইলেশিয়া নিয়ে পোল্যান্ড-জার্মানির বিরোধ নিষ্পত্তি,

গ. করপুর নিয়ে গ্রিস-ইতালির বিরোধ নিষ্পত্তি এবং

ঘ. গ্রিস-বুলগেরিয়া সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি।

কিন্তু ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে থেকে জাতিপুঞ্জ ব্যর্থতার পরিচয় দিতে থাকে। মাঞ্চুরিয়াকে কেন্দ্র করে চীন ও জাপানের বিরোধ নিষ্পত্তিতে জাতিপুঞ্জ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। ঠিক একই রকম ইতালি-ইথিওপিয়ার মধ্যে যুদ্ধ সৃষ্টি হলে ইথিওপিয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও লীগ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সফলতার পরিচয় দেয়নি। ইংল্যান্ড-ফ্রান্স দেশের জনমতের চাপে ইতালিকে আক্রমণকারী সাব্যস্ত করে ইতালির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করে, ফলে ইতালি লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করে। এভাবে লীগের ব্যর্থতার ফলে যৌথ নিরাপত্তা নীতির অরসান হতে থাকে। জার্মানিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা হিটলারের উত্থান ও ইতালিতে মুসোলিনির উত্থান ঘটলে শান্তিময় পৃথিবী আবার অশান্ত হয়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হতে থাকে।

ব্যর্থতার কারণ

বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে দূর করে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে লীগ তার যাত্রা শুরু করেছিল। কয়েকটি ক্ষেত্রে লীগ সাফল্য লাভ করলেও সে তার মূল দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। অর্থাৎ বিশ্ব থেকে যুদ্ধভীতি দূর করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে লীগ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। লীগের এই ব্যর্থতার ইতিহাস সত্যিই বেদনাদায়ক। জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতার কারণ ছিল অনেক। নিম্নলিখিত কারণগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ:

১। লীগের সদস্যপদ গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের অসম্মতি এবং বৃহৎ দুটি দেশ জার্মানি-রাশিয়াকে প্রথম দিকে সদস্যপদ না দেওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে এর গুরুত্ব অনেকটা কমে যায়। এটি লীগের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার একটি বড় কারণ। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে লোকার্নো চুক্তির দ্বারা জার্মানিকে এবং ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়াকে লীগের সদস্যপদ দেওয়া হয় বটে, কিন্তু ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানি ও জাপান জাতিপুঞ্জ ত্যাগ করায় এ সংস্থা আবার গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। জাতিপুঞ্জের ইতিহাসে কোনো সময়ই পৃথিবীর সকল দেশ এর সদস্য ছিল না। এটি ছিল জাতিপুঞ্জের মারাত্মক দুর্বলতা।

২। সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লীগ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কোনো একটি রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো না। এ নিয়ম আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে গুরুতর বাধার সৃষ্টি করে।

৩। জাতিপুঞ্জের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী না থাকায় জাতিপুঞ্জের সিদ্ধান্তগুলোকে যেকোনো রাষ্ট্র সুপারিশ হিসেবে মনে করত, যা ছিল লীগের একটি দুর্বল দিক।

৪। যেকোনো আন্তর্জাতিক সংগঠনের সফলতার শর্ত হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আন্তরিক সমর্থন ও সহায়তা, যা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনেকের মধ্যে ছিল না।

৫। জাতিপুঞ্জের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো দেশেরই সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। কারণ এটি ছিল একটি পরীক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। তাই একে শক্তিশালী করে তোলার জন্য কেউ আন্তরিকভাবে পদক্ষেপ নেয়নি। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই জাতিপুঞ্জের কার্যাবলিকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। জাতিপুঞ্জই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন, যা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বযুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো পুনর্গঠনে লীগ সফল ভূমিকা রেখেছিল।

৬। আন্তর্জাতিক স্বার্থরক্ষার জন্য তখন কোনো দেশই জাতীয় স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না। তখন জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা দ্বারা রাষ্ট্রবর্গ অতিমাত্রায় প্রভাবিত ছিল। কারণ সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানসিকতা তখনো কোনো দেশের গড়ে ওঠেনি।

৭। জার্মানির প্রতি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তোষণনীতি লীগের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার অপর প্রধান কারণ। যুক্তরাষ্ট্র লীগে যোগ না দেওয়ায় প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই লীগের উপর কর্তৃত্ব করত। ব্রিটেন ও ফ্রান্স কর্তৃক তোষণনীতির দরুন জার্মানি ও ইতালির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লীগের পক্ষে কঠোর কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি।

৮। লীগ চুক্তিপত্র ছিল গণতন্ত্রভিত্তিক একটি দলিল। কিন্তু ইউরোপে একনায়কত্বের উদ্ভব লীগের আদর্শ ও কর্মপন্থাকে নস্যাৎ করে দেয়। জার্মানি, ইতালি, জাপান ও স্পেনের আচরণ লীগের মৃত্যুঘণ্টা বাজায়।

লীগের পতনের মূলে কতগুলো মৌলিক দুর্বলতা ছিল:

প্রথমত: গঠনতান্ত্রিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, লীগের সনদে এমন কতগুলো ফাঁক ছিল, যার জন্য এর কার্যকারিতা বহুলাংশে ব্যাহত হয় এবং পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, লীগের সনদে যুদ্ধকে বেআইনি বা নিষিদ্ধ করা হয়নি।

দ্বিতীয়ত: সাংগঠনিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, জাতিপুঞ্জে ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গেরই প্রাধান্য ছিল অথচ যুদ্ধ শেষে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইউরোপবহির্ভূত রাষ্ট্রগুলোর সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত: রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজ নিজ রাজনৈতিক ও জাতীয় স্বার্থ ছিল পরস্পরবিরোধী, ফলে লীগের নিরপেক্ষ ন্যায্য নীতি কোনো রাষ্ট্রের মেনে চলা সম্ভব হয়নি। নানা কারণে লীগ ব্যর্থ হলেও লীগের প্রচারিত আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্য ও আদর্শের প্রভাব স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। জাতিপুঞ্জের সংক্ষিপ্ত জীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতা দুই-ই ছিল। জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতার জন্য তাকে সর্বতোভাবে দায়ী করা যায় না। তাছাড়া জাতিপুঞ্জকে পুরোপুরি ব্যর্থ বলেও স্বীকার করা যায় না। এর ব্যর্থতা গঠনপ্রক্রিয়াকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনকে ত্রুটিহীন করার জন্য যে সকল প্রক্রিয়া ও সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত ছিল, তার অভাব ছিল বলেই সেটা ব্যর্থ হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে জাতিপুঞ্জের আত্মপ্রকাশ পৃথিবীতে এই প্রথম। কাজেই সফলতার পাশাপাশি এর ব্যর্থতাও মেনে নিতে হবে। এর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর UNO-র (সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের) উদ্ভব হয়েছিল।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ