• হোম
  • একাডেমি
  • সাধারণ
  • একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি
  • পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ

পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।

Back

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ

সামরিক শাসন, ১৯৫৮

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিশেষ আলোচিত বিষয়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলো বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সেনা প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ইস্কান্দার মির্জা সেনা প্রধান আইয়ুব খানের উস্কানিতে মূলত সামরিক আইন জারি করেন। কিন্তু সামরিক আইন জারির মাত্র ২০ দিন পর আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে নিজেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর শুরু হয় জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন।

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের কারণ (Causes of martial law in 1958)

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। নিম্নে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ উল্লেখ করা হলো:

১. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারেনি। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ কুচক্রী ও ষড়যন্ত্রকারী নেতাদের পকেট সংগঠনে পরিণত হয়। এ সময় নানারকম নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে আওয়ামী লীগকে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। সু-সংগঠিত রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় আমলা-সেনাবাহিনী রাজনীতিতে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে সক্ষম হয়। ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করলে তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠে নি।

২. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলার অভাব, দল বদলের লজ্জাজনক প্রতিযোগিতা, উপদলীয় কোন্দল প্রভৃতি কারণে জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগ গ্রহণ করে সেনানায়ক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের প্রয়াস পান।

৩. যথাসময়ে নির্বাচনের অভাব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে যথাসময়ে কখনোই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে নির্বাচনকে এড়িয়ে চলতেন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের প্রতি জনগণ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, যা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত করেছিল।

৪. গভর্নর জেনারেলের হস্তক্ষেপ ১৯৪৭ সাল থেকেই মন্ত্রীসভার বিভিন্ন কাজে গভর্নর জেনারেলগণ অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করতেন। গোলাম মোহাম্মদ এবং ইস্কান্দার মির্জার এ ধরনের হস্তক্ষেপ, ষড়যন্ত্র পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। সেনানায়ক আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে উসকে দিয়ে সহজেই সামরিক আইন জারি করতে সমর্থ হন।

৫. ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর মৃত্যু: ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ও বিরোধী দলীয় সদস্যদের মধ্যে এক অপ্রীতিকর ঘটনা চলাকালে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনদিন পর মারা যান। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এ ধরনের অসহিষ্ণু মনোভাব এবং শাহেদ আলীর মৃত্যু সামরিক শাসন জারির পথকে সহজ করে দেয়।

৬. সোহরাওয়ার্দী-গুরমানীর আঁতাঁত সোহরাওয়ার্দী গুরমানীর রাজনৈতিক আঁতাঁত ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির প্রত্যক্ষ কারণ ছিল বলে অনেকে মনে করে। এ সমঝোতায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন।

৭. আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা: ১৯৫৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ সম্ভাবনা পাকিস্তানি কুচক্রী মহলকে শঙ্কিত করে তোলে। তাই এই নির্বাচন বানচাল করতে সামরিক শাসন জারি করা হয়।

৮. সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের লোভ: পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে আসছিলেন। তাই ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান এবং ক্ষমতা দখল আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন সেনাকর্মকর্তাদের ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন।

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের ফলাফল

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতির বহুল আলোচিত এক ঘটনা। সামরিক শাসন জারির ফলে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবল সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়। বাতিল হয় ১৯৫৬ সালের সংবিধান। তাই ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলাফল ছিল ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:

১. সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি: ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ ও ক্ষেত্র তৈরি হয়। সেনাপ্রধানরা সুযোগ পেলেই পরবর্তীতে সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন।

২. গণতন্ত্রের যাত্রা ব্যাহত: এই সামরিক শাসনের ফলে পাকিস্তানে ভঙ্গুর গণতন্ত্রের যাত্রা বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। সামরিক শাসকগণ সবসময় গণতন্ত্রের বিপক্ষে জনমত তৈরিতে সচেষ্ট থাকতেন।

৩. রাজনৈতিক দলের বিকাশ রুদ্ধ পাকিস্তান সামরিক শাসনামলে রাজনৈতিক দলগুলোর বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘুষ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অংশীদারিত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি করে। ক্ষমতাসীন সামরিক শাসকেরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতাকে স্থায়ী করার কৌশল অবলম্বন করেন।

৪. রাজনৈতিক মূল্যবোধের সংকট: পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক শাসন রাজনৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সুকৌশলে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। অনেক সময় তাদেরকে জনসম্মুখে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য দুর্নীতিসহ নানারকম মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়।

৫. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার: পাকিস্তানের সামরিক শাসন জারির পরপরই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। কিছুদিনের মধ্যেই মাওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে।

৬. রাজনৈতিক চক্রান্তের প্রসার পাকিস্তানের সামরিক শাসনামলে রাজনৈতিক চক্রান্ত, দুর্নীতি ও দল বদলের মতো অনৈতিক কাজগুলো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। রাজনীতিতে এ ধরনের নাজুক অবস্থা গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তোলে।

৭. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে উপেক্ষা সামরিক শাসনের ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চরমভাবে উপেক্ষিত হয়। সামরিক শাসকগণ শক্তিশালী কেন্দ্রের সপক্ষে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিপক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

সবশেষে বলা যায়, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল, গণতন্ত্র, সুশাসন, শক্তিশালী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেয়। এ অবস্থা পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ঐক্যে মারাত্মক আঘাত হানে, যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ