- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভার্সাই সন্ধি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব
প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে উভয় পক্ষ এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। উভয় পক্ষই তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ শুরু করে। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এ মহাযুদ্ধের ফলাফলও ছিল সুদূরপ্রসারী।
১। ইউরোপে রাজবংশের অবসান: প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে ইউরোপে চারটি রাজবংশ উৎখাত হয়। অস্ট্রিয়ার হ্যাপস্বর্গ রাজবংশ, প্রুশিয়ার হোহেন জোলার্ন রাজবংশ, রাশিয়ার রোমানভ রাজবংশ এবং তুরস্কের ওসমানীয় রাজবংশ। এসব দেশে স্থাপিত হয় প্রজাতান্ত্রিক সরকার। সেখানে জাতীয়তাবাদী শক্তির বিজয় সূচিত হয় এবং জাতিতে জাতিতে বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির পথ উন্মুক্ত হয়।
২। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ: এ যুদ্ধের ভয়াবহতা, নিষ্ঠুরতা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পৃথিবীতে এ পর্যন্ত সংঘটিত সকল যুদ্ধকে অতিক্রম করে। যুদ্ধক্ষেত্রে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি আর আহতের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। অনাহারে, অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণ করেছে ৭০ লাখ মানুষ। অগণিত লোক পঙ্গুত্ব বরণ করে। শত্রু অধিকৃত ৩টি মহাদেশের ৩৪টি দেশকে অপরিমিত ক্ষয়ক্ষতি ও অবর্ণনীয় দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। : যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসলীলা, যুদ্ধরত সৈন্যদের বর্বরতা, সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব, তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া জাতীয় ঋণের বোঝা সবকিছুই ছিল এ যুদ্ধের বিভীষিকাময় ফল।
৩। অর্থ ও সম্পত্তিনাশের পরিমাণ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ সর্বগ্রাসী যুদ্ধে ২৭ হাজার কোটি ডলার খরচ হয়। এ বিপুল অর্থের অপচয়ের ফলে পরবর্তীকালে পৃথিবীর অর্থসংকট প্রকট হয়ে দেখা দেয়। কোটি কোটি ডলার উভয় পক্ষের দেশগুলোকে খরচ করতে হয় আত্মরক্ষা ও আক্রমণের জন্য। ফলে সব দেশেরই জাতীয় ঋণের পরিমাণ অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধরত দেশগুলো একে অপরের অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, ব্রিজ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ৪ বছরের যুদ্ধের ভয়াবহতা মানুষের মধ্যে মনোবৈকল্যের সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীকালে নানা সামাজিক সমস্যার উদ্রেক করে।
৪। মানচিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ও জাতীয়তাবাদের জয় এ যুদ্ধে অনেক সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে অনেক নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। জার্মানিকে সম্পূর্ণ সংকুচিত করা হয়। অস্ট্রিয়া ও তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য তাদের বিশাল আয়তন থেকে ছোট আয়তনের রাষ্ট্রে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইউরোপকে পুনর্গঠিত করা হয়। বহু জাতির সমন্বয়ে গঠিত সাম্রাজ্যগুলো থেকে বিছিন্ন করে এক ভাষাভাষী ও এক জাতির ভিত্তিতে কয়েকটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করা হয়। রুশ সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে ফিনল্যান্ড, অ্যাস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া গঠন করা হয়। পোলদের একত্রিত করে নতুনভাবে পোল্যান্ড গঠন করা হয়। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি থেকে বিচ্ছিন্ন করে চেকোস্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি গঠন করা হয়। তাছাড়া আলসেস-লোরেন ফ্রান্সকে, ট্রান্সসিলভেনিয়া রুমানিয়াকে, স্লেজভিগ ডেনমার্ককে এবং ক্রিয়েন্ট ইতালিকে দেওয়া হয়। এতে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের জয় হয় এবং তা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
৫। স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণতন্ত্রের প্রসার এ যুদ্ধের পরপরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রেরণা জাগে। ভারতবর্ষ, মিশর ও পূর্ব আফ্রিকা প্রভৃতি অঞ্চলের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ যুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রেরও বিস্তার হয়। রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন অবশেষে সাম্যবাদ তথা বলশেভিক বিপ্লবে রূপ নেয়।
৬। আমেরিকার মর্যাদা বৃদ্ধি: প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, কিন্তু আমেরিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়ে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী দেশে পরিণত হয়। বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে সাহায্য দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে সে বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এ যুদ্ধের ফলে আমেরিকার হাতে বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব চলে আসে। আমেরিকার মর্যাদা ও প্রভাব সারা বিশ্বে বৃদ্ধি পায় এবং বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য কেন্দ্র অর্থাৎ মোড়লে পরিণত হয়।
৭। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি: এ যুদ্ধের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান, যাতায়াত, শিক্ষাদীক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিখুঁত মারণাস্ত্র আবিষ্কার ও প্রতিপক্ষের মারণাস্ত্র থেকে রক্ষা পেতে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়। বিশেষ করে এ যুদ্ধের প্রয়োজনে চিকিৎসাশাস্ত্র, বিমান চলাচল ও বিমান আক্রমণের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়।
৮। নারী মুক্তি: সামাজিক দিক থেকে দেখা যায় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে সাধারণভাবে নারী ও শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি ঘটে। যুদ্ধের সময় পুরুষরা যুদ্ধে যোগ দিলে গৃহবধূরা গৃহকোণ ছেড়ে অফিসে, বিদ্যালয়ে, ক্ষেতে, খামারে, কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ শেষ হলে আর নারীরা গৃহের বদ্ধ জীবনে ফিরে যায়নি। ইউরোপে তারা পুরুষের পাশাপাশি মাথা উঁচু করে চলতে আরম্ভ করে।
৯। শ্রমিক জাগরণ: ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণি যুদ্ধের সময় তাদের শক্তির কথা বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে যে, শ্রমিক কলে, কারখানায় কাজ করলে তবেই যুদ্ধের মারণাস্ত্র নির্মিত হয়; সাধারণ লোকের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য উৎপন্ন হয়। শ্রমিকের শ্রমের দ্বারাই রাষ্ট্রের সম্পদ উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকের দাবিদাওয়া সম্পর্কে তাদের সচেতন করে। রুশ বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণি লাভবান হলে, অন্যান্য দেশেও শ্রমিকের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্রকে আইন রচনা করতে হয়। শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা বাড়ে।
১০। জনমত ও সংবাদপত্রের প্রভাব বৃদ্ধি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে প্রতিটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে জনমতের প্রভাব বিশেষভাবে পড়ে। অতীতে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সাধারণ লোকের আগ্রহ কম ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর লোকজন বৈদেশিক নীতির গুরুত্ব বুঝতে পারে। সংবাদপত্রের প্রসারের ফলে লোকজন বৈদেশিক ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। এজন্য গোপন কূটনীতির (Secret diplomacy) স্থলে খোলা কূটনীতি চালু হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, ধ্বংস, বিপুল অর্থ ও লোকক্ষয় এবং অন্যান্য দিক দিয়ে এর বৈশিষ্ট্য ছিল অনন্য। ফলাফলের দিক দিয়েও এর সাথে পূর্বের কোনো যুদ্ধের তুলনা চলে না। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচনার জন্য এর অবদান ছিল অপরিসীম। তাই বলা যায়, এ যুদ্ধ বিশ্বমানবতার ক্ষতির সাথে কিছু উপকারও করে। তবু এ যুদ্ধ ছিল বিশ্বের মানুষের জন্য এক বিরাট অভিশাপ।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ

