- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
- পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থান
বাঙালিদের সমর্থন ছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্র আদৌ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। তাই অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতৃত্বকে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের এক অর্থে বাধ্য হয়ে সম্পৃক্ত করতে হয়। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমানরা ছিল নিচু জাতের, আচার-আচরণে বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে প্রায় হিন্দুদের কাছাকাছি। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিজেদের সম্বন্ধে ছিল উচ্চ ধারণা। তাদের পূর্বপুরুষেরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আগত। ধমনিতে তাদের নীল রক্ত। এভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জাত্যাভিমান কাজ করত। তাছাড়া হাজার মাইলের দূরত্বে অবস্থিত পূর্ব বাংলার পাকিস্তান রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যেন তাদের কাছে বাড়তি পাওয়া ছিল।
১. রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে: শুরুতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক উত্তর-ভারত থেকে আগত মোহাজের ও পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের উর্দুভাষী রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে চলে যায়। ১৯৪৭-৫৮ এ সময়ে পাকিস্তানে ৪ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একমাত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন অবাঙালি স্বার্থের প্রতিনিধি। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত পূর্ব বাংলার গভর্নরদের অবস্থাও ছিল ভিন্ন। পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বাঙালিদের কার্যকর প্রতিনিধিত্ব বরাবরই উপেক্ষিত ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক শাসকগোষ্ঠী নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী, দেশ রক্ষা বাহিনীসমূহের সদর দপ্তর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেশের পশ্চিম অংশে স্থাপন করে।
২. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানায়, আমদানি-রপ্তানি, ব্যাংক-বিমা, বেসরকারি পরিবহন ইত্যাদি পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য ছিল। আর পাকিস্তানভিত্তিক আদমজি, দাউদ, বাওয়ানি, ইস্পাহানি এসব বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ মালিকরা পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা পূর্ব বাংলাকে কাঁচামালের সরবরাহ দেশ হিসেবে শোষণ করতে থাকে। পূর্ব বাংলার সম্পদ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতে জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল প্রায় ৫২%। অথচ পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ২৮৮ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৩৫১ টাকা। ১৯৬৯-৭০ সালে এ ব্যবধান দ্রুতগতিতে বেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু যেখানে ছিল ৩২১ টাকা, সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৫৩৩ টাকা।
৩. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পূর্ব বাংলার জনগণকে ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব থেকে মারাত্মকভাবে বঞ্চিত করা হয়। বাঙালি নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরমভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়। ১৯৪৭-৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে একজনও বাঙালি ছিল না। তবে ১৯৪৭ থেকে ৫৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ৪ জন গভর্নরের মধ্যে মাত্র ১ জন বাঙালি ছিল। তাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের প্রতি অবহেলা, উপেক্ষা বাঙালি নেতৃবৃন্দকে চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে।
৪. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত নাজুক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় যে ৯৫ জন আইসিএস অফিসার পাকিস্তানের প্রশাসনিক বিভাগে যোগদান করেছিল তাদের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ১ জন। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বের হার ছিল শতকরা ৫, ১০ ও ১৬ জন। এছাড়া স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর ও অস্ত্র কারখানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের কোনো কর্তৃত্বই ছিল না।
৫. শিক্ষাক্ষেত্র: শিক্ষাক্ষেত্রেও বাঙালিরা পাকিস্তান আমলে চরম বৈষম্যের শিকার হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের অশিক্ষিত রেখে তাদের ওপর শাসন-শোষণ চালিয়ে যাওয়া। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫৫-৫৬ অর্থবছরে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৮৪.৬ কোটি টাকা। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ২৬.৫ কোটি টাকা। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিত লোকের হার তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল অনেক কম।
৬. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলে বাঙালিরা চরম বৈষম্য ও লাঞ্ছনার শিকার হন। এক ধরনের আভিজাত্যবোধ, অহমিকা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ সব সময় পোষণ করতেন। তারা পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি চরম অবহেলা করতে থাকে। তাই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে তারা অস্বীকৃতি জানায়। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের "আধা মুসলিম" মনে করত। সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অযাচিত মুরব্বিপনায় বাঙালি-অবাঙালি বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। যা পরবর্তীতে পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির সংকটকে প্রবল করে তোলে।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ